পুরাতন ঢাকার চকবাজারস্থ চুড়িহাট্টা'র অগ্নিকান্ড ট্রাজেডির আজ চারদিন পার হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে নানান সরকারী দফতর এবং প্রশাসন থেকে প্রাথমিক তদন্ত শেষে অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত এবং ব্যাপকতার জন্য নানান কারন জানা যাচ্ছে, যেগুলো একটির সাথে আরেকটির গড়মিল দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে উক্ত এলাকার হোটেল এবং আবাসিক ভবনের বাইরের দিকে কভার করা সিসি টিভি ফুটেজ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ গণমাধ্যমেও। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী সহ যারা উক্ত এলাকায় ঐ মূহুর্তে উপস্থিত ছিলেন অথবা অনুপস্থিত ছিলেন তাদেরও বক্তব্য আমরা দেখছি নানান মিডিয়ায়। সব চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রকৃত কারন শনাক্তকরণ জরুরী বলে মনে করি। এই ব্যাপারে প্রতিটি বিষয় নিয়েই সরকারকে ভাবতে হবে, নিতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপ। কিন্তু আজ বিভিন্ন টেলিভিশন নিউজ দেখে যেটা প্রতিয়মান হল, পুরাতন ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন নিয়েই সবার আলোচনা যার ফাঁক গলে গৌণ হয়ে যাচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এর ভূমিকাটি। সাদা চোখে এই দুটো মূল কারণ ছিল এত বেশী হতাহত হবার পেছনে। কিন্তু এর সাথে আরও কিছু কারণ ছিল যেগুলোকে আপনি অবহেলা করতে পারবেন না।
এই পর্যন্ত নানান সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে অগ্নিকান্ডের যে বাস্তবিক এবং নিরপেক্ষ চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় তা এরকমঃ
"ওয়াহেদ ম্যানসন" সংলগ্ন রাস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার বিপণনকারী গাড়ীতে থাকা সিলিন্ডারে প্রথম বিস্ফোরণটি হয়। তা থেকে আগুন ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। সেই আগুনেই আরকেটি বিস্ফোরণ ঘটে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারে। এই দুটোর যুগপৎ আগুনে রাস্তায় থাকা গাড়ীগুলোতেও আগুন এবং বিস্ফোরণ হয়। সেই আগুনে আগুনের সূত্রপাত হয় "ওয়াহেদ ম্যানসন" এর দোতলায় থাকা গোডাউনে। সেখানে ছিল আপাত নিরহ বডি স্প্রে'র বিশাল গোডাউন। এই বডিস্প্রে কন্টেইনার নিজেও একটি দাহ্য এবং বিস্ফোরণ সক্ষম। এই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পরে উক্ত ভবনের অন্যান্য জায়গায়। এবং সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে যখন ভবনের ছাঁদে থাকা ড্রাম ভর্তি রাসায়নিক দ্রব্যে ছড়িয়ে পরে এই আগুন।
এই দৃশ্যপট থেকে দেখা যাক কি কি ফ্যাক্টর এই এতবড় অগ্নিকান্ড এবং হতাহতের পেছনে জড়িত ছিলঃ
মুখ্য কারণঃ
(১) সিলিন্ডার বিপণনকারী গাড়ী হতে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত বিস্ফোরণঃ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত। এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সারাদেশে এর আগেও এই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে পুরাতন ঢাকার নারিন্দায় বেলুন ফুলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে বেশকিছু মানুষ মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়েছিল। এরপর সময়ে সময়ে গ্যাস সিলিন্ডার এর ব্যবহার বেড়েছে এবং তা ক্রমে বাড়তেই থাকবে; এটাই স্বাভাবিক (সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে)। এর সাথে বেড়েছে আবাসিক ভবনে এবং গাড়ীর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। আমাদের দেশে গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহণ এবং বিপণন কার্যক্রম দেখলে সহজেই বোধগম্য হবার কথা, কতটা ভয়াবহ বিপদঝুঁকি হাতে নিয়ে এই কর্মকান্ড হয়ে