ইদানীং আমার সময়গুলো খুব ভালই যাচ্ছে, সারাক্ষণ নানান মানুষের সাথে পরিচয় হচ্ছে। আমি এখন একটা মিশনে আছি, মিশন মানে সেইরকম কোন মিশন না। নিজের তৈরি একটা মিশন, “মিট এন্ড নো এবাউট থাউজেন্ড পিপল”। হুট করেই মাথায় প্ল্যানটা এল, আসলে হুট করে বলাটা ঠিক না। মাস দুয়েক আগে, মহারাণী তার স্বভাব মত হুট করে আমায় ডাকলো শিল্পকলা’র দোতলার উন্মুক্ত চত্বরে। কেন? বা কি কাজ? এসব কিছুই জানার উপায় নাই। আমি পড়িমরি করে ছুটে গেলাম, গিয়ে দেখি সেদিন নাকি মহারাণীর কোন বন্ধু’র দলের নাটকের শো আছে সেখানে, সেই মঞ্চ নাটক আমায় দেখতে হবে। যন্ত্রণা কাকে বলে, এসব নাটক ফাটক আমার কাছে বিরক্ত লাগে, বিশেষ করে মঞ্চ নাটক। এরচেয়ে পাপেট শো দেখায় মজা আছে। নাটক দেখা এবং তার আগে-পরের আতেল মার্কা আড্ডা মিলে প্রায় তিন ঘন্টা আমাকে চোয়াল শক্ত করে তেলতেলে একটা হাসি মুখে ধরে থাকতে হয়েছে, কারন, কোন মতেই মহারাণীকে বুঝতে দেয়া যাবে না আমার বিরক্তি। কিন্তু কোন লাভ হয় নাই, বিদায়ের সময় মুখে সারা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে সে বলল,
“তুমি একটা আনসোশ্যাল, মানুষের সাথে মিশতে এত কি সমস্যা তোমার? এত কিসের ভাব তোমার?”
“মানে কি? আমি আবার কখন ভাব দেখালাম”... আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। যার জন্য এতটা সময় কষ্ট করে সব সহ্য করলাম, সেই কি না বলে, আমি আনসোশ্যাল!
“মানে বুঝ না? হিব্রু ভাষায় বলছি? নাকি ডিকশনারি লাগবে?”
মহারাণী’র বলার ভঙ্গীতে আমি এই সিচুয়েশনেও ফিক করে হেসে দিলাম। এতে পরিস্থিতি আরও গেল বিগড়ে।
“খবরদার হাসবা না? আমি কি সার্কাসের ক্লাউন? আমায় দেখে হাসি পায়?”
“আরে... আমি কি তা বলছি?”
“নাহ, সব কথা বলতে হয় না? আমি এখন তোমার কাছে হাসির পাত্র...!”
“দেখ বেশীবেশী হয়ে যাচ্ছে... তোমার কথামত এলাম, তোমার বন্ধুদের সাথে সময় কাটালাম, নাটক দেখলাম, আর কি করতে বল?”
“ও আচ্ছা আচ্ছা, তুমি আমার প্রতি অনেক দয়া করে ফেলেছ। ওকে ফাইন, আমার প্রতি আর দয়া করতে হবে না তোমার। তোমার দয়ার প্রতিদান আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তবে আজকের পর থেকে তোমায় আর দয়া করতে হবে না...”
“মানে কি?”
“মানে কিছু না... আজকের পর থেকে তোমার চেহারা আমি দেখতে চাই না, তুমিও আমার চেহারা দেখবা না... ব্যস শেষ।”
“কথায় কথায় তোমার এসব ভাল লাগে না, বুঝছ?”
