আগের দিন রাতেই প্ল্যান হয়েছিল, নির্ধারিত শিডিউলের বাইরে আমরা কুলুক্কুমালাই নামক পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণে বের হব, এবং তার জন্য খুব ভোরে আমাদের হোটেল হতে চেকআউট করে রওনা হতে হবে। এই ভোরবেলা চেকআউট করা যে একসময় প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে দাঁড়াবে, তখনও তা জানা ছিল না। যাই হোক, এদিন ভোর পাঁচটায় বহু কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে চোখ হতে জোর করে ঘুম তাড়ালাম। তারপরও যাত্রা শুরু করতে করতে প্রায় সাড়ে ছয়টা, গন্তব্য কেরালা'র মোটোরেবল হাইয়েস্ট রোড হয়ে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হিল টুরিস্ট স্পট Kolukkumalai Hill Top। হোটেল হতে চেকআউট করার সময় হোটেল বয় আমাদের মাইনাস পঞ্চমতলা হতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ব্যাগ টেনে তুলতে গিয়ে আমার লাগেজের হ্যান্ডেল ভেঙ্গে ফেলল... এই ভাঙ্গা হ্যান্ডেল এর ব্যাগ নিয়েই পরের প্রায় দশ-বারোদিন আমায় ভারতের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ভ্রমণ করতে হয়েছে।
আগে থেকে হোটেলে বলে রেখেছিলাম, রিসিপশন কাউন্টারে একটা ব্যাগে আমাদের জন্য ব্রেড, বাটার আর জ্যাম প্যাকেট করে রেখেছিল। বের হওয়ার সময় সেটা নিয়ে নিলাম। সকালের নাস্তা করতে অনেক দেরী হবে বলে এই ব্যবস্থা। আমাদের হোটেল হতে বের হয়ে মুন্নারের পাহাড়ি চা-বাগানের বুক চিরে চলে যাওয়া পাকা রাস্তা ধরে চলতে লাগলো আমাদের টয়োটা ইনোভা গাড়ীটি। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড, বন্ধুপ্রতীম মিঃ বিনয় পি জোশ এর সাথে আমি ফ্রন্ট সিটে বসে গল্প জুড়ে দিলাম। পেছনের সিটগুলোতে সঙ্গীরা সবাই কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কেউ কেউ ঝিমুচ্ছে, কেউবা আসলেই ঘুমে ঢুলছে।
একসময় আমরা এসে পৌঁছলাম, পাওয়ার হাউস ওয়াটার ফলস নামক একটি ঝর্নায়, পানির তেমন ধারা নেই বললেই চলে, বর্ষায় এই ঝর্ণাই রূপ নেই উন্মাতাল স্রোতস্বিনীতে। এখান পর্যন্তই আমাদের ইনোভার যাত্রা, এরপর ছোট জীপগাড়ী, যেগুলো চা-বাগানের পাথুরে আর মেঠো পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে কুলুক্কুমালাই টি-এস্টেট এর শেষ প্রান্তে। এই গাড়ীগুলোতে চারজন বসাই অনেকটা কঠিন। তবে একটা কথা বলা হয় নাই, এই ওয়াটার হাউস ফলস পর্যন্ত আসার পথখানির শেষের অংশটুকু খুবই থ্রিলিং ছিল। উঁচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা গাড়ী থেকে জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায়, অনেক অনেক নীচে গভীর খাঁদ, পাশের পাহাড় আর আমাদের পাহাড়ের মাঝের। কাশ্মীর এর মুঘল রোড এবং মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ করলাম গত বছর, উচ্চতা ছিল সর্বোচ্চ ১৩৫০০ ফিট। কিন্তু এই কলুক্কামুলাই এর ৭০০০+ ফিট উচ্চতার পাহাড় আগের দুটো ভ্রমণ উত্তেজনকে পেছনে ফেলেছে। ছবি বা ভিডিও কোন কিছু দিয়েই এই জায়গা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আমি সত্যি বিস্ময়ে থমকে গিয়েছিলাম।