থাকে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে সারা ঢাকা শহরে তথাকথিত "মিনারেল ওয়াটার" এর জার যেভাবে পরিবহণ এবং বিপণন হয়; সেই একইভাবে প্রচন্ডরকম স্পর্শকাতর এই গ্যাস সিলিন্ডারও পরিবহণ এবং বিপণন হচ্ছে। ভারী ভারী এইসব সিলিন্ডার উঠানো নামানোর জন্য পর্যাপ্ত কোন ইকুইপমেন্ট এর ব্যবহার আজও চোখে পড়ে নাই। মেয়াদ উত্তীর্ন সিলিন্ডার এর ব্যবহার, সিলিন্ডার উঁচু স্থান হতে নীচে ফেলা, গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, নিয়মিত প্রেশার চেকআপ এবং মনিটরিং না থাকা সহ নানান অসচেতনাতা দেখা যায় এই সেক্টরে। তাই, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারনে যে কোন সময় যে কোন সুরক্ষিত এবং অগ্নি নিরাপদ স্থানেও ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হতে পারে। তাই সরকারকে অচিরেই এই ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু হতাশার সাথে লক্ষ্য করলাম, সিলিন্ডার এর এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই কোন মিডিয়ায়; যতটা দ্বিতীয় কারনটি নিয়ে সোচ্চার। আমি কারো পক্ষে বলছি না, কিন্তু ব্যাপারটি ভাবিয়েছে আমাকে। কারন? সিলিন্ডার ব্যবসার সাথে খুব বড় কিছু কর্পোরেট হাউজ জড়িত রয়েছে।
২) আবাসিক ভবনে থাকা বিস্ফোরক দ্রব্যে আগুনঃ পুরাতন ঢাকার বেশীরভাগ এলাকায় আবাসিক ভবনে গোডাউন এবং কারখানা ভাড়া দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। কি কারনে তা পরের কোন লেখায় না হয় বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আর এই গোডাউন এবং কারখানা ভাড়া দেয়ার প্রবণতার কারনে, প্রায় প্রতিটি এলাকাই রয়েছে এই ঝুঁকিতে। পুরাতন ঢাকার বিল্ডিং কাঠামো অনেকটা গলি ভিত্তিক। মূল সড়কের কিছু দূর পরপর সরুগলি চলে গেছে, যেগুলো একমূখী অর্থাৎ সেই গলির শেষ প্রান্ত যে কোন একটি ভবনে গিয়ে মিশেছে। আর এসব গলির বাড়িগুলোর মধ্যে প্রায় প্রতিটি গলিতেই কোন না কোন ভবনে গোডাউন, কারখানা ইত্যাদির দেখা মিলবে। ফলে প্রতিটি গলির প্রতিটি বাড়ীই কিন্তু রয়েছে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঝুঁকিতে। যে কোন ধরনের আগুনের সূত্রপাত হলেই বিশাল সংখ্যায় প্রাণহানী হওয়ার জোড়ালো সম্ভাবনা রয়েছে।
(৩) ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণঃ পুরাতন ঢাকার অলিগলি অত্যন্ত সরু হওয়ার কারনে প্রায় প্রতিটি গলির মাথার উপর ঝাঁকে ঝাঁকে বৈদ্যুতিক, টেলিফোন, ক্যাবল অপারেটর লাইন, ইন্টারনেট লাইন সহ নানান বিদ্যুৎ এবং অগ্নি পরিবাহী তারের জঞ্জাল দেখতে পাবেন। এর উপর, এই সরু রাস্তাগুলোতে প্রায় একদুই গলি পরপর রয়েছে "ট্রান্সফর্মার"। বেশ কয়েকবছর আগে, পুরাতন ঢাকার রহমতগঞ্জে এরকম ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছিল; ঘটনাটি আপনাদের অনেকেরই মনে থাকার কথা। মাঝে মাঝেই এইসব ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ ঘটে। এগুলো হতে যে কোন সময় এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটে যেতেই পারে।
(৪) অন্যান্য গাড়ীর বিস্ফোরণঃ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাতের সময় উক্ত রাস্তায় থাকা গাড়ী, মোটর সাইকেল গুলোতেও বিস্ফোরণ ঘটে যেগুলো থেকেও আগুন বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক।
গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আপাত গৌণ কারণঃ
(১) রাতেরবেলা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিনতাঃ আগুনের সূত্রপাতের কয়েক মিনিটের মধ্যে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরিত হয়ে বিদ্যুৎছিন্ন হয়ে অন্ধকার হয়ে যায় ঘটনাস্থল। ফলে মানুষ আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেছে।
