কেরালা ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আমরা মুন্নারের বিখ্যাত “মাতুপত্তি ড্যাম” এবং “ব্লোসম পার্ক” ভ্রমণ শেষে (যা আগের পর্বে গল্প করা হয়েছে), রওনা দিলাম মুন্নারের বিখ্যাত “টপ ষ্টেশন” (Top Station - Border Hill Top between Tamilnadoo and Kerala) খ্যাত টুরিস্ট ডেস্টিনেশন দেখতে। মুন্নার শহরে হতে ৩৭ কিলোমিটার দূরের এই টপ ষ্টেশন মুন্নার শহর হতে ৩৭ কিলোমিটার দূরে আর ইকো পয়েন্ট ১৫ কিলোমিটার। মাতুপত্তি ড্যাম থেকে টপ ষ্টেশন এর দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার আর ইকোপয়েন্ট ০৬ কিলোমিটার।
ইকোপয়েন্ট হল একটি পাহাড়ি চুড়োয় অবস্থিত জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন। এখানের পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে জোরে আওয়াজ করলে তা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরত আসে, আর এই কারনেই নামকরন “ইকো পয়েন্ট”। আমার কাছে আসলে খুব একটা আহামরি মনে হয়ে নাই জায়গাটা। তবে প্রাকৃতিক রূপ মুন্নারের অন্যান্য জায়গাগুলোর মতই সুন্দর। সবুজ পাহাড়ের বুকে থরে থরে সাজানো চা-বাগানের সারি, পাহাড়ের বুক চিড়ে চলে যাওয়া পাহাড়ি নদীর নীল জল। সবমিলে মন্দ না...
আমরা ব্লসম পার্ক হতে বের হয়ে মুন্নারের রোড সাইড খাবারের দোকান, দোকান মানে একটা ভ্যানগাড়ীতে সব সরঞ্জাম, রাস্তায় টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার দোকান, এক্কেবারে শতভাগ আমাদের ঢাকা শহরের “ইটালিয়ান হোটেল” টাইপ, নাম “আম্মা হোমলি ফুড”। এক মহিলার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত খাবারের দোকান। নানান পদ রয়েছে, এমনকি গরুর মাংস! কেরালায় দেখেছি গরুর মাংস প্রচুর বিক্রি হতে, সারা ভারতে যা দূর্লভ, এমন কি কাশ্মীরে পর্যন্ত গরুর মাংস খেতে পারি নাই। যাই হোক, ভাত, সাম্বার, কায়ার বা এই জাতীয় নামের কোন মাছের কারী, চিকেন কারী, বিফ কারী, দুই ধরনের আচার, রায়তা, আরও কয়েকটি পদ... তাপ্পিয়ওকা, উন্নিয়াপাম... নাম উচ্চারণ করতেই দাত ভেঙে যাবার জোগার!!!
জম্পেশ একটা লাঞ্চ সারলাম, খাবার শেষে ডেজার্টে কেরালার লোকাল মিষ্টান্ন আর পিঠে... অনেকটা আমাদের ভাজা পুলি পিঠার মত। এই হেব্বি খাবার দাবার সেরে চারজনের বিল দিতে গিয়ে শুনি সর্বসাকুল্যে ৫০০ রুপীর মত হয়েছে। অথচ আগের রাতে হোটেলের রেস্টুরেন্টে ভাত, চিকেন কারী আর ডাল দিয়ে ডিনার করেছি বারশত রুপী দিয়ে। আসলে ভ্রমণে বের হলে সবরকমই ট্রাই করা দরকার। হোটেলের রেস্টুরেন্টের খাবারের এক স্বাদ আবার এই রাস্তার উপরের ধাবার খাবারের আরেক স্বাদ, ধরন... সকালবেলা হোটেলের বুফে ব্রেকফাস্টে কেরালার লোকাল ফুড ইটলি, সাম্বার, ধোকলা, ধোসা, ব্যানান ফ্রাই এগুলো সেইরকম সুস্বাদু ছিল, সাথে ফ্রেশ ফ্রুট জুস, যেগুলো আবার রোড সাইডে হবে ভিন্নতর। যাই হোক, খাবারের গল্প অনেক হল, এবার আসুন ইকো পয়েন্ট ঘুরে টপ স্টেশনের দিকে যাওয়া যাক।
টপ ষ্টেশন মুন্নারের অন্যতম জনপ্রিয় এবং কাঙ্ক্ষিত টুরিস্ট স্পট। এটি মুন্নারের সর্বোচ্চ স্থান। যে ভিউ পয়েন্টকে ঘিরে এটি গড়ে উঠেছে, সেটি মূলত Mudrapuzha, Nallathanni এবং Kundala নামক তিনটি পাহাড়ের মাঝখানের একটি স্থান। এটি কেরালা এবং তামিলনাড়ু সীমান্ত এলাকা। একপাশে কেরালার মুন্নার আর অপর পাশে তামিলনাড়ুর মাদুরাই। চারিদিকে পাহাড়ের সারি, নীচের অতলে নানান ভ্যালী, আর তারপর আরও গভীর খাঁদ, অপূর্ব জায়গাটি ঘিরে সবসময় ভিড় লেগেই আছে। মুন্নার থেকে কোদাইকানালগামী হাইওয়ে রাস্তায় পড়েছে এই স্পটটি। তাই সহজেই বাস, ট্যাক্সি অথবা প্রাইভেট কার করে দর্শনার্থীরা এখানে ভ্রমণ করতে পারেন। এখান হতে যে ভ্যালীগুলো দেখা যায়, সেগুলো তামিলনাড়ুর ‘থেনি’ নামক গ্রামের। শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় আমাদের দেখা এই ভ্যালীর রূপ এখনো সম্মোহিত করে আমাদের।
এই জায়গাটির নাম টপষ্টেশন রাখা হয়েছে, কারণ কেরালা সবচেয়ে উঁচু রেলষ্টেশন Kundala Valley এর সন্নিকটে অবস্থানের কারনে। এই জায়গাটি বিখ্যাত হওয়ার আরেকটি কারণ, এখানে প্রতি এক যুগ, ১২ বছর পর ফুটে খুব দুর্লভ একটি ফুল, নামঃ Neelakurinji flowers (Strobilanthus)। এই ফুল ফোটার পরবর্তী সময় ২০১৮ সালে, তাই ফুলপ্রেমীরা ২০১৮ সালে প্ল্যান করে ফেলুন কেরালা ভ্রমণের। টপ ষ্টেশন ভ্রমণের সেরা সময় এপ্রিল-মে মাস। এই টপষ্টেশনের কাছেই রয়েছে আরেকটি টুরিস্ট স্পট, Kurinjimala sanctuary। কিন্তু আমাদের হাতে সময় ছিল না, তাই সন্ধ্যের পরপর আমরা রওনা হলাম হোটেলের দিকে, তার আগে কিছু লোকাল ফ্রুট এবং স্ট্রিট ফুড কিনে নিলাম, গাড়ীতে করে ফিরতি যাত্রাকালে ভক্ষণ করার জন্য।
ফিরতি যাত্রার সময় ড্রাইভার মিঃ বিনয় জানালো এই টপ সেন্টারের ঠিক বিপরীত পাশের এলাকা হল ‘কুলুক্কুমালাই’ হিল এন্ড টি-এস্টেট, কেরালা প্রকৃত সর্বোচ্চ স্থান, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সাত হাজার ফুটের বেশী উচ্চতার চিরহরিৎ চা-বাগানের এক অপার্থিব জগত। তার মোবাইলে কিছু ছবি দেখালো, ছবি দেখে তো আমরা পুরাই ফিদা। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হল, আগামীকাল সকালে এখানে যাওয়া হবে। খবু ভোরবেলা রওনা হতে হবে। আর আমাদের ইনোভা ‘পাওয়ার হাউজ’ নামক পাহাড়ি ঝর্ণা পর্যন্ত যাবে। এরপর ছোট্ট জীপগাড়ীতে করে পাহাড়ি চা-বাগানের মেঠোপথ ধরে ঘন্টা দুয়েকের যাত্রাপথ। আমরা গিয়ে পৌঁছব একটা পাহাড়ের চুড়োয়, যার একপাশে কেরালা আরেক পাশে তামিলনাড়ু, মাঝখানে ফুট চল্লিশের পাহাড়ি চুড়ো।
এরপর আর কি, হোটেলে ফেরা, রাতের খাবার শেষ, দ্রুত ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। পরেরদিন খুব সকাল সকাল রওনা হতে হবে যে...
নীচের ম্যাপে টপ ষ্টেশন আর কুলুক্কুমালাই এর অবস্থান, এত কাছের জায়গা, কিন্তু যেতে হয়ে প্রায় পঁচাত্তর কিলোমিটার পথ ঘুরে।
আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
মুন্নার ভ্রমণ - মাতুপত্তি ড্যাম এবং ব্লোসম পার্ক (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৬)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:২২