আশির দশকের শেষাংশ হতে শুরু করে নব্বই এর দশকের প্রায় পুরোটা সময় বাংলা টেলিভিশন নাটকের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিলো। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় হতে ঘরে ঘরে ডিশ এন্টেনা তথা কেবল নেটওয়ার্কের কারনে ধীরে ধীরে ভিন্ন দেশীয় এবং ভিন্ন ভাষার চ্যানেলগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলে অনেকটাই থমকে যায় সেই জয়যাত্রা। তবে সেই সময়ের অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয়ের রেশ দর্শক হৃদয়ে রয়ে গেছে অনেক অনেকটা সময় ধরে, যা আজো সেই সময়কার দর্শকদের নস্টালজিক করে তোলে। ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা) সিরিজের আজকের পর্ব থাকছে সেই সময়ের চার নাট্য অভিনেত্রীকে নিয়ে, সকলের প্রিয় চারমুখ শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, আফসানা মিমি এবং বিজরি বরকতুল্লাহ'কে নিয়ে। যদিও এই তালিকায় চতুর্থ পজিশনে এর চাইতে বেটার কেউ আমার দেখামতে সেই সময়ে ছিলো না সেই প্রজন্মের অভিনেত্রীদের মধ্যে, তাই আমার পছন্দ বিজরি বরকতুল্লাহ'কে চতুর্থজনা হিসেবে।
তো আসুন শুরু করি আজকের পোস্টঃ
===========================================================================
শমী কায়সার
১৯৭০ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার এবং সদ্য প্রয়াত ঔপন্যাসিক, গবেষক ও জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদএর সংসারে শমী কায়সার এর জন্ম। ১৯৮৯ সালে এইচএসসি শেষ করে স্থাপত্যকলায় পড়ার প্রস্তুতি চলাকালে তিনি আতিকুল হক চৌধুরীর “কেবা আপন কেবা পর” নাটক দিয়ে টিভি পর্দায় নাটকের পথচলা শুরু এই গুণী অভিনেত্রীর। এরপর তিনি ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস অবলম্বনে এবং আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় তিন পর্বের ধারাবাহিক নাটক “যত দূরে যাই” নাটকের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের দর্শকের মনে আসন গড়তে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘স্পর্শ’, ‘অরণ্য’, ‘আকাশে অনেক রাত’, ‘মুক্তি’, ‘অন্তরে নিরন্তরে’, ‘স্বপ্ন’, ‘ঠিকানা’ সহ শতাধিক টিভি নাটোকে অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী। শমী কায়সারের অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল ঢাকা থিয়েটারে যেখানে তিনি ১২ বছর কাজ করেছেন। এর বাইরে লালন (২০০৪), হাছন রাজা, চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের জীবনী নিয়ে নির্মিত ‘দ্য নেম অব এ রিভার (২০০২)’ সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। এর বাইরে এছাড়া শমী কায়সার প্রযোজক হিসেবে ১৯৯৭ সালে তার নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ধানসিড়ি প্রোডাকশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে নভেম্বরে তার প্রতিষ্ঠান, ধানসিড়ি কমিউনিকেশন লিমিটেড, রেডিও অ্যাক্টিভ নামে একটি বেতার কেন্দ্রের জন্য লাইসেন্স পায়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) ২০১৭-১৯ মেয়াদের নির্বাচনে জয়ী হন শমী কায়সার। ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৯৯ সালে ভারতীয় নির্মাতা রিঙ্গোকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তখনকার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার; তবে মাত্র দুই বছর আয়ু ছিল এই দাম্পত্য জীবনের।পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর তারিখে শমী কায়সার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আরাফাত এ রহমানকে বিয়ে করেন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিয়েও টিকে নাই। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি বিয়ে করেন র্যাং গস গ্রুপের প্রাক্তন কর্মকর্তা এবং বর্তমানে গ্রুপ ফোর দুবাই এ কর্মরত রেজা আমিন সুমনকে। সম্প্রতি সরকারী অনুদানে নির্মিত একটি সিনেমার প্রযোজন হিসেবে আবার অভিনয় জগতে ফিরছেন এই এককালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী।
