হ্যাপি আখন্দ * জাফর ইকবাল * শেখ ইশতিয়াক * সঞ্জীব চৌধুরী
বাংলা সঙ্গীতের গত শতকের শেষ ত্রিশ বছরে আলোচনার তুঙ্গে থাকা এমন চারজন সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে আজকের এই "ওরা চারজন - পেছনে ফিরে দেখা" সিরিজের পোস্ট যেই চারজনই অতি অল্প বয়সে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। তাদের সকলের প্রতি রইলো শ্রদ্ধাঞ্জলি।
===========================================================================
জাফর ইকবালঃ
অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী জাফর ইকবাল ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে ঢাকার গুলশানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বড় ভাই প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ এবং ও ছোট বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। সালমান শাহ্ এর পূর্ব সময়ে বাংলা সিনেমার সবচাইতে ব্যক্তিত্বের আবেদন, পোশাক, স্টাইল দিয়ে ভিন্নতর এক ইমেজে আবির্ভূত হয়েছিলেন অভিনেতা এবং সঙ্গীত শিল্পী জাফর ইকবাল। ১৯৯২ সালে পরপারে পাড়ি জমানো এই অভিনেতার শূন্য জায়গা পূরণ করতেই যেন ১৯৯৩ সালে সালমান শাহ চলচ্চিত্রে পদার্পন করেন; যদিও তাদের তুলনা কোন পরিমাপের স্কেলেই চলে না। গানের চর্চাটা ছিলো সেই শৈশব থেকেই। এলভিস প্রিসলি ছিল তার প্রিয় তারকা। স্কুলে কোনো ফাংশন হলে তিনি গিটার বাজিয়ে প্রিসলির গান গাইতেন। আর সেই পথ ধরেই ভাইবোনের মতো জাফর ইকবালও প্রথমে গানের ভুবনেই যাত্রা করেছিলেন গায়ক হিসেবে। ১৯৬৬ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুককে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড গ্রুপ ‘রোলিং স্টোন’। ‘পিচ ঢালা পথ’ ছিল ব্যান্ড গড়ে তোলার পর তার প্রথম গাওয়া গান। বড় ভাই সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘বদনাম’ ছবির ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ গানটি দিয়ে প্লেব্যাকে তার অভিষেক হয়েছিল। তার গাওয়া শ্রোতা প্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ ইত্যাদি। ১৯ ৮০র দশকে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে তার একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদযাপন অনুষ্ঠানে ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি গেয়েছিলেন জাফর ইকবাল। পরে রফিকুল আলমও এই গানটি গেয়েছিলেন। অভিনেতা জাফর ইকবাল ১৫০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, যার বেশিরভাগই ছিল ব্যবসা সফল। মদ্যপানসহ অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের ফলে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন যার দরুন তার হার্ট এবং কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ৮ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
===========================================================================
হ্যাপী আখন্দঃ
হ্যাপি আখন্দ ১৯৬৩ সালের ১২ই অক্টোবর ঢাকার পাতলা খান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবাও ছিলেন একজন সুরকার ও সংগীতপ্রেমী মানুষ যার কারনে ছোটবেলা থেকেই সংগীতের আবহে বড় হয়েছেন হ্যাপী। মাত্র আট বছর বয়সে তবলা শেখার মাধ্যমে সংগীতের ভুবনে পথচলা শুরু হয় হ্যাপী আখন্দের। আর মাত্র ১০ বছর বয়সে তার হাতে গিটারের তাল ধরা দেয়। শুরুর দিকে হ্যাপী আখন্দ ভাই লাকী আখন্দের সাথে বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিতেন তবলা বাজানোর জন্য। একে একে দক্ষতা অর্জন করেন পিয়ানো, কি–বোর্ড, ড্রামস সহ সংগীতের নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রে।
স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন হ্যাপী। ‘স্পন্দন’ ব্যান্ডের সঙ্গে কিছুদিন বাজিয়েছেন। সে সময় আজম খান ও লাকী-হ্যাপী আখান্দ ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত মিউজিশিয়ান। আজম খানের সঙ্গে টিএসসির কনসার্টেও বাজিয়েছেন তিনি। হ্যাপী তখন ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ ব্যান্ডেও গাইতেন-বাজাতেন। এই ব্যান্ডের পূর্বনাম ছিল ‘আইওলাইটস’, যাদেরকে স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড বলা হয়। কিছুদিন পর ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ ভেঙে গেলে ১৯৭৩ সালে লাকী এবং হ্যাপী আখন্দ ভাইয়েরা মিলে তৈরী করেন “হ্যাপিটাচ” নামক ব্যান্ড যা টিকে ছিলো ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৭৯ সালে ‘মাইলস’ ব্যান্ড এর যাত্রাকালে এর সাথে ছিলেন হ্যাপী আখন্দ। এর বাইরে হ্যাপী আখান্দ নিয়মিত পারফর্ম করতেন তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে।
