somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বাংলাদেশ (অনুগল্প) (গান-গল্প ০৩)

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জালাল, কলেজে উঠেছিল সদ্য তখন, সারা দুনিয়া তার হাতের মুঠোয় যেন। সারাক্ষণ নতুন নতুন জীবনের পাঠ নিতে এতটুকু ক্লান্তি নেই বছর উনিশের জালালের। কলেজের পরে অবসর সময়ে হাতে থাকে কবিতার বই, সময় পেলেই নিজের গোপন ডায়েরীতে শুরু করে ছন্দ মিলের খেলা। গেল ঝুম বর্ষায়, বারান্দায় মোড়া পেতে বসে বৃষ্টি দেখে দেখে অদ্ভুত এক প্রেমানুভুতিতে বুদ হয়ে ভরেছিল সেই ডায়েরীর আনকোরা বেশ কিছু পাতা। তাদের বাসার পেছনের বাগান পেরুলেই শুরু মাইনক্যার ঝিল, সেখানে ফুটেছিল লাল পদ্ম। একরাতে সেই ঝিলে নৌকা নিয়ে দুই বন্ধুকে সাথে করে জোছনা দেখেছে সারা রাতভর। চোখে নিয়ে অযুত স্বপ্ন। তারপর বর্ষা শেষে শরত আর হেমন্ত পার করে এল শীত, তার কুয়াশার চাঁদরে জড়াবে বলে। কিন্তু তখনও কি জালাল জানত, তাকে এই শীতে ভালবাসার উষ্ণতা দিতে আসছে প্রিয়তমা কেউ...

তুমি প্রিয় কবিতার ছোট্ট উপমা, তুমি ছন্দের অন্তমিল
তুমি বর্ষার প্রথম বৃষ্টি, তুমি পদ্ম ফোঁটা ঝিল।



হামিদা আর জালালের বিয়ে হয়ে গেল গেল মাঘ মাসে, মাঘের শীতে নাকি বাঘে কাঁপে। কিন্তু তাদের বিয়ের রাতে দুজনে এতটুকু কাঁপে নাই শীতে, কেঁপেছিল উত্তেজনায়। নতুন কিছু পাওয়ার উত্তেজনায়, দুজন দুজনাকে আবিস্কার করার নেশায়। কিন্তু হাতের মেহেদীর রঙ তখনও শুকোয় নাই, বসন্তের ফুল তখনো ঝরে পড়ে নাই মাটির বুকে, এমনই এক সময়ে এল সেই কাল রাত, ২৫ মার্চ ১৯৭১। প্রিয়তমার স্নিগ্ধ হাতে বাঁধা তখনও সেই চিরবন্ধনের রাখী। সেই রাতে জালালের জীবন থেকে হারিয়ে গেল হামিদা, পিশাচের ভয়াল থাবায়। বুকভরা একরাশ কষ্ট সয়ে নির্বাক জালাল চেয়েছিল সারারাত আকাশের পানে, পেছনের বাঁশবাগানের ঝোপের মাঝে লুকিয়ে। একবার, হ্যাঁ একবারই বুঝি হামিদার আর্ত চিৎকার শুনেছিল, তারপর সব শুন্য, নিশ্চুপ যেন চারিধার। মাসখানেক সময়েই হামিদা হয়ে উঠেছিল জালালের জীবন, জীবনের সবটুকু, এক আকাশ ভালবাসা, তার তরুণ তনুমনে। পরদিন ভোরবেলা আগুনে পোড়া ঘর হতে বের হওয়া ধোঁয়ার মাঝে জলে ভেজা ধোঁয়াশা চোখে হামিদার ক্ষতবিক্ষত দেহখানি পড়ে থাকতে দেখেছিল তাদের ঘরে, যেই ঘরে হয়েছিল তাদের বাসর, স্বপ্নের আসর, আজ সেই ঘরেই একবুক শুন্যতা আর বেদনার মেলা। হামিদার দিকে তাকাতে মনে হল হামিদা জালালের দিকেই তাকিয়ে আছে, সেই প্রথম রাতের মত, জালালের আলতো স্পর্শে যেভাবে ঘোমটার আড়াল হতে চেয়েছিল। চোখে অশ্রু এল না, চোখ জ্বালা করতে লাগলো একবুক গুমরে থাকা কান্না আর ক্রোধে।

তুমি প্রিয়তমার স্নিগ্ধ হাতের বন্ধনের রাখী
তুমি কষ্টের নিভৃত কান্নায় ভরা যন্ত্রণার সবই।
তুমি শীর্ষ অনুভূতির পরে, শুন্যতার বোধ
তুমি আলতো স্পর্শে প্রিয়ার চাহনি, গুমরে থাকা ক্রোধ।



সেদিনের সেই কালরাত শেষের বেদনাবিধুর ভোররাত্রিতে সহস্রবার প্রার্থনা করেছিলা সৃষ্টিকর্তার কাছে, হামিদা যেন চোখ খোলে একবার, শুধু একবার, একবারের জন্য জালাল হামিদার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করবে, সে তার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে নাই, হামিদাকে সে হায়েনার হাত থেকে বাঁচাতে পারে নাই। এরপর জালাল চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে, চেনা নদীর ঢেউ গুনে গুনে একদিন বর্ডার পেরিয়ে চলে গেল ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং শেষে ফিরে এল দেশে, শত্রু নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদিন দেশ স্বাধীন হল, জালাল ফিরে এল তার নিজ গ্রামে, তার ভিটিমাটিতে। সেখানে তখন শুধুই শুন্যতা, কোন চিহ্ন নেই তাদের সেই ঘরবাড়ি সংসারের। এরপর কতকাল কেটেছে খোলা আকাশের নীচে, খাবার জুটে নাই কতবেলা। দেখেছে কদর্য এক রূপ, আপন স্বাধীন স্বদেশে।

