রাত পোহানোর পরে
কেবিনের থাইগ্লাসের উপর মোটা পর্দা থাকা সত্ত্বেও সূর্যের আলো তীব্রভাবে চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে নিলাম সময়টা, এখনো ছয়টা বাজে নাই। পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দিতেই জলে প্রতিফলিত সূর্যরশ্মির কোমল আলোর সাথে একরাশ শীতল হাওয়া কেবিনে ঢুঁকে দেহমনে ছুঁয়ে গেল। নিদ্রাজনিত আলস্য ঝেড়ে ফেলে কেবিন হতে বের হয়ে তিনতলায় চলে এলাম। আমাদের প্রমোদতরী এখন মংলায় অবস্থান করছে। কিছুটা দূরেই কিছু পণ্যবাহী জাহাজ নোঙ্গর করে আছে। প্রভাতের এই সময়টা দারুন উপভোগ্য লাগছে। রেস্টুরেন্টে তিনজন ছেলে গোছগাছ করছে, তাদের কাছে এগিয়ে গেলাম চায়ের খোঁজে। এমন পরিবেশে এককাপ চা হলে দারুণ হয়ে। কিন্তু সেখান হতে জানা গেল নীচে কিচেনে রঙ চা করা আছে, নীচে নেমে এসে ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম কিচেনে। এককাপ রঙ চা নিয়ে ফের তিনতলার খোলা অংশের রেলিং এর ধারে সূর্যালোকের চাদরে জড়িয়ে বসে গেলাম। নির্জনতা’র আলাদা একটা রূপ আছে, সেই রূপ উপভোগ করার সুযোগ আমাদের এই যান্ত্রিক শহুরে জীবনে তেমন একটা মেলে না। বহুদিন পর এই সকালবেলার নির্জনতা উপভোগ করতে লাগলাম।
অনেকটা সময় এই আবেগী বিলাসিতায় কাটিয়ে ফের কেবিনে ফিরে এসে তৈরী হয়ে নিলাম। সাড়ে সাতটা নাগাদ দেখা মিললে ইঞ্চিন বোটে করে আবু বকর ভাই তার গেস্টদের নিয়ে চলে এসেছেন। প্রমোদতরী’র উপর থেকে হাত নেড়ে তাদের স্বাগতম জানানোর সাথে দলটাকেও দেখে নিলাম। জনা ত্রিশের দল, সবার বয়স ৫৫’র আশেপাশে, একটা সময় এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ছিলেন। বহুবছর পর গেট টুগেদার হচ্ছে, সুন্দরবন ট্যুর এ। প্রত্যেকেই একা এসেছেন, ফ্যামিলি নিয়ে নয়; কারণ আর কিছুই নয়, পুরানো বন্ধুবান্ধবদের সাথে একান্ত কিছুটা সময় কাটানো, স্মৃতি রোমন্থন আর প্রাণ খুলে আনন্দ’র মাঝে বুঁদ হওয়া। একে একে সবাই প্রমোদতরী’তে উঠে এলে প্রথমেই সবাইকে রুম বন্টন করে দেয়া হল। যার যার রুমে চলে গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে সবাইকে তিনতলার রেস্টুরেন্ট তথা খাবার হল এ চলে আসতে বলা হল। গেস্টদের সাথে দু’জন বনরক্ষী’ও এসেছে; যা সুন্দরবন ট্যুর এ বাধ্যতামূলক। যদিও কথা বলে জানলাম, উনাদের প্রায় কেহই বাঘ এর সম্মুখ হন নাই, সাথে থাকা অস্ত্রের ব্যবহার তো দূরের কথা। তারপরও প্রতিটি সুন্দরবন ট্রিপে সরকারী কোষাগার এ অর্থ প্রদান পূর্বক উনাদের সাথে নেয়া বাধ্যতামূলক। আমাদের এই ট্যুর এ যে দুজন বনরক্ষী ছিলেনা, তাদের একজন এর আচার আচরণ এ ভীষণ বিরক্ত হয়েছি; মাঝে মাঝে মন চেয়েছে… থাক বললাম না নাহয় আর তা। সেই বনরক্ষী’র কাজ ছিল, সারাক্ষণ খাবার এর সামনে ঘোরাঘুরি, থালা ভরে খাওয়া এবং সুযোগ পেলে কিছু খাবার পকেটে করে সরিয়ে ফেলা, গেস্টরা নিজেরা গল্প করছে এমন আসরে মাঝখানে গিয়ে বসে পড়া অথবা দাঁড়িয়ে থাকা। দ্বিতীয় দিন তার এহেন আচরণ নিয়ে সরাসরি অসন্তোষ প্রকাশ করলে, উনার কথা শুনে ভিরমি খেতে হয়েছিল, উনি নাকি চাইলে সুন্দরবন এ পর্যটকদের আগমন বন্ধ করে দিতে পারেন… হাসতে হাসতে মূর্ছা গেলাম…
