আগের পর্বঃ রোহটাং পাস টু সোলাং ভ্যালী টু মানালি মল (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
যে কোন কিছুর সমাপ্তিতে একটা সুপ্ত বেদনার রাগিণী থাকে, প্রাপ্তির সাথে সাথে ফেলে আসা স্মৃতি অজানা এক বিরহের প্রচ্ছন্ন মেঘ জমিয়ে তোলে। প্রায় দুই সপ্তাহের ভারত ভ্রমণের শেষ দিন ছিল মানালি’র আশেপাশের কিছু সাইট সিয়িং আর টুকটাক কিছু কেনাকাটা। আগের রাত হতেই প্রচণ্ড হোম সিকনেস গ্রাস করেছিল। এতদিন শুধু কাছের আত্মীয় আর বন্ধুদের কাছে শুনে এসেছিলাম, দেশের জন্য প্রাণ পুড়ে... এবার নিজে টের পেলাম, মাত্র তের দিন! এই সময়েই যেন মনে হল কতদিন ধরে কোন অজানায় পড়ে আছি, কবে ফিরব ঘরে। একই সাথে তেরদিনের আনন্দময় ভ্রমণের স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আর দু’দিন পর আবার সেই চার দেয়ালের মাঝে বন্দী জীবন, একঘেয়ে নাগরিক কোলাহলে ব্যস্ত জীবন সংগ্রাম... পরস্পর বিপরীতমুখী এই অনুভূতি নিয়ে এদিনের যাত্রা, আমি মোটেও উপভোগ করতে পারি নাই। শুধু মনে হয়েছে, কোন মতে দুটি দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। অথচ আগেরদিন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল, রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলাম ভাল মুড নিয়েই, কিন্তু সকাল হতেই মন ভার হয়ে রইল।
যাই হোক, এদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল মানালির “ভাসিসত” নামক একটা উষ্ণ প্রস্রবণ এবং একে ঘিরে গড়ে ওঠা হিন্দু ধর্মীয় তীর্থস্থান। মানালি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বিয়াস নদীর তীরবর্তী পুরাতন মানালির এই এলাকা বিদেশী পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একই সাথে দেশীয় পর্যটকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তীর্থকেন্দ্র; এখানে রয়েছে দুটি বিখ্যাত মন্দির। সরু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে জায়গাটা। গাড়ী হতে নেমে দুপাশের নানান দোকান দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে গেলাম সেই মন্দির আর উষ্ণ প্রস্রবণের দিকে।
এই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে ঋষি ভিসাসত এর নামানুসারে; যিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মের অন্যতম সাত ঋষি’র একজন। কথিত আছে ঋষি ভিসাসত যখন জানতে পারন যে তার সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে, যার মূল হোতা ছিলেন বিশ্বমিত্র নামক আরেক ঋষি, তিনি তখন আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, বিয়াস নদী উনাকে মরতে দেয় নাই, তখন থেকেই এই নদীর নামকরণ হয়েছে “বিপাশা” যার অর্থ “বাঁধন থেকে মুক্তি”। পরে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে হিন্দিতে বিয়াস নামে পরিচিত হয়েছে।
সেই ঘটনার পর থেকে ঋষি ভিসাসত নতুন করে জীবনকে উপলব্ধি করা শুরু করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে এই ভিসাসত মন্দির চার হাজার বছরের পুরানো। এর পাশেই আরেকটি মন্দির আছে, যা মূলত রাম মন্দির। আর এই দুই মন্দির সাথে উষ্ণ প্রস্রবণ, এর সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছে তীর্থকেন্দ্র। এখান হতে বিয়াস নদীর অপূর্ব দৃশ্য এখানে আগত পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শীত-গ্রীষ্ম সারাবছরই এই উষ্ণ প্রস্রবণ হতে গরম পানি বের হয়ে, সেই পানি দিয়ে এখানকার অধিবাসী, এমন কি আগত পর্যটকের গোসল সহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নেন।
আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়, এখানকার দোকানগুলোতে এক বিশেষ ধরনের কম্বল বিক্রয় হতে দেখেছি, নাম হল “চিঙ্গু” বা “স্পারু”। বাইরে দালালেরা গিজগিজ করছে, আপনাকে তাদের দোকানে ঢুকানোর জন্য, অনুরোধ করবে কিনতে হবে না, জাস্ট দেখুন একবার। এই কম্বল নাকি গরমে শীতলতা আর শীতে উষ্ণতা দেয়। অনেক দামী কম্বল, চারভাগের একভাগ দামে দিচ্ছে। এর সাথে ফ্রি গিফট হিসেবে আছে কার্পেট, বিছানার চাঁদর থেকে শুরু করে নানান কিসিমের পণ্য। আবার পছন্দ না হলে পণ্য ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে টাকা ফেরতের গ্যারান্টি... :O ভাওতাবাজী কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি? এখানে দেখা যায়। আমরাও দুটো দোকানে ঢুকে দেখলাম, দেখে বের হয়ে এলাম। মনে পড়ল ঢাকা বাণিজ্য মেলা’র এরকম অফারগুলোর কথা।