(২) প্রাথমিক আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয় না পাওয়াঃ রাস্তায় আগুনের শিখা প্রবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে আশেপাশের দোকান এবং বাসাবাড়ীর মধ্যে আশ্রয় নেয়। এর ফলে কয়েকটি দোকান এবং বাসায় মানুষ আটকে পড়ে। এই অগ্নিকান্ডের সময় ফার্মেসীতে এবং দোকানে নিরাপদ আশ্রয় নিতে গিয়ে আটকে পড়ে নিহত হয়েছে একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ।
(৩) ঘটনাস্থলঃ চকবাজারের নিকটস্থ চূড়িহাট্টা'র যে জায়গায় বিস্ফোরণ হয়েছিল, সেটি একটি ব্যস্ততম মোড়। সেই জায়গাটা মধ্যরাত অবধি ব্যস্ত থাকে। ঘটনার সময়কালে সবচাইতে বেশী ভীড় থাকে ঐ এলাকায়।
(৪) ঘিঞ্জি রাস্তা এবং যানজটঃ ঘটনাস্থল এমন একটি জায়গা; যা চারিদিক হতে মোট পাঁচটি রাস্তার সংযোগস্থল এবং এই প্রতিটি রাস্তার কোনটিই দশ ফিটের অধিক চওড়া নয়। প্রায়শই এই জায়গাটায় যানজট লেগেই থাকে। ফলে দুর্ঘটনার সময় পথচারী এবং বিভিন্ন বাহনে জ্যামে আটকে থাকা মানুষজন এই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
============================================================================
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, পোস্টমর্টেম তো পড়লাম, জানলাম। কিন্তু এখন এই অগ্নিকান্ড থেকে শিক্ষণীয় এবং করণীয় কি? মোটাদাগে যদি বলি, তবে যা উঠে আসেঃ
(০১) গ্যাস সিলিন্ডার সহ সকল দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক পরিবহণ, বিপণন এবং বিক্রয়-মজুদের উপর সুনির্দিষ্ট এবং যৌক্তিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং শতভাগ কঠোরতার সাথে তা বাস্তবায়ন।
(০২) শুধু পুরাতন ঢাকা নয়; কোন আবাসিক এলাকায় গোডাউন-কারখানা স্থাপন বা ভাড়া দেয়া অবৈধ ঘোষনা পূর্বক আইন লঙ্ঘনে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির বিধান এবং তা কোন রকম ছাড় না দিয়ে প্রয়োগ করা।
(০৩) ঢাকা শহরের বৈদ্যুতিক ক্যাবলগুলো সহ সকল ক্যাবল আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সাথে সাথে আপাত সময়ের জন্য এগুলো পুনর্বিন্যাস করা জরুরী। আর প্রতিটি ট্রান্সফর্মার এমন জায়গায় স্থাপন করা উচিত, যাতে কোন ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ হলে তা অগ্নিকান্ডের বা প্রাণহানীর কারন না হয়ে দাঁড়ায়।
(০৪) গাড়ীতে গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপন এবং ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়া। যদিও সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, এই ব্যাপারে বিকল্প খোঁজ করতে।
(০৫) ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড সহ যে কোন দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা; পারলে বছরে একবার করে এলাকা ভিত্তিক অগ্নি নির্বাপন এবং সুরক্ষা বিষয়ে কর্মশালা বা ট্রেনিং এর আয়োজন করা।
(০৬) পুরাতন ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে সরকার পদক্ষেপ নিবে বলে ঘোষনা এসেছে এই দুর্ঘটনার পরপর। তা যেন নিমতলী ট্রাজেডি'র পর নেয়া উদ্যোগগুলোর মত কাগজে কলমে আটকে না থাকে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত পুরাতন ঢাকার রাস্তাগুলোতে যান নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ করার জন্য স্বল্প মেয়াদে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।
পাদটীকাঃ সন্ধ্যের পর থেকে রাত অবধি নানান নিউজ দেখে অবাক হয়ে গেলাম, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ সহ অন্যান্য বিষয়গুলো উঠে আসছে না দেখে। তাই ঘুমানোর আয়োজন করেও ঘুমাতে পারলাম না। তাই এই মধ্যরাত অবধি জেগে থেকে এই পোস্ট করা; নাহলে ঘুম হবে না যে... এই দুর্ঘটনা অনেক বড় দাগ রেখে গেছে মনে। শুভরাত্রি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:৪৪