হ্যাপি আখন্দের গাওয়া জনপ্রিয় গান হলো ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘কে ওই যায়রে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘খোলা আকাশ’, ‘তুমি কি দেখছ পাহাড়ি ঝরনা’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা’, ‘স্বাধীনতা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তাঁর সংগীত আয়োজনে ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া ‘এমন একটা মা দে না’, প্রয়াত ফিরোজ সাঁইয়ের গাওয়া ‘ইশকুলখুইলাছে রে মাওলা’ গানগুলো ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। হ্যাপি আখন্দকে বাংলাদেশী সঙ্গীতের বরপুত্র বলা হত। তিনি আর ডি বর্মণ,আববাসউদ্দীন, মান্না দে, সমর দাশের মতো সংগীতজ্ঞের প্রশংসা আর স্নেহ অর্জন করেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। ২৮ শে ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত হন এই অমিত প্রতিভাধর সঙ্গীতজ্ঞ।
===========================================================================
শেখ ইশতিয়াকঃ
১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্ম এই গুণী শিল্পীর, শৈশব থেকেই যার পথচলা শুরু সংগীতের ধ্রুপদী পথে। ছোটবেলা থেকেই গানটাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। গান যেমন গাইতে পছন্দ করতেন, তেমনি পছন্দ করতেন গিটার বাজাতে। আর এসবের ফলশ্রুতিতেই সুর ও সঙ্গীতায়োজনের প্রচেষ্টা ছিল ছোটবেলা থেকেই। ১৯৭৪ সালের দিকে, মাত্র ১৪ বছর বয়সেই প্রথম ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন তিনি যার নাম রাখলেন ‘সন্ন্যাসী’। বিভিন্ন মঞ্চে, হোটেলে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গান করতে থাকে সন্ন্যাসী আর একই সাথে ধীরে ধীরে গিটারিস্ট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন শেখ ইসতিয়াক। সত্তরের দশকে লাকী আখন্দ, হ্যাপী আখন্দদের সাথে কাজ করেছেন শেখ ইশতিয়াক। ১৯৮৬ সালে মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে তার প্রথম এ্যালবাম “নন্দিতা” প্রকাশ পায় যা সেই সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। সেই এ্যালবামের ‘নীলাঞ্জনা’, ‘টিপ টিপ বৃষ্টি’, ‘একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি’, ‘আমার মনের ফুলদানিতে’ গানের মত গানগুলো আজও শ্রোতা মহলে সমান জনপ্রিয়। ১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এই সুরেলা কন্ঠের জনপ্রিয় গায়ক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোট ০৭ টি এ্যালবাম প্রকাশিত হয় শেখ ইশতিয়াক এর।
===========================================================================
সঞ্জীব চৌধুরীঃ
সঞ্জীব চৌধুরী ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গোপাল চৌধুরী এবং মাতা প্রভাষিনী চৌধুরী। নয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। ছোটবেলায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ও এরপরে ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হন ও এখান থেকে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন৷ তিনি একজন খ্যাতনামা সাংবাদিকও ছিলেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনে কাজ করেন। তিনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন।
১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলায় তিনি “মৈনাক” নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। গতানুগতিক ধারার বাইরে ব্যতিক্রমী কিছু গান করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৫ সালে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দলছুট’। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘আকাশচুরি’, ‘জোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ব্যান্ডের বাইরে ‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’ অ্যালবামটি সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্থে প্রকাশ পায় যেখানে তাঁর লেখা কবিতাগুলোর সংকলিত ছিল। ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর ৪৭তম জন্মদিনে ‘সঞ্জীব উৎসব’ পালনের মধ্য দিয়ে “আয় আমন্ত্রণ’ নামক ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অ্যালবামটি প্রকাশিত হয় যেই অ্যালবামের ‘নতজানু’ নামে গানটি সঞ্জীব চৌধুরীর নিজের লেখা সর্বশেষ গান।
সঞ্জীব চৌধুরী বাইল্যাটারাল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নভেম্বর ১৫, ২০০৭ সালে আকস্মিকভাবে অসুস্থ বোধ করার কারণে তাঁকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। তিন দিন পর নভেম্বর ১৯ তারিখে আইসিইউ শাখায় সঞ্জীব চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
লেখা ও তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া বাংলা
দ্যা ডেইলি স্টার
জাগো নিউজ
দৈনিক প্রথম আলো
দৈনিক যায় যায় দিন
এই সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ
(০১) Four Handsome, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
(০২) Four Beautiful Ladies, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
(০৩) নব্বই এর বাংলা নাটক হতে উত্থান যে চার তারকার (ওরা চারজন - (পেছনে ফিরে দেখা) (পর্ব ০৩))
নব্বই এর বাংলা নাটক হতে উত্থান যে চার নজরকাড়া অভিনেত্রীর (ওরা চারজন - (পেছনে ফিরে দেখা) (পর্ব ০৪))
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:২১