“তোমার কারও কথাই ভাল লাগবে না। তুমি মানুষের সাথে মিশতে পারলে তো ভাল লাগবে। তোমার ভাল লাগে তোমার ঐ বস্তির মত করে রাখা মেস ঘরের মাঝে ঝিম মেরে বসে থাকা আর সিগারেট ফুঁকা। থাক তুমি তোমার ঐ লাইফ নিয়ে”।
এই বলে মহারাণী গটগট করে আমায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। আমি সেদিন রাতে সারারাত সত্যি সত্যি সিগারেট ফুঁকে পার করে দিলাম। আর সেই রাতেই আমি আমার এই মিশনের পরিকল্পনা করলাম। পরদিন থেকে আমি প্রতিদিন ঢাকার রাজপথে হাঁটি, নানান ধরনের মানুষ দেখি, তাদের সাথে ভাব করার চেষ্টা করি। প্রতিদিনই দুয়েকজন পেয়ে যাই, হয়ত রিকশাওয়ালা, বাদাম বিক্রেতা, বাস কন্ডাক্টার। কোনদিন কোন চায়ের দোকানদার, কোনদিন বাসের সহযাত্রী। তাদের সাথে আমি চেষ্টা করি লম্বা সময় ধরে আলাপচারিতা জমাতে। আমি আসলে মিশতে পারছি কি না জানি না। মহারাণীর দেয়া অপবাদ ঘুচছে কি না তাও জানি না। তবে মজা পাচ্ছি, নানান মানুষের নানান গল্প প্রতিদিন জানছি। ইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে অনেকদিন। নতুন ইয়ারের ক্লাস এখনো শুরু হয় নাই। তাই হাতে সারাদিন অফুরন্ত সময়। মহারাণী’র সাথেও সেই থেকে এখনও দেখা হয় নাই, আর দেখা হওয়ার চান্সও কম। ক্লাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত মহারাণী’র সাথে দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। ওকে ফোন দিলে ফোন ধরে না, মহারাণী’র দেয়া সেই মোবাইল ফোনটাই এখনও ব্যবহার করছি। মহারাণী ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, সেখানে মাঝে মাঝে ঢুঁ মেরে দেখে আসি মহারাণী কি করে। সে মহাব্যস্ত, তার সময়গুলোতে কোথাও আমি নাই। আমিও আছি ব্যস্ত, আমার মিশন নিয়ে।
আজ পেয়েছি এক মানসিক রোগীকে। বয়স বিশেকের ছেলে, রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, আমিও হাঁটছিলাম। আমি খেয়াল করি নাই, কতক্ষণ ধরে আমি তার পাশে হাঁটছিলাম। হঠাৎ সে আমার হাত ধরে আমায় বলল,
“এই যে, আপনি আমাকে ফলো করছেন কেন?”
“মানে?” আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
“সেই কবে থেকে আমি যে দিকে যাই, আপনিও সেখানেই আমার সাথে সাথে যাচ্ছেন। আপনি কি আব্বুর অফিসের স্পাই?”
“না, আমি কোন অফিসে কাজ করি না। আর তোমাকে ফলো করব কেন?”
“আমার সাথে চালাকি করে লাভ নাই” বলেই সে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। আমি আমার পথে হাঁটছি, হঠাৎ মনে হল এই ছেলেটার হোক আজকের মিশনের টার্গেট। এবার আমিও উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম তাকে ফলো করে করে। কিছুক্ষণ পর সেই ছেলে ঘাড় ঘুড়িয়ে আমায় দেখে দৌড়ানো শুরু করল, আমিও দিলাম দৌড়। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা ফুটপাথে বসে পড়ল, আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম।
“আচ্ছা ঠিক আছে চলেন, বাসায় যাব”।
“মানে?”
“মানে আপনাকে তো আব্বু আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে পাঠিয়েছে, তাই না?”
“আরে না? আর তোমার আব্বু তোমাকে বাসায় নিতে পাঠাবে কেন?”
“আমার সাথে অভিনয় করে লাভ নেই” বলে সে জোরে হাসতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে তার সাথে আমার জমে গেল। সে বিশ্বাস করল, আমি তার বাবার অফিসের কেউ নই, যে তাকে বাসায় ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। কথা বলে জানলাম, সে বাসা থেকে পালিয়েছে, গত দুইদিন হল। রাতে রেল স্টেশনে ছিল, সারাদিন শহরে ঘুরে বেড়ায়, সে নাকি “জীবন” খুঁজে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “জীবন” খুঁজো মানে কি? সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিল। আলাপ জমে এসেছে এমন সময়, মরার মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট হতে বের করে দেখি মহারাণী কল করেছে, আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ফোনটা রিসিভ করে একটু দূরে যেতেই ছেলেটি বলে উঠলো, “আব্বু ফোন দিছে? তাই না?”। আমি আরও দূরে সরে গেলাম, ছেলেটি মাথা নেড়ে হাসতে লাগলো।
“হ্যালো...”