===========================================================================
বিপাশা হায়াত
বরেণ্য টেলিভিশন অভিনেতা আবুল হায়াত এবং মাহফুজা খাতুন শিরিন এর সংসার আলো করে ২৩ মার্চ, ১৯৭১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন জনপ্রিয় টিভি এবং চলচ্চিত্র অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত। প্রথমে ইডেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতক পাশ করা বিপাশা হায়াত এর অভিনয় এর শুরুটা ছিলো ১৯৮৩ সালের দিকে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বিটিভিতে ‘খোলা দুয়ার’ শীর্ষক একটি নাটক প্রচারিত হবে যেখানে মূল চরিত্রে ছিলেন আবুল হায়াত এবং তার মেয়ের চরিত্রে ১২-১৩ বছরের একজনকে প্রয়োজন।সেই নাটকের নাট্যকার ছিলেন মামুনুর রশীদ এবং প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। তো সেই নাটকে আবুল হায়াতের মেয়ের চরিত্রে হাতের কাছে পাওয়া গেল যে মেয়েকে তিনি সত্যিই আবুল হায়াতেরই মেয়ে, বিপাশা হায়াত। ১৯৮৫ সালেই মঞ্চ নাটকে যাত্রা শুরু করেন বিপাশা হায়াত ‘নাট্য সম্প্রদায়’ দলের সাথে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন এরী হিসেবে নিবন্ধিত হন। হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকে ‘লবঙ্গ’ চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান এই গুণী অভিনেত্রী। এরপর একে একে অভিনয় করেন ‘রূপনগর’, ‘হারজিত’, ‘একজন অপরাধিনী’, ‘নাইওরি’, ‘ছোট ছোট ঢেউ’, ‘প্রত্যাশা’, ‘দোলা’, ‘হাসুলি’। বিটিভি’র নিজস্ব প্রযোজনার বাইরে প্যাকেজ নাটক শুরু হলে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন বিপাশা হায়াত। এর বাইরে বিপাশা হায়াত অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও, বিশেষ করে তার অভিনীত দুটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র, ‘আগুনের পরশমণি’এবং ‘জয়যাত্রা’। এরমধ্যে হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। অভিনয়ের বাইরে নাট্যকার হিসেবেও বেশ সফল বিপাশা হায়াত, তার লেখা নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘ভালোবাসা জেগে থাকে প্রাণে’, ‘ডাইনোসর’, ‘মরা জোছনা’, ‘মধ্যরাত ও ঝরা পাতার গল্প’, ‘ছায়া’, ‘এ কী খেলা’ সহ প্রায় অর্ধশত জনপ্রিয় নাটক। চিত্রশিল্পী, অভিনেত্রী, নাট্যকার এর বাইরে পরিচালক, আবৃত্তিশিল্পী, গায়িকা হিসেবেও দেখা মিলেছে বিপাশা হায়াত এর। ব্যক্তিগত জীবনে নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির আহমেদে এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯৭ সালে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সুখেই আছেন এই দম্পতি। প্রকৃতির এক নিপুন ছোঁয়ায় তৈরি “নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট” নামক রিসোর্ট ব্যবসা রয়েছে তৌকির আহমেদ ও বিপাশা হায়াত এর যা তাদের স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছেন তারা। বর্তমানে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করছেন ছেলেমেয় নিয়ে বিপাশা হায়াত।
===========================================================================
আফসানা মিমি
বাবার সৈয়দ ফজলুল করিম এবং মা শিরীন আফরোজ এর সংসারে আফসানা মিমির জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে। ১৯৯০ সালে বাংলা টেলিভিশনে হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত আলোচিত এবং বিখ্যাত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ এ বকুল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু টেলিভিশন নাটকে। আফসানা মিমি অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে নক্ষত্রের রাত, বন্ধন, সবুজ সাথী, বেদনার রং নীল, শেষ চিঠির পরে, বিবর্ণ ভালোবাসা, ঝিনুক নীরবে সহো, নাটের গুরু, বউ কথা কও, এবং বনলতা সেন, অন্তরায়, অফবিট, অতিক্রম, বোকাট্টা, ভালোবাসার তিন বেলা ইত্যাদি। মিমি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। মিমির মডেলিং