সবাই সময়মত তৈরী হয়ে নাস্তার টেবিলে চলে আসলে পরে শুরু হল নাস্তা পর্ব। এদিন সকালের নাস্তায় ছিল পাউরুটি, জেলি, মাখন, মধু, পরাটা, ডিমভাজা, মিক্সড সবজি, মুগডাল। সাথে চা-কফি। সবজিটা খুব সুস্বাদু ছিল, একমাত্র সবজি আইটেমটাই একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল। নাস্তা পর্ব শেষে সবাই চা-কফি নিয়ে প্রমোদতরী’র চারিধারে আয়েশে বসে গল্পের আসর জুড়ে দিল। এরই মধ্যে আমাদের প্রমোদতরী যাত্রা শুরু করে দিয়েছে সুন্দরবনের দিকে। প্রথম গন্তব্য হাড়বাড়িয়ে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। খাবার-দাবার পর্ব শেষ হলে গেস্টদের নিজস্ব ইভেন্ট শুরু হল; এটি ছিল খুবই মজার। তাদের নিজস্ব স্লোগান সম্বলিত টি-শার্ট প্রদান পর্ব; কিন্তু সেখানে বিতরণ হল “চাড্ডি-বানিয়ান”। দেখে খুব মজা লাগলো, এই মধ্য বয়সের শেষে এসেও বালকসুলভ উৎফুল্লতা। ঘটনাক্রমে আমি হয়ে গিয়েছিলাম এই ট্যুরে ফটোগ্রাফার। আমাকে ডেকে তাদের এই “চাড্ডি-বানিয়ান” বিতরণ কার্যক্রম এর ছবি তুলতে বললেন। তাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম মজাদার কর্মকান্ড উপভোগ করলাম। সবশেষে আমাকে আর আবু বকর ভাইকেও এই “চাড্ডি-বানিয়ান” প্রদান করা হল; কিছুটা অবাক হলেও ভালো লেগেছে। এরপর সবাই মিলে তিনতলার খোলা জায়গায় চেয়ার পেতে গল্পে মসগুল হয়ে পড়লেন আর প্রমোদতরী এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
একটু ঘোরাঘুরি
বেলা সোয়া এগারোটার কিছু আগে আমরা পৌঁছে গেলাম হাড়বাড়িয়া। পাড় হতে কিছুটা আগে আমাদের প্রমোদতরী নোঙ্গর ফেললে আমরা সবাই প্রমোদতরী’র সাথে থাকা ইঞ্জিন নৌকায় করে হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র এর জেটিতে গিয়ে নামলাম। খুলনা থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে এই হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। হাড়বাড়িয়া সংলগ্ন ক্যানেল অভয়ারণ্য; প্রায়শই কুমির দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময় বাঘের কাঁচা পায়ের ছাপও দেখা যায়। আমি ২০১২ সালে সুন্দরবন ভ্রমণে পেয়েছিলাম তা। এখানে অনেক সময় মায়া হরিণের আনাগোনাও পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র’র প্রবেশমুখেই দেখতে পাবেন নামফলক এবং এর থেকে একটু এগিয়ে গেলে হাতের বামপাশে বন বিভাগের কার্যালয়। তা থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে একটি খাল রয়েছে এবং এই খালের উপর রয়েছে একটি ঝুলন্ত সেতু যা এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিকট একটি চিত্তাকর্ষক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মরণে খনন করা হয় এই খাল খনন করা হয়। খালের উপরের ঝুলন্ত সেতুর মাঝখানে গোলপাতার ছাউনি দেয়া একটি বিশ্রামাগার রয়েছে, সেখানে বেঞ্চি পাতা আছে, পর্যটকদের বসার জন্য। আমরা যখন গেলাম, পুরো খালটি লাল শাপলায় ছেয়ে ছিল। খালের গাঁ ঘেঁষে দুটি পথ চলে গেছে। আমরা ডানের পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। এই পথ দিয়ে বন ক্রমশ গভীর হয়েছে। কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে একটি “ওয়াচ টাওয়ার” এর; যা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নড়বড়ে এই “ওয়াচ টাওয়ার” এর সামনে থেকে কাঠের তৈরী হাঁটাপথ শুরু হয়েছে, এই ট্রেইল প্রায় এক কিলোমিটার এর কিছুটা বেশী দীর্ঘ। এই পথ দিয়ে সবাই সারি বেঁধে হাঁটতে শুরু করলাম। চারিদিকের বুনো পরিবেশ এবং নিস্তব্ধতার মাঝে আমাদের নিজেদের মধ্যে বলা কথা বড়ই বেমানান লাগছিল। কিন্তু সব সময়ই দেখা যায়, আমরা মানুষেরা একত্রে নিশ্চুপ থাকতে পারি না…