জীপ গাড়ি করে কিছুক্ষণ ছুটে চলার পরই এক অপার্থিব সন্মোহিনী রূপ নিয়ে হাজির হল কুলুক্কুমালাই টি-এস্টেটের জাদুকরী পাহাড়ী চা-বাগানের সারি। মেঠোপথ দিয়ে মৃদু তালে নেচে নেচে আমাদের গাড়ীটি এগুতে লাগলো, আর তার সাথে তাল মিলে চলল আমাদের সবার ক্যামেরায় ছবি তোলার পালা। একসময় আমি ক্যামেরা রেখে দিলাম, এমন জাদুকরী রূপ চর্মচক্ষু দিয়ে হৃদয়ের গভীরে গেঁথে নিতে হয়ে, ক্যামেরার লেন্স দিয়ে মেমরি কার্ডে নয়। বেশ কয়েকবার গাড়ী থামিয়ে আমরা প্রকৃতির রূপে মিশে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম, অনেক ছবিও তোলা হল। আসলে এই জায়াগাটার প্রতিটি এঙ্গেল, প্রতিটি মুহুর্তই ক্যামেরাবন্দী করার মত। কিন্তু কতক্ষণ? কতই বা ছবি তোলা যায়? তাই আমার ক্যামেরা রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্তই সবচেয়ে ভাল সমাধান।
দুই ঘন্টার অসাম জার্নির পর পাথুরে পাহাড়ি রাস্তায় ঘন্টা দেড়েকের প্যারাময় জার্নি কিন্তু অপার্থিব দৃশ্যসকল। একটা পাহাড়ের চুড়া, একপাশে কেরালা প্রদেশের মুন্নার এর শেষ সীমা, আর অন্য পাশে তামিলনাড়ুর মাদুরাই এর শুরু, মাঝখানে ফুট চল্লিশ চওড়া পাহাড় চুড়া। আমরা যখন পৌছলাম তখন পুরো পাহাড় মেঘে ঢেকে গেল, ঘন কুয়াশার মাঝে মেঘ জড়িয়ে ধরলো আমাদের, ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলাম সবাই। অন্যপাশে তখন রোদ ঝলমল! তামিলনাড়ুর দিক থেকে তীব্র বাতাস আর মেঘ এসে আছড়ে পরতে লাগলো পাহাড়ের গায়ে, কিন্তু কেরলার পাশের উপত্যকা এবং অন্যান্য পাহাড়ে তখন সূর্য কিরণে ঝলমল। আধঘন্টা পর আবহাওয়া অনুকুলে আসার পর শুধু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা আর ক্যামেরার সাটার এর ক্লিক ক্লিক শব্দ।
আমাদের গাড়ী যেখানে এসে থামল, এরপর রয়েছে পাহাড়ী ট্রেইল, প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের। সেই ট্রেইল ধরে এগিয়ে গেলে আরেকটা ট্রেইল পাওয়া যায়, যা দিয়ে পাহাড় আর উপত্যকা ডিঙ্গিয়ে চলে যাওয়া যায়, গতকাল বিকেলে ভ্রমণ করা টপ ভিউ পয়েন্টে। দুই পাশের দুই পাহাড়ের মাঝে অতল গহবরের মত এক উপত্যকা। স্থানীয় লোকজন এবং জীপের ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রথম ট্রেইল ধরে এগিয়ে গিয়ে চুড়ো পর্যন্ত পৌঁছে ফের ফিরে আসতে প্রায় পাঁচ-ছয় ঘন্টা লেগে যাবে। সাধারণত ট্রাকাররা এখানে এসে কুলুক্কুমালাই এর আগের একটি জনপদে গড়ে ওঠা বেশ কিছু হোটেল আছে, সেখানে ওঠে। এরপর রাত কাটিয়ে ভোরবেলা চলে আসে কুলুক্কুমালাই। সারাদিনের ট্রেইল ধরে ট্রেকিং করে সন্ধ্যের আগে হোটেলে গিয়ে ফের রাত্রি যাপন করে পরদিন চলে যায় মুন্নার অথবা অন্য কোন গন্তব্যে। আমাদের দলের দুজন তো সেই ট্রেইলে ট্রেকিং করবেই করবে। অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে তাদের এ যাত্রায় থামানো গেল। কেননা, আমাদের আজকের মধ্যেই চলে যেতে হবে থিক্কাডি। সেখানে শিডিউল রয়েছে জাঙ্গাল জীপ সাফারি আর এলিফ্যান্ট রাইড করার। তো সেখান হতে বের হয়ে আমরা যখন ফিরতি যাত্রা করছি তখন ঘড়িতে প্রায় দুপুর সাড়ে এগারোটা।