“হ্যা, কি খবর? কেমন আছ? কি কর? রুমেই আছো?”
“না, এখন আমি রুমে থাকি না...”
“মানে কি? মেস ছেড়ে দিছ?”
“না, মেস ছাড়ব কেন? আমি এখন রাস্তায়”।
“রাস্তায় কি কর? কোথাও যাচ্ছ?”
“না হাঁটি, আমি এখন রাস্তায় হাঁটি”
“ওমা! তাই নাকি? তুমিও কি হন্টন বাবা হওয়ার প্ল্যান করছ?”
“নাহ, আমি মানুষের সাথে মেশার জন্য এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। আমি তো আনসোশ্যাল, কারো সাথে মিশতে পারি না” আমার কেন যেন খুব অভিমান হল।
“ওহ... বুঝছি। তুমি সেই এতদিন আগের কথা ধর বসে আছ। এসব পাগলামি করছ? আচ্ছা তুমি এমন পাগল কেন?”
“তাই? আনসোশ্যাল থেকে এখন পাগল হয়ে গেলাম!”
“উফ... রাখো তো তোমার এসব ফাউ প্যাচাল। শোন, তুমি ঠিক দুই ঘন্টা পরে নিউমার্কেট আসতে পারবা?”
“কেন?”
“কেন দিয়ে কি করবা? পারবা কি না তা বল?”
“পারবো”
“শোন, আমি এখন আছি নিউমার্কেটে। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। তুমি ঠিক দুইঘন্টা পরে নিউমার্কেট পোস্ট অফিসের সামনে থাকবে, বুঝছ?”
“হুম বুঝলাম, কিন্তু দরকারটা কি?”
“কোন দরকার নাই, আসতে বলছি, আসবা”
“হুম, তুমি মহারাণী, তুমি যা বলবা তাই তো করতে হবে। আমার কি কোন দাম আছে?”
“এই তুমি এত কথা প্যাঁচাও কেন? তোমাকে আসতে বলছি, কারন তোমাকে নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে যাব”।
“কেন? তুমি কি অসুস্থ? নাকি আমার পাগলামি’র চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাবা”
“আরে নাহ, একজনকে রক্ত দিতে হবে, আমার গ্রুপের সাথে ম্যাচ করেছে। আমার কাজিনের ফ্রেন্ডের ওয়াইফের অপারেশন, সেখানে রক্ত লাগবে। আমি একা একা এত দূর থেকে রক্ত দিয়ে আসতে পারবো কি না বুঝতেছি না”
“ওমা মহারাণীর রক্ত নিবে, বাসায় পৌঁছে দিবে না! ওরা কি জানে না মহারাণী’র রক্ত কত দামী”
“ঢং করবা না, একটু সুযোগ দিলেই তুমি মাথায় উঠো। যা বলছি তা কর”।
“তা না হয় করব, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত?”
“ফিরব রিকশায় করে।”
“হুম... সুযোগের সদ্ব্যবহার করছ?”
“নাহ, অনেকদিন তোমার সাথে রিকশায় ঘুরি না...”
