আগের রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু ঘুম এসেছে অনেক দেরীতে। তারপরও ভোররাত চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে গেলাম। ঠিক ভোর পাঁচটায়, যখন পুরো মানালি শহর ঘুমিয়ে আছে, আকাশে তখনো শেষ রাতের আঁধারের বুকে মিটিমিটি করে আঁখি মেলে আছে শত সহস্র আলোকবর্ষ দূরের তারার দল। পাহাড়ের বুকে তখনও জ্বলছে খেলনার মত বাড়িগুলোতে জ্বালিয়ে রাখা বৈদ্যুতিক বাতিগুলো। আমাদের গাড়ী এই ভোররাতের পাহাড়ি রাস্তায় তীব্র আলো ছড়িয়ে হু হু করে ছুটে চলল। ড্রাইভার বিপিন তার নিজ দক্ষতায় এই সর্পিল পাহাড়ি পথ সত্তর-আশি কিলোমিটার স্পীডে চালিয়ে যেতে লাগল। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে যাত্রা, পেছনের সারিতে কেউ কেউ তখনই আবার ঘুমের জগতে হারাতে ব্যাকুল।
ধীরে ধীরে গাঢ় কালচে নীলাকাশ ফর্সা হতে লাগল, আর ভোর বেলার কোমল বাতাসের পবিত্রতা গায়ে মাখতে এই শীতেও জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম অনেকখানি। মুখমণ্ডল জমে যাবার জোগাড়, কাঁচ উঠিয়ে দেই, আবার একটু পর নামাচ্ছি, এই ফাঁকে আমার সঙ্গীরা সবাই চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে আছে। একসময় মানালি’র বিখ্যাত টানেল পার হয়ে এলাম সূর্যের আলো ফোটার আগেই। এরপর একে একে পার হয়ে এলাম পান্দোহ ড্যাম হয়ে মান্ডি। পথে হোটেল থেকে আগের রাতে প্যাক করে রাখা ব্রেড-বাটার-জ্যাম দিয়ে হালকা নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম। আটটা নাগাদ একটা রোড সাইড রেস্টুরেন্টে গাড়ী থামানো হলে আমরা সেখানে সকালের নাস্তা করে নিলাম। এই এক সপ্তাহের পুরোটা জুড়ে আমাদের ড্রাইভার বিপিন তার ব্রত পালন করছিল, সে যথারীতি ফল এবং চা-পানীয় ছাড়া অন্যকিছু দিনের বেলায় গ্রহণ করত না। যাই হোক নাস্তা শেষ করে আমাদের যাত্রা আবার চলল। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের বেশী সময় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে একসময় আমরা হাইওয়েতে উঠলাম। পাঞ্চাব হাইওয়েতে যখন গাড়ী চলছে তখন গাড়ীর স্পীড মিটারে দেখি নব্বই লেখা, কিন্তু মনে হচ্ছিল না গাড়ী ততোটা জোরে চলছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, মিটার ঠিক আছে তো? সে বলল, বাইরের দিকে তাকাতে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখি জায়গায় জায়গায় গাড়ীর স্পীড দেয়া আছে, প্রাইভেট কার ৯০ কিলোমিটারে চলবে, সব গাড়ী একসাথে অতি দ্রুত চলায় গতি তেমন টের পাচ্ছিলাম না। হিমাচল এবং পাঞ্জাব হাইওয়ে দেখে ঈর্ষা হল, চমৎকার রাস্তা, ফোরলেন উভয় পাশে, মানালি’র পাহাড়ে দেখলাম পাহাড় কেটে সেখানেও চার লেন রাস্তা হচ্ছে। মানালি থেকে লেহ যাওয়ার দীর্ঘ টানেল হচ্ছে, ২০১৯ সাল নাগাদ খুলে দেয়া হবে। তখন মানালি থেকে লেহ যেতে সময় লাগবে ১৬-১৮ ঘন্টা মাত্র। প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল এর কাজ পুরোদমে চলছে। হাইওয়েগুলোতে একটু পরপর দেখলাম টোলঘর ১০ রুপী থেকে শুরু করে ১৫০ রুপী পর্যন্ত টোল দিচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার থেকে জানা গেল আমাদের সুইফট ডিজেয়ার গাড়িটি দিল্লী-সিমলা-মানালি-দিল্লী যাত্রায় প্রায় ১,৬০০ রুপী টোল দিয়েছে। আর এই কারনেই কিন্তু রাস্তার ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে। হাইওয়েতে আমাদের দেশেও টোল ব্যবস্থা শুরু করা উচিত, শুধুমাত্র সেতুতে কেন?
পাঞ্চাব হাইওয়েতে “হাভেলী” নামক একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে যাত্রা বিরতি দিল। আমি এই হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট দেখে সত্যি ভিমড়ি খেয়েছি। এর ওয়াশরুমে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ, এমন ব্যবস্থা আমি বিমানবন্দরেও পাই নাই। তকতকে ঝকঝকে আধুনিক সব ফিটিংস দিয়ে সাজানো সুবিশাল আয়োজন, কেউ ব্যবহার করে বের হয়ে এলেই বাইরে থাকা ক্লিনার এসে ফ্লোরে কোন জলের ফোটা পড়লেও সেটা পরিস্কার করে যাচ্ছে। আমি ফাঁকা দেখে মোবাইলে কয়েকটা ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। কষ্ট হল আমাদের দেশের হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোর অবস্থা ভেবে।
যাই হোক এখানে তেমন কিছু খাওয়া হল না, বেলা তখন সবে সাড়ে এগারোটা। আরও ঘণ্টা তিনেক চলার পর, এক বড়সড় পাঞ্জাবী ধাবায় আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম। সেই ধাবায় খেয়েছিলাম আমার খাওয়া সবচেয়ে সুস্বাদু নানরুটি, এখনও জিভে লেগে আছে যেন।
এরপর যাত্রা আর সুখকর মনে হচ্ছিল না, শুধু চিন্তা কবে শেষ হবে এই যাত্রা, কবে পৌঁছব দিল্লী। অবশেষে বিকেল ছয়টা নাগাদ দীর্ঘ তের ঘণ্টায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটারের বেশী পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম দিল্লী।
দিল্লীর ফাইয়াজ রোডের একটা হোটেলে চেকইন করে, ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যের পর মেট্রো স্টেশন ধরে আমরা চলে এলাম পুরাতন দিল্লীর চাঁদনীচক এলাকায়। এখানে তখন দুর্গাপূজার নবমী’র রাত্রির উৎসবে লোকে লোকারণ্য, যদিও পশ্চিমবঙ্গের মত জাঁকজমকপূর্ণ নয়।
আমরা গেলাম রাতের বেলায় লালকেল্লা’র লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখতে। আমার তেমন ভাল লাগে নাই, একঘেয়ে ইতিহাস রেকর্ডেড ভয়েসে চালিয়ে দেয়া, সারা মাঠে নানান জায়গায় সাউন্ড বক্স দেয়া আর কেল্লার বিভিন্ন স্থাপনায় মৃদু আলো, এক কথায় ভাল লাগে নাই।
লালকেল্লা হতে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরাতন দিল্লী'র বিখ্যাত চাঁদনীচক ঘুরে দেখা শেষ করে চলে এলাম বিশ্ব প্রসিদ্ধ “কারিম’স” এর খানা চেখে দেখতে। এখানকার বিরিয়ানি খেয়ে মনে হয়েছে, কানে ধরে এদের পুরাতন ঢাকায় এনে অগা-মগা’র বিরিয়ানি খাওয়ায় দেয়া দরকার। চেখে দেখলাম দু’তিন পদের কাবাবও... সব বাকোয়াশ... অথচ কারিম’স নিয়ে টাইমস ম্যাগাজিনে পর্যন্ত প্রচ্ছদ হয়েছে। বিশাল এলাকা নিয়ে কয়েকটি দোকানে চলে এর ব্যবসা।
যাই হোক রাত দশটার পরে হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন ছিল দুর্গাপূজার দশমী, তাই পুরো দিল্লী সকাল বেলা নীরব। হোটেলের লাগোয়া এক রেস্টুরেন্টে “আলুপরাঠা উইথ মাকখান” দিয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে এগারোটা নাগাদ এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। বেলা সোয়া দুইটায় ফ্লাইট, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে, কলকাতা পৌঁছলাম বিকেল সাড়ে চারটায়, তিন ঘন্টার ট্রানজিট শেষে সাড়ে সাতটায় একটা লক্কর-ঝক্কর মার্কা বিমানে করে এয়ার ইন্ডিয়া আমাদের পৌছে দিল প্রাণের শহর ঢাকায়, ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা।
