ব্যাঙ্গালুরু হতে ১২৫ কিলোমিটার দূরের শ্রীরঙ্গপাটনাস্থ “রঙ্গনাথস্বামী মন্দির” এবং তৎসংলগ্ন টিপু সুলতান এর মৃত্যস্থল ভ্রমণ শেষে আমাদের যাত্রা মাইসুরের সবচাইতে বিখ্যাত এবং চিত্তাকর্ষক পর্যটন স্থল "মাইসোর প্যালেস" এর উদ্দেশ্যে। ২০ কিলোমিটারের মত পথ পৌনে একঘন্টার মত সময়ে পাড়ি দিয়ে বেলা একটার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে। প্যালেস দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ, অনন্য নির্মানশৈলী। টিকেট কেটে আমাদের দলের সবাই ঢুঁকে পড়লাম এই প্যালেসের অভ্যন্তরে। ও হ্যাঁ, এই ট্রিপটি আমার সলো ট্যুর হলেও এদিনের ভ্রমণের জন্য আমি ব্যাঙ্গালুরু হতে একটা টুরিস্ট বাসের টিকেট কেটেছিলাম, তো সেই বাসের সকল যাত্রী এদিন আমার ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন।
মাইসুর প্যালেস'কে বাঙ্গালীরা বলে মহীশূর প্রাসাদ, যা আম্বা বিলাস প্রাসাদ নামেও পরিচিত। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক প্রাসাদটি মূলত "ওয়াদিয়ার" রাজবংশের সরকারি বাসভবন এবং মহীশূর রাজ্যের শাসনকেন্দ্র ছিল। চৌদ্দ শতকের শুরুর দিক হতে মাইসুরের শাসনভার ছিলো এই "ওয়াদিয়ার" রাজবংশের হাতে এবং পনের শতকে এই প্রাসাদটি নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই প্রাসাদ সর্বপ্রথম ১৫৭৪ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিলো; যদিও প্রথম নথিভুক্ত তথ্যের আলোকে প্রথম প্রাসাদটি নির্মিত হয় ১৬৩৮ সালের দিকে। ১৭৯৩ সালে টিপু সুলতান নতুন শহরের পথ তৈরি করার জন্য প্রাসাদটি ভেঙে দিয়েছিলেন বলে একটি অসমর্থিত সূত্র হতে জানা যায়। তবে বর্তমানে যে প্রাসাদ রয়েছে তার আগে সেখানে ছিলো কাঠের একটি প্রাসাদ যা ১৮০৩ সালে নির্মিত হয়েছিলো। এই প্রাসাদটির অবস্থান মহীশূরের কেন্দ্রে এবং পূর্ব দিকে চামুন্ডি পাহাড়ের মুখোমুখি। পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালে তৎকালীন শাসক চামরাজা ওয়াদিয়ার এর জ্যেষ্ঠ কন্যা জয়লক্ষ্মণির বিবাহের সময় পুরাতন প্রাসাদ, যা ছিলো কাঠের তৈরী, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় (উইকি'র সৌজন্যে দেখে নিন সেই কাঠের প্রাসাদটি)-
পরবর্তীতে মহারাজা কৃষ্ণরাজা ওদেয়ার চতুর্থ এবং তার মা মহারানি কেম্পানজাম্মানি দেবী ব্রিটিশ স্থপতি হেনরি আরউইনকে দায়িত্ব দেন একই জায়গায় একই প্রাসাদের নক্সার আদলে নতুন প্রাসাদ নির্মান করার। তার অধীনে এবং ই.ডব্লিউ ফ্রিচলে নামক একজন পরামর্শক প্রকৌশলীর পরামর্শে পাথর, ইট এবং কাঠের তৈরি বর্তমান প্রাসাদটি ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। এর বাইরে মহীশূর প্রাসাদ বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী নির্মাণের তত্ত্বাবধান করেন। তিনি দিল্লি , মাদ্রাজ এবং কলকাতা সফরের সময় বিস্তৃত স্থাপত্য অধ্যয়ন পরিচালনা করেন এবং এগুলো নতুন প্রাসাদের পরিকল্পনা করতে ব্যবহৃত হয়। সেই সময়েই এই প্রাসাদ নির্মানে চল্লিশ লক্ষ রুপীর বেশী খরচ হয়েছিলো। পরবর্তীতে মহারাজা জয়চামরাজেন্দ্র ওয়াদিয়ারের রাজত্বকালে ১৯৩০ সালের দিকে (বর্তমান পাবলিক দরবার হল শাখার সংযোজন সহ) প্রাসাদটি আরও সম্প্রসারিত হয়েছিল। ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যের মতো এই প্রাসাদ এর নকশা করা হয় ইসলামিক, রাজপুতান এবং গথিক স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রনে। বর্তমান প্রাসাদটি তিনতলা বিশিষ্ট অবকাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যার দৈর্ঘ প্রায় ২৪৫ ফুট, প্রস্থ ১৫৬ ফুট এবং উচ্চতা (সর্বোচ্চ স্থানের) ১৪৫ ফুট।