এরপর আমরা ফের সেই পাওয়ার হাউজ ওয়াটার ফলস এ এসে জীপ গাড়ী ছেড়ে দিলাম, ঝর্ণার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম আমাদের কেরালা ট্যুরের তৃতীয় শহর থিক্কাদি এর উদ্দেশ্যে। অনেকটা পথ চলার পর চলে এলাম এক অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ী লেক এর কাছে। মিঃ বিনয় এর কাছ থেকে জানা গেল এর নাম আনায়িরাংগাল ড্যাম। আমি গাড়ী থামাতে বললে মিঃ বিনয় বলল, নির্ধারিত ভিউ পয়েন্ট আছে এই ড্যামের, সেখানে থামাবে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রতিটি এলাকার, বিশেষ করে পাহাড়ী এলাকায়, নির্দিষ্ট একটি ভিউ পয়েন্ট জনপ্রিয় হয়ে আছে, যেখান থেকে সবচেয়ে ভাল ভিউ পাওয়া যায় উক্ত এলাকার। প্রথমবার যখন কোন এলাকা ভ্রমণে যাবেন, মনে হবে ড্রাইভার আপনাকে বোকা বানাচ্ছে। কিন্তু কয়েকবারের অভিজ্ঞতা থেকে দেখবেন, আসলেই সত্য, নির্দিষ্ট ভিউ পয়েন্ট ছাড়া গাড়ী থামালে শুধু সময়ই অপচয় হয়। দার্জিলিং-কালিম্পং, সিমলা-মানালি, কাশ্মীর, রাজস্থান, গোয়া, কেরালা প্রতিটি এলাকাতেই নির্দিষ্ট ভিউ পয়েন্টই আপনাকে দেবে সবচেয়ে বেটার ভিউ, সেইভ করবে আপনার “টাইম এন্ড মানি”।
আমরা আনায়িরাংগাল ড্যাম এ অল্পকিছু সময় কাটিয়ে রওনা হলাম থিক্কাদি’র উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে সেরে নিলাম দুপুরের খাবার। প্রায় বেলা তিনটেরও বেশী সময় পরে আমরা পৌঁছলাম থিক্কাদি।
সরাসরি হোটেলে না গিয়ে আমরা চলে এলাম এলিফ্যান্ট রাইড, জাঙ্গল জীপ সাফারি করার জন্য থিক্কাদির বিখ্যাত পার্ক “এলিফ্যান্ট রাইড এন্ড কালচারাল পার্ক” এ। কিন্তু এখানে এসে শুনি জাঙ্গাল জীপ সাফারি’র সময় শেষ, আগামীকাল করতে হবে। কিন্তু আমাদের শিডিউলে আগামীকাল সকালে পেরিয়ার লেক এ বোট সাফারি করে থিক্কাদি শহরকে বিদায় জানানোর পরিকল্পনা। কি আর করার, এক যাত্রায় সবতো আর পাওয়া যাবে না। এলিফ্যান্ট রাইড মাত্র বিশ মিনিটের, তাও হেলেদুলে চলে হাতির পিঠে, কতটুকু আর হবে। তাই দেখে সবার আগ্রহ মরে গেল। বিরক্ত হয়ে এগুলো তো করা হলই না, এমনকি পরিকল্পনায় থাকা কাথাক্কলি নাচও দেখা হল না।
সন্ধ্যের আগে আগে চলে এলাম থিক্কাদি। আমি হোটেল রুমে বিশ্রাম নিতে চলে গেলাম, বাকী সাথীরা থিক্কাদি শহর ঘুরে দেখা আর টুকটাক শপিং করার উদ্দেশ্যে হোটেলে বাইরে...
আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
মুন্নার ভ্রমণ - মাতুপত্তি ড্যাম এবং ব্লোসম পার্ক (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৬)
ইকো পয়েন্ট এবং টপ ষ্টেশন অফ মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৭)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৭