মুন্নারের চা-বাগানের রূপে বিমুগ্ধ হওয়া আর সবুজের জাদুতে হারিয়ে গিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম মুন্নার টি মিউজিয়ামে। সেখানে ঘন্টা দু’য়েকের উপরে সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম মুন্নারের বিখ্যাত মাতুপত্তি ড্যাম (Mattupetty Dam) উদ্দেশ্যে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের এই জায়গায় আধঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম আমরা। প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম, স্কুলের বাচ্চাদের বিশাল দল নিয়ে দুটো গ্রুপও এখানে হাজির দেখলাম। যাই হোক, আমরা টিকেট কেটে আমরাও ঢুকে পড়লাম বাকী সকলের সাথে।
মুন্নারের চিরহরিৎ পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলা এই মাতুপত্তি ড্যাম এর অবস্থান কেরালা আনামুদি পিক (Anamudi peak) এর পাদদেশে। এই মাতুপত্তি মূলত একটি হিল ষ্টেশন, যার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১,৭০০ মিটার। এটি মুন্নার শহরের কেন্দ্রস্থল হতে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের সারির ভাঁজে ভাঁজে সবুজ গালিচার ন্যায় উপত্যকা আর চমৎকার শীতল আবহাওয়া যে কোন পর্যটকের মন কেড়ে নিবে নিমিষেই। এই মাতুপত্তি পাহাড় সারির বুক চিড়ে গড়ে ওঠা মাতুপত্তি ড্যাম হল এখানকার প্রধান আকর্ষণ এবং এই কৃত্রিম হ্রদ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে।
এই মাতুপত্তি ড্যাম হল বিশেষ ধরনের গ্রাভিটি ড্যাম, এই ধরনের ড্যাম শক্ত পাথর বা কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়, যা উঁচু স্থান হতে প্রবাহমান পানির ধারার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে প্রতিরোধ করে পানিকে ধরে রাখতে পারে। এই বাঁধগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন, প্রতিটি অংশ সমানভাবে পানির চাপ সহ্য করে পানি ধরে রাখতে পারে। ফলে এই ধরনের ড্যাম সাধারণত শক্ত শিলাখন্ডের ভৌতিক গঠনগত পাহাড়ে বেশীরভাগ সময় তৈরি করা হয়ে থাকে। কেরালার মুন্নারের এই ড্যামটি ১৯৪০ সালে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন করার লক্ষ্যে নির্মান শুরু হয়, যার কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৭০ এর পরে। এই বাঁধ এখন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, বন্যপ্রাণী আর পাখীদের এক অভ্যয়ারণ্যেও পরিণত হয়েছে।
এই ড্যামের অন্যতম আকর্ষণ হল স্থির জমে থাকা পানিতে সবুজ পাহাড়ের ছায়া, সারিসারি চা-বাগান, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে থাকা গহীন বনের হাতছানি। পর্যটকদের জন্য রয়েছে স্পীড বোটে করে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, রয়েছে নিজে নিজে চালানোর জন্য প্যাডেল বোট। শান্ত এই হ্রদের পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও আপনার বিরক্তি ধরবে না।
এই ড্যামকে কেন্দ্র করে ১৯৬৩ সালে ভারত এবং সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, গো-প্রজনন এবং ডেইরীর লক্ষ্যে। মুন্নারের সবুজ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা এই প্রজেক্ট বর্তমানে ‘কেরালা লাইভ স্টক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মিল্ক মার্কেটিং বোর্ড’ যার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
এখানে প্রবেশের জন্য আপনাকে মাত্র ১০ রুপী দিয়ে টিকেট কাটতে হবে। আর বোটিং করতে চাইলে প্রতি পাঁচজনের গ্রুপের জন্য প্রতি ১৫ মিনিটের খরচ ৩০০-৫০০ টাকা, সাধারণ বোট; ৭০০-১০০০ টাকা স্পীড বোট।
এখানে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম পরবর্তী গন্তব্য, ব্লসোম পার্ক, মুন্নার এ। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি খোলা থাকে এই বাগান তথা ফুলের পার্কটি। মুন্নার শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পার্কটির মূল আকর্ষণ হল এখানকার তাজা ফুলের বাগান, যা সাজানো হয়েছে নানান প্রজাতির রঙ্গীন সব ফুলের গাছ দিয়ে। সাথে রয়েছে মাথেরিপুজ্জাহ নদীর স্বচ্ছ পানি এবং সেখানকার নানান দেশী-বিদেশী পাখীর সমারোহ, চিরহরিৎ গালিচা, সেখানে ঘুরে বেড়ানো নানান পাহাড়ি প্রজাপতি। পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে সুপরিসন লন, কৃত্রিম ঝর্ণা, নদীর পাড় ছুয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ পাহাড়ের সারি; রয়েছে এডভেঞ্চার ট্রেইল, ন্যাচারাল ওয়াক, বার্ড ওয়াচিং এর চমৎকার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া রয়েছে বোটিং, স্কেটিং, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি স্পোর্টস আইটেম। চাইলে রিসোর্টে আয়োজন করা হতে পারে ক্যাম্প ফায়ার এর আয়োজন।
আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
নীচে রইল সেই বাগানের নানান ফুল আর গাছের ছবি, ছবি দেখতে না চাইলে এখানেই পোস্ট শেষ।
ফুলগুলো সব সহব্লগার, কামরুন নাহার বীথি আপু আর আমাদের ইবনে বতুতা, জুন আপুদ্বয়'কে উৎসর্গ করা হল।
আমাদের হাতে সময় কম ছিল বিধায় ফুলের অংশটুকু ঘুরে দেখে আমরা এখান হতে রওনা হলাম পরবর্তী গন্তব্যে। (চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:৫৯