আগের পর্বঃ যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
অপেক্ষার পালা খুব খারাপ জিনিষ, খুব খারাপ, খুব...
প্রথম পর্বে এই কথাটা দিয়ে শেষ করেছিলাম প্রারম্ভিক কথন আমাদের কেরালা ট্রিপের গল্প কাহিনীর। আসলে তখনও জানতাম না, আমাদের ভ্রমণের অপেক্ষার মত পরবর্তী পর্ব লিখতেও এত অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক নির্ধারিত দিনে আমরা শ্যামলী পরিবহনের কলকাতাগামী বাসে করে রওনা হলাম, চারজনের ছোট দলটি। কাশ্মীর ভ্রমণের সময় শ্যামলী পরিবহনের সরাসরি কলকাতাগামী বাসে করে গিয়েও কাটায় কাটায় সময়ে পৌঁছোতে পেরেছিলাম বিকেল ০৪:৫০ এর রাজধানী এক্সপ্রেস ধরার জন্য। এবার যেহেতু প্ল্যানে সেফটির জন্য একদিন কলকাতায় রাত্রি যাপনের আয়োজন রাখা হয়েছিল, তাই এবার আর সরাসরি বাস না ধরে, যে বাসটি বর্ডারে গিয়ে চেঞ্জ হয়, সেই বাসে করে রওনা হলাম। যথারীতি ফজরের পরপর আমরা পৌঁছে গেলাম বেনাপল। এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিয়ে ইমিগ্রেশন ফরমালিটিস কমপ্লিট করার জন্য অপেক্ষার পালা। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ঢাকা থেকে ডিরেক্ট কলকাতার বাসগুলো’র এই ইমিগ্রেশন ফরমালিটিস আর ওপারে গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষার সময় মিলিয়ে প্রায় ঘন্টা তিনেক সময় অহেতুক নষ্ট হয়।
যাই হোক, ইমিগ্রেশন শেষ করে ওপারে গিয়ে বাসে উঠতে উঠতে আমাদের বাংলাদেশী সময় প্রায় নয়টা বেজে গেল। আমরা তেমন চিন্তিত ছিলাম না, কারন, আজ আমাদের তাড়া নেই, আগামীকাল বিকেলবেলা পাঁচটার দিকে আমাদের কলকাতা থেকে চেন্নাই হয়ে কোচিন এর ফ্লাইট। তাই নিশ্চিন্ত মনে আমরা চললাম কলকাতার দিকে। কলকাতায় হোটেল বুকিং করার কথা থাকলেও আমাদের ভ্রমণ বন্ধু মিতা রায় এর সৌজন্যে কলকাতার এক অমায়িক দম্পতির দুইদিন একরাতের আতিথিয়েতার সুযোগ হয়েছিল, সেই গল্পে একটু পরে আসছি।
বেনাপল বর্ডার পার হয়ে বাসে ওঠার আগ পর্যন্ত বাস কাউন্টারের লোকদের অত্যাচারে মাথা নষ্ট হয়ে যাবার যোগাড় হয়। এখান থেকে সিমকার্ড কিনে নিতে হবে, নইলে নাকি ভূভারতে আর সিম কেনা যাবে না। ডলার ভাঙ্গিয়ে নিতে হবে, নইলে ডলার ভাঙ্গাতে সমস্যা হবে... মন চায় ঠাস করে কষে একখান চড় দিতে পারলে ভাল হয়। ইভেন কয়েকজনকে দেখলাম ইমিগ্রেশন স্টাইলে জিজ্ঞাসা করছে, কত ডলার নিয়ে এসেছেন, কত ডলার এন্ডোর্স করেছেন ইত্যাদি... আসলে বেনাপল বর্ডার একটা ভীতিকর জায়গা, যদি আপনার তেমন কোন পূর্বাপর অভিজ্ঞতা না থাকে এসব ট্যাকেল করার। দুইপাশেরই ইমিগ্রেশন, কাস্টমস থেকে শুরু করে পুলিশ এমন কি কুলি, সবাই যেন হেনস্তা করার জন্য ওত পেতে বসে থাকে!