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর, প্রাসাদটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে আসে, যদিও এর একটি অংশর মালিকানা প্রাক্তন মহারাজাদের উত্তরপুরুষদের দেওয়া হয়েছে। মহীশূর প্রাসাদ এখন একটি যাদুঘর এবং প্রধান পর্যটক আকর্ষণ। হাইলাইটগুলির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি অলঙ্কৃত কক্ষ এবং কলোনেড দরবার হল। এছাড়াও, প্রতি শরৎকালে খুব ঘটা করে প্রাসাদে দশেরা উৎসব পালিত হয়। দশমী'র রাতে পুরো শহরের সকল আলো কিছু সময়ের জন্য নিভিয়ে দেয়া হয়; শুধুমাত্র এই প্রাসাদের সকল বাতি জ্বলতে থাকে। লক্ষাধিক বৈদ্যুতিক বাতিতে চারিদিক উজ্জ্বল করে দ্যুতি ছড়ায় এই প্রাসাদের আলো; যদিও তা ক্ষণিকের জন্য।
নীচের ছবি এবং সংযুক্ত ইউটিউব ভিডিও দেখে নিতে পারেন দশমীর সময় মাইসুর প্যালেসকে ঘিরে উদযাপন এর চিত্রঃ
তো টিকেট কেটে তো ঢুঁকে পড়লাম ভেতরে, কিন্তু প্রবেশমুখেই নিষেধাজ্ঞা, কোন ছবি বা ভিডিও তোলা যাবে না। অন্যান্য স্থাপনায় যেমন ক্যামেরার জন্য আলাদা টিকেট কেটে ছবি বা ভিডিও করা যায়; এখানে সেই সুযোগ নেই। কিছু সময় পর দেখলাম এই ব্যাপারে কড়াকড়ির নমুনা। প্রাসাদের ভেতরে থাকা উর্দি পরিহিত গার্ডেরা সন্দেহ হলেই মোবাইল ডিভাইস চেক করে। বহু কষ্টে নীচের ছবিটি তুলেছিলাম হাঁটতে হাঁটতে-
কি আর করা ছবি তুলতে না পারার কল্যাণে দুচোখ ভরে দেখে নিলাম সেই ভেতরকার অপূর্ব সকল কারুকাজ আর নির্মানশৈলী। প্রাসাদ হতে বাহির হওয়ার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটলো। এক সাদা চামড়া রমনী খুব কায়দা করে তার আইফোনে হাতে ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাসাদের ভেতরটা ভিডিও করছিলেন। এক গার্ডের সন্দেহ হওয়ায় সে পিছু নেই তার এবং বাহির হওয়ার ঠিক আগে তাকে আটকিয়ে দেয়। মোবাইল ফোন চেক করে মেলে লম্বা সময় ধরে চলা সেই ভিডিও। এরপর তা ডিলিট করে ছেড়ে দেয়া হয় বেচারীকে

মাইসুর প্যালেস এর দরবার হল; ফটো ক্রেডিটঃ উইকিপিডিয়া।
মাইসুর প্যালেস হতে বের হতে হতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। আমাদের টুরিস্ট বাসের সুপারভাইজার কাম গাইড মাইসুর প্যালেস এর বিপরীতে পাশের এক রেস্তোরায় সবাইকে লাঞ্চ করে নিতে বললেন। লাঞ্চের পর আমাদের গন্তব্য মাইসুর প্যালেস হতে আরও পয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের "বৃন্দাবন গার্ডেন" এর পাণে।
আসুন দেখে নেই বোকা মানুষের ক্যামেরার চোখে মাইসুর প্যালেস এর চারিপাশের কিছু ছবিঃ
আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ -TDTK (Tour D Tamilnadu & Karnataka)
পর্ব - ১১
ভ্রমণকালঃ জুন-জুলাই, ২০১৭
এই সিরিজের সকল পোস্টঃ
প্রথম পর্বঃ * আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ - শুরুর গল্প
দ্বিতীয় পর্বঃ * চলে এলাম কোদাইকানাল
তৃতীয় পর্বঃ * কোদাইকানাল "ফরেস্ট ডে ট্রিপ"
চতুর্থ পর্বঃ * কোদাইকানাল শহর ভ্রমণ
পঞ্চম পর্বঃ * কোদাইকানালের শেষদিন এর শেষটা আর ভালো হলো না...
ষষ্ঠ পর্বঃ * পাহাড়ি রাস্তায় রাতের যাত্রা - কোদাইকানাল টু কোয়িম্বেতুর
সপ্তম পর্বঃ * উটি পৌঁছে বোনাস বেড়ালাম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ "নীলগিরি রেলওয়ে"তে চড়ে "কুনুর"
অষ্টম পর্বঃ * "কুইন অফ হিলস" খ্যাত উটি ভ্রমণ
নবম পর্বঃ * শেষ রাতের আঁধারে এসে পৌঁছলুম "ব্যাঙ্গালুরু" - একাকী ফাঁকা রাজপথে
দশম পর্বঃ * টিপু সুলতান এর মৃত্যস্থল, অন্ধকূপ এবং অন্যান্য ভ্রমণ - ইতিহাসের জানা অজানায়
একাদশ পর্বঃ"মাইসোর" প্যালেস - চোখ ধাঁধানো এক নির্মাণশৈলী
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা