somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যদি সব ছেড়ে হায়! (অনুগল্প) (গান-গল্প ০৪)

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাধবী অনেক ভেবে ঠিক করতে পেরেছে যে, মবিনের পাশে শ্যামলা মাঝারি উচ্চতার হালকা পাতলা গড়নের মেয়েকেই মানাবে। টানা টানা কাজল কালো চোখ, যেখানে যত্ন করে আঁকা থাকবে কাজলরেখা। ঘন কালো ঈষৎ কোঁকড়ানো দীঘল কেশ, পিঠময় ছড়িয়ে হাতে কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে তাদের ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটি। মাধবী যেন নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছে। মবিন মেয়েটির কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে আছে, মেয়েটির কেশরাশি দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজের পুরো মুখখানি। গুণগুণ করে কিন্নর কন্ঠে গেয়ে চলেছে মবিনের প্রিয় গানগুলি। মাধবীর মনে হল তার চোখের কোণে পানি জমেছে। কিন্তু হাত দিয়ে সে ধরে দেখতে পারছে না, পাছে যদি সবে দেখে ফেলে। কিন্তু এই ঘরে তো মবিন ছাড়া আর কেউ নেই। আর আছে তীব্র এক গন্ধ।


গন্ধটা কেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বেলীফুলের নির্যাসে কাঁচা মেহেদী মিশালো যে ধরনের গন্ধ হবে অনেকটা সেরকম। প্রতিটি নিঃশ্বাসে শীতল অনুভূতি নিয়ে দেহের গভীর হতে গভীরে মিশে যাচ্ছে সেই গন্ধ। যদিও মাধবীর টের পাওয়ার কথা নয় এসব। গত দিন সাতেক ধরে সে আইসিইউ’তে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কৃত্রিম উপায়ে। তবুও সে এই গন্ধটা অনুভব করছে খুব তীব্রভাবে। যেন শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত তীব্রতা নিয়ে এই গন্ধটুকু। তার সাথে চারিদিকে নীলাভ একটা জগত। যে জগত মবিন ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটা নয়, অনেকগুলো মবিন। তারা একজন যখন মাধবীর সাথে কথা বলছে, অন্যরা তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে তার চারিপাশে। কেউ বা বসে আছে একমনে তার দিকে চেয়ে। কেউ তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। প্রতিটি মবিনকেই তার সত্যি মনে হচ্ছে, একসাথে সবকয়টা মবিনকে।

মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনী ভরে
নয়ন দুটি ঘুমে জড়াতে নিশি রাতে
কে গান শুনাতো।।


মাধবী মাঝে মাঝে ঘুমে তলিয়ে যায়, কেন যে এত ঘুম পায় আজকাল। মনে করতে পারছে না, সেই কতকাল ধরে সে শুয়ে আছে, এই অদ্ভুত নীলসমুদ্রে। মনে হয় স্বচ্ছ নীল জলের অতলে সে অনন্তকাল ধরে শুয়ে আছে। আর এই জগত সংসার তার চারিপাশে বয়ে বেড়াচ্ছে। এই তো মনে হল সেই শৈশব এর পাঠশালার মেঠো পথে সে দুই বিনুনি দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ করেই আবার হয়তো চলে আসে তাদের ড্রইং রুম, মবিন শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছে। ওকে রাগিয়ে দিতেই হুট করে পত্রিকা কেড়ে নিল। অথবা সন্ধ্যে বেলা চায়ের মগ হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে মাধবী, বাবার বাড়ির দোতলার ছাদে; সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ধাড়ি মেয়ে খোলা চুলে কেন ছাঁদে ঘুরে বেড়াচ্ছে... এই চিন্তায় মায়ের ডাকাডাকি।

গন্ধের তীব্রতায় মাথা ঝিম ধরার মত হয়, তখন কোন অতলে যেন হারিয়ে যায় মাধবী। সেই হারানো অতলে আবার দেখা দেয় মাধবী। বাচ্চাদের মত করে তার কোলে মাথা রেখে হুহু করে কাঁদছে মবিন; কান্না সামলে নিতে না পেরে কেঁপে কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। বড্ড ছেলেমানুষ মবিন, এতটুকুতেই অস্থির হয়ে যায়। কোন প্রেশার নিতে পারে না, সহজেই বাচ্চাদের মত ভেঙ্গে পড়ে। মাধবী তার জীবনে এসে ছায়া হয়ে আগলে রেখেছিল। ব্যবসা হতে বাসা, যে কোন সমস্যায় মবিনের আশ্রয় ছিল মাধবী। কিন্তু মাধবী চলে গেলে কি হবে মবিনের? তাই তো মাধবী মনে মনে ভেবে যায় মবিনের জন্য নতুন একটা মেয়ে; যে তার মত আগলে রাখবে মবিন’কে। মবিনের জীবনে কখনো মাধবীর অভাব অনুভব করতে দিবে না। বেয়াড়া ঘুমেরা ফের সুতো কেটে দেয় মাধবীর ভাবনাগুলোর। আর ভাবনার সুতো!

তোমারি পথে ফুল ছড়ায়ে
কাঁটাগুলি কে দিতো সরায়ে।
হৃদয় ভরা মাধুরী নিয়ে
সাথে থেকে কে আশা জাগাতো।।


মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়া, এই দুয়ের মাঝে দোদুল্যমান থেকে কখন যেন সম্পর্কের সুতোটা ছিড়ে যায়; কিন্তু সব সময় কি তাই হয়? জানা নেই। মাধবী বিনা মবিনের জীবন কেমন হবে মাধবী মাঝে মাঝে তাই ভাবে। চারিপাশে মাঝেমাঝে এপ্রন পরিহিত ডাক্তার-নার্স দেখে, দেখে তাদের উদ্বিগ্ন চাহনি; বুঝতে পারে সময় খুব অল্প, চলে যেতে হবে অজানা সেই ঠিকানায়; যেই ঠিকানা তাকে ডেকে চলেছে প্রতিনিয়ত। মাধবীর মাঝে মাঝে অনুভূতিগুলো ফিরে আসে নীল জগত ভেদ করে। তখন মনে হয়, মাধবী বিনে মবিন কিভাবে বেঁচে থাকবে? মবিনের জন্য এ কতটা অসম্ভব তা মাধবী বিনে আর কেই বা জানে। দিন শেষে বাসায় ফিরে মাধবীর কাছে ছোট্ট শিশুটি হয়ে আশ্রয় খোঁজা মবিন আজ কার কাছে আশ্রয় খুঁজবে? তাইতো প্রায় সময়ই মাধবীর কেটে যায়, মবিনের জন্য কল্পনায় নতুন এক জীবনসাথী’র খোঁজে। আচ্ছা মবিন কি সেই মেয়ের হাতের রান্না মুখে দিতে পারবে? বিয়ের পর থেকে মাধবীর রান্না ছাড়া মবিন খেতেই পারে না। কোথাও দাওয়াতে গেলেও বাসায় এসে সে মাধবীর রান্না করা খাবার না খেয়ে ঘুমাতে পারে না।

তোমারি নামে দিনেরও শেষে
দীপ জ্বালাতো কে ভালোবেসে
ছিল জীবনে হাসি হয়ে কে
ব্যাথা হয়ে কে ব্যাথা রাঙ্গাতো।।


মবিনের সব কথার আশ্রয় যে মাধবী। তার প্রতিটি সুখের কথা, দুঃখের অধ্যায় মাধবীর আঁচলে সপে না দিলে যে পূর্ণতা পায় না। সেই পূর্ণতা কে দেবে মবিন’কে; মাধবী চলে যাওয়ার পর? মাধবীর চারিপাশে হুট করেই আবার মবিনেরা ঘুরপাক খাওয়া শুরু করেছে। একটা মবিন বিয়ের সাজে চুপটি করে বসে আছে। মাধবীর সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল, আহ কি লাজুক ছেলেরে। এই পাশে আবার বাজার হাতে ঘেমে নেয়ে একাকার আরেক মবিন তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। এই অসময়ে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েছে বুঝি। মাধবী নিজেও লজ্জা পেয়ে গেল। ধরমর করে বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে অবাক হল। বিছানায় শুয়ে থাকা এই দেহ আর তার নেই, সে শত চেষ্টা করেও দেহটাকে নাড়াতে পারছে না। তবে কি, দেহটাও শেষ অবধি তার রইলো না আর...

==============================================================================

উৎসর্গঃ প্রিয় ব্লগার প্লাবন২০০৩

==============================================================================

গানটি শুনি আরকবারঃ


==============================================================================

শিল্পীঃ চিত্রা সিং
সুরকারঃ জগজিৎ সিং
গীতিকারঃ শ্যামল গুপ্ত


==============================================================================

পুরো লিরিক্সঃ

মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনি ভরে
নয়ন দুটি ঘুমে জড়াতে নিশি রাতে
কে গান শুনাতো।।

তোমারি নামে ফুল ছড়ায়ে
কাটা গুলো কে দিতো সরায়ে
হৃদয় ভরা মাধুরী নিয়ে
সাথে থেকে কে আশা জাগাতো।

মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনি ভরে
নয়ন দুটি ঘুমে জড়াতে নিশি রাতে
কে গান শুনাতো।।

তোমারি নামে দিনের ও শেষে
দ্বীপ জালাতো কে ভালোবেসে
ছিল জীবনে হাসি হয়ে কে
ব্যাথা হয়ে কে ব্যাথা রাঙ্গাতো।

মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি রজনি ভরে
নয়ন দুটি ঘুমে জড়াতে নিশি রাতে
কে গান শুনাতো।।

==============================================================================

এই সিরিজের আগের গল্পগুলোঃ
আহা জীবন (অনুগল্প) (গান-গল্প ০১)
শুধু তোমায় ভেবে ভেবে (অনুগল্প) (গান-গল্প ০২)
আমার বাংলাদেশ (অনুগল্প) (গান-গল্প ০৩)

এই সিরিজ সম্পর্কে লেখকের কথাঃঅনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল খুব প্রিয় কিছু গানের লিরিকের ছায়ায় ছোট গল্প লেখার। অনেক প্রিয় গান আছে, যেগুলোকে মন চায় গল্পে পরিণত করতে। কিন্তু পটভূমি কি হবে তা ঠিক করা মুস্কিল। কেননা গানগুলো হয় এমন যে, নানান আঙ্গিক থেকে তাকে বিচার করা যেতে পারে। একটা গান, ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে। কিন্তু কোনটিই হয়ত মিথ্যে নয়। আমি আমার আঙ্গিকে সাজালাম গানের কথা’র ছায়ায় এই গল্পটি। ভিন্নমত বা পরামর্শ থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কমেন্টে। অনেকদিন গল্প লিখি না, হুট করে সন্ধ্যের পর বসলাম লেখাটি লিখতে। টানা লিখে পোস্ট করা, তাই খুব বেশী মন্দ হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। আর গানটি সম্পর্কে কিছু তথ্য আগ্রহী পাঠকদের জন্য নীচে তুলে ধরা হল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:০৩
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×