বেলা বারোটা নাগাদ আমরা ফিরে এলাম আমাদের প্রমোদতরী’তে। এসময় হালকা নাস্তা পরিবেশন হল, প্লেইন কেক আর ছানা মিষ্টি; সাথে চা-কফি। এরপর গোসল-নামাজ এবং বিশ্রাম এর পালা। বেলা দুইটা নাগাদ পরিবেশন করা হল দুপুরের খাবার। মেন্যু ছিলঃ সাদাভাত, আলু ভর্তা, শিম ভর্তা, পালংশাক গুড়াচিংড়ি, লাউ গুড়াচিংড়ি, টমেটো দিয়ে রান্না করা কোরাল মাছের ঘন ঝোল, দেশী মুরগীর কারি, ডাল, সালাদ। খাবার দাবার শেষ করে যে যার মত অলস সময় কাটানো, চাইলে কেবিন এ গিয়ে ভাতঘুম দেয়া। আমি কেবিনে না গিয়ে রেস্টুরেন্ট এর একেবারে সম্মুখ এর দিকের জানালার পাশে ক্যামেরা নিয়ে বসলাম, কিছু ছবি তোলা যাক। আর যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে কুমিরের দেখা মিলে যেতে পারে। শীতের এই সময়টায় দুপুরের পর তীরে শুয়ে থেকে রোঁদ পোহাতে দেখা যায় সুন্দরবনের কুমিরদের। দুপুরের এই সময়ে এক কাপ কড়া কফি খেতে পারলে মন্দ হত না। খাবার পরিবেশনে থাকা বছর পঁচিশের একটা ছেলেকে ডেকে বলতেই, সে বেশ সময় নিয়ে আমার জন্য দারুণ একটা কফি বানিয়ে নিয়ে এল। তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেই কফি পান করছিলাম… হুট করে ক্যামেরার জুমে দেখি সবুঝের মাঝে হলুদ কিছুর নড়াচড়া! তবে কি তিনি এলেন দেখা দিতে… নাহ, দেখা গেল হরিণ এর দলের দু’চারজন সদস্যকে। ক্যামের ফের জুম করতে গিয়ে দেখি তীরের কাঁদায় রোদ পোহাচ্ছে তাগড়া এক কুমির… প্রমোদতরী’র চালকের চোখও ফাঁকি দিতে পারে নাই। ফলে কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হল প্রমোদতরীটিকে। সবাই ব্যস্ত ছবি তুলতে। যারা যারা ভাতঘুম দিতে কেবিনে ছিল তারা মিস করলো…
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
এরপর ছিল শেষ বিকেলে ক্যানেল ট্রিপ। সুবিধামত একটি ক্যানেলের মুখে নোঙ্গর করলো আমাদের প্রমোদতরী; সবাই মিলে ইঞ্চিন নৌকায় চড়ে যাত্রা করলাম সরু ক্যানেলের পথে। কিছুক্ষণ চলার পর এক সময় ইঞ্চিন বন্ধ করে দেয়া হল। দুই ধারে গোলপাতা, সামনে সরুখাল এগিয়ে গেছে, জলের উপর উড়ছে সাদা বক, আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ এই শেষ বিকেলে। সবাইকে নিশ্চুপ থাকতে বলা হলেও, মিনিট দুই এর মাঝেই সবাই যেন হাঁপিয়ে উঠলো কথা না বলার যন্ত্রনায়! বেশ কিছুটা সময় ক্যানেল ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যার লগণে ফিরতি যাত্রা। প্রমোদতরী’র কাছে এসে গোধূলিবেলায় সুন্দরবনের অপার্থিব সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকা, অবাক করা সৌন্দর্যকে ক্যামেরা বন্দী করার ব্যর্থ প্রয়াস…
এরপর সবাই প্রমোদতরী’তে ফিরে এলে ফের চলতে শুরু করলো আমাদের প্রমোদতরী “উৎসব”, গন্তব্য কটকা। সন্ধ্যার পর নাস্তা ছিল চিকেন ফ্রাই আর কর্ণ স্যুপ; সাথে অতি অবশ্যই চা-কফি। আকাশে বিশাল পূর্নিমার চাঁদ নিয়ে এরপর নিজেদের মধ্যে গল্পের পালা। রাত সাতটা নাগাদ গেস্টদের একান্ত নিজস্ব কিছু আয়োজন; তাদের অনুরোধে আমি এবং আবু বকর ভাই প্রমোদতরী’র সকল স্টাফ এবং বনরক্ষীদ্বয়’কে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। আমাদের কেবিনে এসে আমি কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম, আয়োজক হিসেবে আবু বকর ভাই তার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। এরপর রাত নয়টার পরে শুরু হল রাতের খাবার এর আয়োজন। ফিশ এন্ড চিকেন বারবিকিউ এর সাথে মিক্সড ভেজিটেবল ফ্রাইড রাইস, লুচি, আলু দিয়ে গরুর মাংস, ডালভুনা, ফ্রুট সালাদ এবং সফট ড্রিংকস। এরপর আজ আর তেমন কাজ ছিলো না শুধু অনেকটা সময় প্রমোদতরী’র বাতি নিভিয়ে দিয়ে চন্দ্রালোকে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া….
আগের পর্বঃ বহুদিন পর ভ্রমণে, শুরু সুন্দরবনে (প্রথমাংশ)
মধ্যাংশের সংশ্লিষ্ট গুটি কয়েক স্থিরচিত্রঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:০০