তুমি ভোর রাত্রির প্রার্থনা, তুমি চেনা নদীর ঢেউ
তুমি সুখের সেই দিনগুলো শেষে হারিয়ে যাওয়া কেউ।
তুমি ভ্রান্তি নও, বাস্তবতা, শুন্য ভাতের থালা
তুমি লোভ, ঘৃণায়, ব্যাকরণে বিবেকের বন্ধ তালা।



এরপর জালাল গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে। আবার শুরু করে নতুন করে পথচলা। ভর্তি হয়ে যায় শহরের কলেজে, সেখান হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে। দিন যায়, বছর যায়, যায় কেটে যুগ, সময়ের সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে দেশ-কাল, কত স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, গড়ে উঠে আরও নতুন কত দুঃস্বপ্ন। দেখে রাজনীতির নোংরা খেলা, রাজপথের দখলে ঝড়ে পড়া নিজ সহপাঠীর লাশ, নিজ স্বাধীন স্বভূমে। তখন ঝড়ে পড়ে চোখ হতে অশ্রুজল, যা সেই চরম কষ্টের রাতেও জালালের চোখ হতে ঝড়ে পড়ে নাই। নিজেকে প্রশ্ন করে জালাল, এই কি চেয়েছিল স্বাধীনতার বিনিময়ে, আপন দেশে, আপনজনদের কাছ হতে। এক অচেনা অভিমান হয় নিত্য, বুকের মাঝে হয় রক্তক্ষরণ প্রতিনিয়ত, কষ্ট চেপে চেপে পাথর হয়ে যায় একদিন।

তুমি সংঘাত আর প্রতিঘাতের অস্হির রাজপথ
তুমি আজ ও আগামীর মাঝে বেদনার নীলক্ষত।
তুমি চাওয়া না পাওয়ার ফাঁকে, অসম সমীকরণ
তুমি অবুঝ রাগী প্রজন্মের, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ।



তারপর সময়ের নিয়মেই সময় গড়ায়, জালাল একদিন আবার নতুন করে জীবন শুরু করে রাহেলার সাথে। বহু প্রত্যাখ্যানের পর একটি চাকুরী জোটে তার কপালে। ততদিনে সেই টগবগে তরুণ জালাল আর তরুন নেই, অসময়েই যেন বয়স বেড়ে গেছে অনেকখানি। স্বপ্ন দেখা ভুলে গিয়ে, চোখের কোণে এক পাহাড় বিষণ্ণতার বসবাস। চেয়ে দেখে কিভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বদলে দেয়া হচ্ছে সকল সত্য, মুছে দেয়া হচ্ছে ইতিহাস, লেখা হচ্ছে নতুন করে, নিজেদের মনমত করে। এসব দেখে দেখে একদিন জালাল ভুলে যায়, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংসার হারানো, প্রিয়জন হারানো একজন মুক্তি সৈনিক, নিজ জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য লড়েছিল, আজ সব কিছু কেমন যেন মিথ্যে কোন স্বপ্ন মনে হয়। নতুন করে লেখা ইতিহাসের প্রতিটি শব্দই যেন বাস্তব সত্য বলে ধরা দেয় তার কাছে। এই দেশ কি চেয়েছিল, এত কিছুর বিনিময়ে?

তুমি তারণ্যের চোখের কোণে, বিষন্নতার বাস
তুমি বুড়ো খোকাদের ইচ্ছেমত ভুলের ইতিহাস।
তুমি উদ্ধত মিছিলের স্রোতে গর্বিত মুখ
তুমি ভুল নায়কের হাতছানিতে মায়ের শুন্য বুক।



তারপরও জালালেরা বেঁচে ছিল এই বাংলার মাটিতে, এই বাংলাদেশে, জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। হয়ত বুকে নিয়ে একরাশি হতাশা, ক্রোধ, ঘৃণা, বেদনা, কান্না... তবু তারাই তো স্বপ্ন দেখেছিল এই দেশকে নিয়ে, সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাদের জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত বেঁচে ছিল তারা। তাদের এতশত দুঃখ আর যাতনার মাঝেও সুখের নীড় ছিল নিজ দেশ, নিজ দেশের প্রতি ভালবাসা। সকল অপ্রাপ্তি আর বেদনার চাঁদর হাওয়ায় উবে যেত এক নিমিষেই দেশের প্রতি ভালবাসায়, দেশের প্রতি মায়ায়, দেশের সকল কিছু ভাললাগায়...

তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু, তোমার মাঝেই শেষ
ভালোলাগায় ভালোবাসার তুমি... আমার বাংলাদেশ।


=======================================================================
গানঃ বাংলাদেশ
এ্যালবামঃ তবুও এবং ফেরারী মন (আনপ্ল্যাগড)
ব্যান্ডঃ এলআরবি
কথাঃ জায়েদ আমিন

=======================================================================

আসুন আরেকবার শুনি প্রিয় গানটিঃ

=======================================================================

এই সিরিজের আগের গল্পগুলোঃ
আহা জীবন (অনুগল্প) (গান-গল্প ০১)
শুধু তোমায় ভেবে ভেবে (অনুগল্প) (গান-গল্প ০২)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:১২
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×