“ঠিক আছে, দেখা যাবে। এখন আবার বলো না যেন, সবুজ শাড়ি, লাল টিপ, কাঁচের চুড়ি পড়তে হবে”। মহারাণী খিলখিল করে হেসে উঠল।
“না বলব না”
“বললেও লাভ নাই, আমি মার্কেট হতে সরাসরি হাসপাতালে যাব। আচ্ছা রাখি...” আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মহারাণী লাইন কেটে দিল। আমি ফোন পকেটে রেখে পাশের বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম, দ্রুত মেসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিউমার্কেট হাজির হতে হবে। হঠাৎ ছেলেটির কথা মনে হতে পেছনে ফিরে দেখি সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছতেই বাস পেয়ে গেলাম, বাসে উঠে দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ছেলেটি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সে হয়ত বিশ্বাস করে বসে ছিল, আমি তার বাবার অফিসের কেউ, তাকে নিতে এসেছি।
মেসে ফিরে গোসল করে আর কিছু খেলাম না। ভাবলাম মহারাণী রক্ত দেয়া শেষে দুজনে মিলে কোন একটা ভাল রেস্তোরায় বসে খাওয়া দাওয়া করব। গত পরশু টিউশনির টাকা পেয়েছি, পকেটে ভরে নিলাম। মহারাণী’র গিফট করা ডার্ক পার্পেল কালারের পোলো টিশার্ট গায়ে দিয়ে বের হলাম। বাসে না উঠে রিকশা নিয়ে নিলাম, একটা সিগারেট ধরিয়ে গুণ গুণ করে গান ধরলাম,
“মারিয়া ভুজঙ্গ তীর
কলিজা করিল চৌচির
কেমনে শিকারী তীর মারিল রে,
বিষ মাখাইয়া তীরের মুখে
মারিল তো তীর আমার বুকে
দেহ থুইয়া প্রাণটা লইয়া যায়...”
অদ্ভুত এক রোমান্টিকতায় মনটা ছেয়ে আছে। অনেকদিন পর মহারাণীকে কাছে পেতে যাচ্ছি। ভাবছি গুলশানের গ্লোরিয়া জিন্সে ঢুকবো কি না? টাকায় কি হবে? মনে হয় হয়ে যাবে। মহারাণীকে নিয়ে এমন কোন কফিশপে কফি খাব, অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। আজ সত্যি হতে যাচ্ছে, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। এসব ভাবনার মাঝে রিকশা যখন কলাবাগান পেড়িয়ে ধানমন্ডি দুই নাম্বার তখন মোবাইল বেজে উঠলো, মহারাণীর ফোন। ঘড়ির সময় দেখে নিলাম, নাহ দুই ঘন্টা এখনো হয় নাই, বাঁচছি, নইলে আবার কোন ঝড়ে পড়তে হতে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মহারাণীর আহ্লাদি সুর ভেসে এল,
“শোন, তুমি কোথায়?”
“এই তো আমি চলে এসেছি, সায়েন্সল্যাব এর কাছে।”
“আচ্ছা শোন, তোমার আসতে হবে না। যাকে রক্ত দিব, তার হাসব্যান্ড ফোন করেছিল, রক্ত লাগবে না, গুলশান এলাকায় থাকে এমন একজন ডোনার যোগাড় হয়েছে। কষ্ট করে আমাকে নিয়ে তোমার আর গুলশান যেতে হবে না”।
“হুম...” আমার মাথায় তখন আগুণ জ্বলছে। শালার এতদিন পর একটু মনটা ভাল হয়েছিল...
“শোন তুমি তোমার হাঁটা মিশনে ব্যাক কর। সরি তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।” বলেই কট করে ফোন কেটে দিল। আমি কি করব ভেবে পেলাম না। রিকশা হতে নেমে শাহবাগের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কাটাবন পার হতে দেখি আজিজ সুপার মার্কেটের ফুটপাথ থেকে সেই ছেলেটা আমায় ডাকছে হাত নেড়ে। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে আমার পথে হাঁটতে লাগলাম। মন চাচ্ছে গুলশান গিয়ে সেই ডোনারকে খুন করে আসি, তাহলে হয়ত একটু শান্তি পেতাম।
মহারাণী'র কেচ্ছা সিরিজের আগের গল্পসকলঃ
মহারাণী'র বাসন্তী ভালবাসা (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৭)
মহারাণী'র স্মার্টফোন (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৬)
মহারাণী'র বৃষ্টি বিলাস... অতঃপর পানিবন্দী মহারাণী (মহারাণী'র কেচ্ছা - ০৫)
অর্থহীন অভিমান (মহারাণীর কেচ্ছা - ০৪)
আহা রঙ, আহারে জীবন (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০৩)
ক্যানে পিরীতি বাড়াইলিরে... (মহারাণী’র কেচ্ছা - ০২)
মহারাণীর কেচ্ছা - ১ (ছোট গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:০১