আর এর মাঝেই শেষ হল দীর্ঘ ষোল দিনের সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা-কোলকাতা-দিল্লী-জম্মু-পাহেলগাও-গুলমার্গ-শ্রীনগর-দিল্লী-সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস-মানালি-দিল্লী-কলকাতা-ঢাকা ভ্রমণের। অনেক গল্প বলা হল, অনেক গল্প বলা হল না, অনেক কথা সময় মত মনে পড়ে না, অনেক কথা মনে পড়লেও বলা হয় না। সব মিলিয়ে এই দীর্ঘ ভ্রমণ প্যাচাল শেষ হল। সকল পর্ব (কাশ্মীর সহ) নীচে দেয়া হল। খুব শীঘ্রই শুরু করব ২০১৬’র ফেব্রুয়ারিতে ভ্রমণ করা কেরালা-গোয়া-মুম্বাই সিরিজ। দেখা হবে তখন ভারত ভ্রমণের আরও নতুন গল্প নিয়ে।
এই সিরিজের সকল পর্ব (ক্রমানুসারে):
১ যাত্রা শুরু'র আগের গল্প (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
২ দাদাদের উঠোন পেড়িয়ে দিল্লী'র পথে (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৩ দু'পলকের দিল্লী দর্শন (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৪ মুঘল রোড ধরে কাশ্মীরের পথে (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৫ অবশেষে পৌঁছলুম পাহেলগাও!!! (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৬ পাথুরে নদী আর উপত্যকার শহর "পাহেলগাঁও" (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৭ "meadow of flowers" খ্যাত "গুলমার্গ" এর পানে, গণ্ডোলা'র টানে (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৮ গুলমার্গে যাপিত অলস দিনটি (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
৯ অতঃপর শ্রীনগর - ওয়াজওয়ান ভক্ষণ শেষে নাগিন লেকের ওয়াঙনু হাউজবোটে (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১০ শ্রীনগর এর দুই বিস্ময় - নাগিন এবং ডাল লেক (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১১ শ্রীনগর শহর পরিভ্রমনঃ হযরতবাল মসজিদ এবং শঙ্কর আচার্য পাহাড় চূড়া-মন্দির (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১২ কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেনস (প্রথম পত্র) - পরিমহল এবং চাশমেশাহী (মিশন কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১৩ নিশাতবাগ - কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেন (দ্বিতীয় পত্র) (কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১৪ শালিমার বাগ - কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেন (শেষ পত্র) (কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১৫ কাশ্মীরে কেনাকাটা (কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১৬ কাশ্মীরি খানাপিনা (কাশ্মীর এক্সটেন্ড টু দিল্লী-সিমলা-মানালিঃ ভারত ভ্রমণ ২০১৫)
১৭ সিমলা - ফ্রম শ্রীনগর ভায়া দিল্লী (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
১৮ সিমলা - কুফরি-ফাগু ((সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
১৯ সিমলা শহর দর্শন (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২০ সিমলা টু মানালি ভায়া পানদোহ লেক (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২১ মানালি-কুলু-মানিকারান (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২২ "বোট রাফটিং অ্যাট মানালি" দিয়ে শুরু করে "কুলু হিমালায়ান বুদ্ধিস্ট কিয়াস মনস্ট্রি" দিয়ে সমাপ্তি (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২৩ স্বপ্নের রোহটাং পাস (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২৪ রোহটাং পাস টু সোলাং ভ্যালী টু মানালি মল (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২৫ মানালি সাইট সিয়িং (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
২৬ মানালি টু দিল্লী টু ঢাকা (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫) (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৪৪