যাই হোক, বেলা বারোটা নাগাদ পথিমধ্যে হতে আমাদের পিক করে নিলেন নিজের গাড়ীতে ইন্দ্রনীল দাদা, মধ্য পঞ্চাশের ভদ্রলোক। রোদে পোড়া ফর্সা চামড়ার তামাটে আভায় কাঁচাপাকা চুলের সাথে কাঁচাপাকা গোফ। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভদ্রলোককে প্রথম দেখাতে পছন্দ হল আমার। মজার ব্যাপার হল, ঢাকা থেকে আমি অন্য কারো বাসায় থাকার ব্যাপারে গাইগুই করছিলাম। কার বাসায় উঠবো, কোথায় থাকব, প্রাইভেসি থাকবে কি না, ফ্রিলি মুভ করতে পারবো কি না এসব নিয়ে নানান সংশয়ের কারনে আমি বারবার চাচ্ছিলাম হোটেলে উঠতে। কিন্তু ভাগ্য ভাল হোটেলে উঠি নাই, নইলে এমন একটা মন ভাল করা অভিজ্ঞতা হতে বঞ্ছিত হতাম। তো দাদার গাড়ীতে করে প্রথমে চলে এলাম গড়িয়া মোড়ের উনার বাসভবনে। আমাদের জন্য বৌদি অপেক্ষায় ছিলেন। বিশাল আয়োজন আমাদের দুপুরের খাবারে, সব সামলে নিয়ে উনি অপেক্ষায়। আমরা পৌঁছতেই দাদা-বৌদি’র চাপে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে গেলাম, খেতে বসে তো আক্কেল গুড়ুম। সারা জীবন শুনে এসেছি, কলকাতার লোক মানেই “দাদা খেয়ে এসেছেন, নাকি যেয়ে খাবেন”। কিন্তু এদিন দুপুরে খেতে বসে পুরোপুরি লজ্জিত হলুম... আলু ভাজি, বেগুন ভাজি, সবজি-চিংড়ি, রুই মাছ, মুরগি, টমেটো চাটনি, ডাল... কোনটা রেখে কোনটা খাই। দাদা’র রাঁধুনির রান্নার হাত দারুন, বৌদি অসুস্থ এবং বয়স হয়েছে, তারপরও আমাদের আপ্যায়নে লেগে রইলেন। সত্যি আমি অভিভূত। আসলে অভিভূত হওয়ার আরও বাকী ছিল।
দুপুরের খাবার পর দাদা বৌদি’র সাথে কথা বলে উনার ভক্স ওয়াগনটা ড্রাইভার সহ আমাদের দিয়ে দিলেন। অবাক ব্যাপার হল, সেদিন বিকেলে বৌদি’র ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট ছিল, সেটা ক্যান্সেল করে পরদিন করলেন, শুধু আমাদের জন্য। এরপর আমরা বিকেলের দিকে ভক্স ওয়াগন করে কলকাতার অলিগলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা শহরের আদিম গন্ধ খুঁজে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ। এরপর আমরা চলে এলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কিন্তু ততক্ষণে প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। অগ্যতা সেখান হতে চলে এলাম প্রিন্সেপ ঘাট। কলকাতা গেলে, আমি সন্ধ্যে বেলাটায় এই প্রিন্সেপ ঘাটে কাটাতে পছন্দ করি, সন্ধ্যেটা দারুন কাটে।
তো প্রিন্সেপ ঘাটে সন্ধ্যে রাত কাটিয়ে দিয়ে আমরা রাতের বেলা চলে এলাম নিউমার্কেট এলাকায়। এখানে অনেকটা সময় ঘোরাঘুরি করে পথিমধ্য হতে “হালদিরাম” থেকে রাতের খাবার কিনে নিয়ে আমরা চলে গেলাম ইন্দ্রনীল দাদার মুকুন্দপুরের নয়াবাদের বাসায়। বিল্ডিং এর তিনতলা আর চারতলা নিয়ে ডুপ্লেক্স স্টাইলে পুরো বাড়িটি আমারদের আজকের রাতের জন্য।
প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে একেকটি ঘর, যে যার ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে বসলাম।
খাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই দেখি আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে। আমার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। রাতের নিয়ন আলো ভেদ করে সুচাকার ফলার মত ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। ঠিক তখন মনে হল, এখন আমি পরদেশে, ভিন্ন অচেনা একটি বাসায়, এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। জীবন কত অদ্ভুত, গতকাল রাতে ছিলাম বাসে, তার আগের রাতে নিজের বিছানায়, আগামীকাল থাকব প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার দূরের অচেনা আরেক শহরে। সেদিন রাতের সেই অনুভূতি, আমার কাছে সত্যি খুব অচেনা ছিল, অজানা ছিল। (চলবে)।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:২২