যাত্রাই তাকে শোবিজে পরিচিত করে তোলে প্রথমত। অসাধারণ সব বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন এই অভিনেত্রী যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘মেরিল ট্যালকম পাউডার, লাক্স বিউটি সোপ, মেরিল বিউটি সোপ, ফিনলে চা’ ইত্যাদি। অভিনেত্রী মিমি পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত সফল রূপে ধরা দিয়েছেন টেলিভিশন নাট্য জগতে। তার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে কাছের মানুষ, ডলস হাউজ, পৌষ ফাগুনের পালা, গৃহগল্প ইত্যাদি। আফসানা মিমি নাটকের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। ১৯৯২ সালে ‘ছুটির ঘণ্টা’-খ্যাত নির্মাতা আজিজুর রহমানের ‘দিল’ নামে একটি ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। সহশিল্পী ছিলেন নাঈম-শাবনাজ। পরবর্তীতে ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘চিত্রা নদীর পারে’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘বিহঙ্গ’, ‘লিলিপুটরা বড় হবে’, ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ ‘পাপপুণ্য’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে। ইদানীং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বেশ আলোচিত ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে ফের আলোচনায় এসেছেন আফসানা মিমি। ব্যক্তিগত জীবনে ‘ব্যতিক্রমী’ নামে একটি নাট্যদলে কাজের সময় অভিনেতা গাজী রাকায়েতের সাথে পরিচয় ঘটে মিমির এবং পরবর্তীতে প্রেম ও বিয়ে হয়। যদিও বেশিদিন সংসার টেকেনি তাদের, ১৯৯৬ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
===========================================================================
বিজরি বরকতুল্লাহ
বাংলাদেশ টেলিভিশন এর বিখ্যাত পরিচালক এবং প্রযোজক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এবং প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী জিনাত বরকতুল্লাহ এর বড় মেয়ে বিজরী বরকতুল্লাহর জন্ম জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৭২ কুমিল্লায়। খুব ছোটবেলায় মায়ের কাছে তার নাচের হাতেখড়ি এবং সেই পথ ধরেই মাত্র আড়াই বছর বয়সে বিটিভি তে নাশিদ কামালের উপস্থাপনায় ‘মাকে নিয়ে’ নামে ছোটদের একটি অনুষ্ঠানে শিশুশিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে টিভি পর্দায় নাম লেখান বিজরী। ভিখারুননেসা স্কুল এন্ড কলেজ এর আঙ্গিনায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন বিভাগে সম্পন্ন করেন নিজের উচ্চশিক্ষা জীবন। ১৯৮৮ সালে বিটিভির ‘সুখের ছাড়পত্র’ নামের একটি নাটকে শখের বশে অভিনয় করেন বিজরী বরকতুল্লাহ যার পরিচালক ছিলেন তার বাবা স্বয়ং। এরপর নাটকের প্রেমে পড়ে যান তিনি, নিয়মিত অভিনয় করতে থাকেন বিটিভির নাটকে। আলোচনায় আসেন হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে ইরা নামের ছোট্ট একটা চরিত্রে অভিনয় করে। অভিনয়ের পাশাপাশি নাচ এবং মডেলিংয়েও সমান জনপ্রিয়তা এবং সফলতা পান বিজরী বরকতুল্লাহ। ১৯৯৬ সালে সুরকার শওকত আলী ইমন এর সাথে তার বিবাহ হয় এবং ২০১২ সালে এসে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বিজরী অভিনেতা ইন্তেখাব দিনার এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে সুখের ছাড়পত্র, কোথাও কেউ নেই, মেঘ কালো, কর্পোরেট, মুখ ও মুখরতা, চোরাকাটা, বাতিঘর, অতিক্রম, কালান্তর, জন্ডিস, বিশ্বাস ইত্যাদি। এর বাইরে ‘আয়নাবাজি’, ‘কারাগার’, ‘যদি আমি বেঁচে ফিরি’ সিনেমা এবং ওয়েবসিরিজে তাকে অভিনয় করতে দেখা গেছে।
এই সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ
(০১) Four Handsome, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
(০২) Four Beautiful Ladies, বাংলাদেশী মডেলিং জগতে যাদের তুলনা ছিল শুধুই তারা - ওরা চারজন (পেছনে ফিরে দেখা)
(০৩) নব্বই এর বাংলা নাটক হতে উত্থান যে চার তারকার (ওরা চারজন - (পেছনে ফিরে দেখা) (পর্ব ০৩))
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৬