যাই হোক এখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল হাদিম্বা দেবী টেম্পল এবং তদসংলগ্ন বনবিহার। ভারতীয় পৌরণিক গাঁথা “মহাভারত” এর চরিত্র ভিমা’র স্ত্রী ছিলেন হাদিম্বা দেবী, তার স্মৃতি উদ্দেশ্যে এই মন্দিরের উৎপত্তি। মন্দিরের চারিদিকে বনবিহার ঘিরে আছে। দেবদারু গাছে ছেয়ে থাকা বনভূমি’র ভেতরে বিশালাকৃতির এক পাথুরে চত্বরের উপর এই মন্দির নির্মিত হয় ১৫৫৩ সালে। চারিদিকে কাঠের অবকাঠামো দিয়ে ঘেরা এই মন্দির এর উপরে একটি শিখর আকৃতি রয়েছে।
ছাদের দিকে তিনটি স্তরে চতুষ্কোণাকৃতির ছাদ ক্রমান্বয়ে আকারে ছোট হয়ে উপরে উঠে গেছে, তার উপর শিখর। মহাভারত এর বর্ণনা অনুসারে পঞ্চ পাণ্ডবেরা নির্বাসনে পাঠানো হলে চলে আসে মানালিতে। সেখানকার তৎকালীন ক্ষমতাধর এবং বলশালী হাদিম্বী দেবী’র ভাইয়ের সাথে পঞ্চপাণ্ডবের যুদ্ধ হয়ে। এই যুদ্ধে হাদিম্বী দেবীর ভাই মারা যায় এবং পরবর্তীতে পঞ্চ পাণ্ডবের অন্যতম ভিমা’র সাথে হাদিম্বী দেবী’র বিবাহ হয়। পরবর্তীতে যখন নির্বাসন শেষ করে পঞ্চ পাণ্ডবেরা ফেরত যায়, ভিমা’র সাথে হাদিম্বী দেবী ফিরে যান নাই। তিনি মানালিতে থেকে যান এবং আজীবন ভগবানের তপস্যা করে কাটিয়ে দেন। আর সেই তপস্বী হিদিম্বী দেবীর মন্দিরকে ঘিরে আজকের এই তীর্থ যা মূলত হাদিম্বা টেম্পল নামে পরিচিত।
এই মন্দিরে পূজো দেয়ার জন্য বিশাল লাইন দেখলাম, শতশত লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের পেছনে বড় বড় ডেকচী করে খাবার রান্না হচ্ছে, প্রসাদ হিসেবে। মন্দিরের চারিপাশটা একবার চক্কর মেরে আমি পাশের বনের ভেতরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, দু’চারটা ছবিও তুললাম। আমাদের সঙ্গী মিতা রয় মন্দির হতে পূজো সেরে বের হলে আমরা এবার পরবর্তী গন্তব্য মানালি তিব্বতীয় মনস্ট্রি’র দিকে রওনা হলাম।
দুদিন আগে দেখা কুলু তিব্বতীয় মনস্ট্রি’র তুলনায় ছোটখাট এই মনস্ট্রিও দেখতে মন্দ না। পুরোটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানে কলকাতার দুই ভদ্রলোকের সাথে গল্প হল, বাংলাদেশ থেকে সিমলা-মানালি’তে লোক বেড়াতে আসে এটা তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বেশ মজা পেলাম, আমারতো মনে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশী বাংলাদেশী পর্যটক ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বেড়াতে যায়। যাই হোক উনাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা মনস্ট্রি দেখায় মনোযোগ দিলাম।
এই মনস্টি’র নাম “গাধান থেকচ্ছক্লিং গুম্পা” যা ১৯৬০ সালে নির্মিত হয়েছিল। মূলত পার্শ্ববর্তী তিব্বত থেকে আগত বিপুল পরিমান শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে এটা নির্মিত হয়েছিল। প্যাগোডা’র মত দেখতে হলুদ রঙের ছাদটি দূর হতে এই মনস্ট্রি’র দিকে পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এখানে বুদ্ধের মূর্তি এবং বৌদ্ধ ধর্মের নানান চিত্র রয়েছে। রয়েছে অতিথিশালা, ভোজনালয়, কিছু দোকান যেখানে তিব্বতীয় হ্যান্ডিক্রাফটস এবং কার্পেট বিক্রয় হয়। ছোট্ট এই পর্যটন কেন্দ্র ঘুরে দেখতে বেশী সময় লাগল না।
এখান থেকে বের হয়ে এবার আমরা রওনা হলাম মানালি মলের দিকে, বেলা তখন প্রায় দুটোর উপরে। মানালি মলে এসে লাঞ্চ করলাম, একমাত্র মুসলিম রেস্টুরেন্টে, খাসির বিরিয়ানি। সেদ্ধ বাসমতি চালে সেদ্ধ স্বাদহীন কষানো ভেড়ার মাংস দিয়ে রান্না করা। কোন মতে পেটে চালান করে দিলাম।
এদিন বিকেলে তেমন আর কোন কাজ ছিল না, বিক্ষিপ্তভাবে ঘোরাঘুরি করে সময় পার করলাম। রাতে দ্রুত খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, তার আগে ব্যাগপত্তর ভালমত গুছিয়ে নেয়া। কারন, পরেরদিন ভোর পাঁচটায় আমরা যাত্রা শুরু করব মানালি হতে দিল্লী’র উদ্দেশ্যে।
আগের পর্বগুলোঃ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫১