আগের পর্বঃ "বোট রাফটিং অ্যাট মানালি" দিয়ে শুরু করে "কুলু হিমালায়ান বুদ্ধিস্ট কিয়াস মনস্ট্রি" দিয়ে সমাপ্তি (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
আগের দিন কুলুতে অবস্থিত “তিব্বতীয় মনস্ট্রি” দেখে এসে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড, বিপিন রাজপুতান আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল সিমলা মলে। আমি আর রওশন আরা ইয়াসমিন আপা হোটেলে গিয়ে সাথে থাকা ব্যাগপত্তর রেখে ফ্রেশ হয়ে ফের যখন মলে এলাম, আমাদের অন্য দুই সাথীকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। এমনিতেই মানালি মলে সন্ধ্যের পর লোক সমাগম বেশী থাকে, আর ঐ সময় ছিল দুর্গাপূজা, যতসম্ভব সপ্তমী ছিল। মলের শেষ প্রান্তে একটা মণ্ডপ মত জায়গায়, গ্যালারির মত অংশ আছে যেখানটায়, সেখানে রামায়ন বা মহাভারত হতে কোন একটা কাহিনী নিয়ে নাটক হচ্ছিল, লোকে লোকারণ্য সেই অংশটা। সেখানে আমি উঁকিঝুঁকি দিয়ে সাথীদের খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে মলে ঘুরে বেড়ালাম। কিছু কেনাকাটা করলাম মল হতে, দেশে ফিরে কাছের মানুষদের স্যুভেনিয়র হিসেবে উপহার দেয়ার জন্য। রাত নয়টা পর্যন্ত মলে কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার শেষে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হল হোটেল মালিকের সাথে। গল্প শেষে যার যার রুমে চলে গেলাম নিদ্রা দেবীর কোলে হারাতে।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠার আজ তাড়া ছিল না, তারপরও ঘুম ভেঙ্গে গেল একটু আগে আগেই। আমি খুশী মনে তৈরি হয়ে নীচে নেমে দেখি বাকী সবাই আমারও আগে নীচের রিসিপশনের ড্রয়িং রুমে খোশ গল্পে মশগুল। আমি যেতে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসলাম। প্রতিদিনের মত গরম গরম আটার রুটি, খুবই নরম এবং সুস্বাদু, সাথে আলু-গোবি, মাটার পানির আর ডিম অমলেট। নাস্তা সেরে নিয়ে চা পান করে বাইরে উকি দিতেই দেখি একটু দূরেই বিপিন অন্যান্য ড্রাইভারদের সাথে গল্প করছে। আমরা যে এজেন্টের মাধ্যমে প্যাকেজ বুকিং দিয়েছিলাম, সেই এজেন্টের প্রায় একশত’র মত প্রাইভেট ভেহিকেল চলে সারা ভারত জুড়ে, টুরিস্ট নিয়ে। আর মানালিতে যে হোটেলে ছিলাম, এটা ছিল সেই মালিকের ছোট ভাইয়ের মালিকানাধীন। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং এ একই মালিকের দুটো হোটেল, আর হোটেল দুটোর বেশীরভাগ অতিথি তার ভাইয়ের কোম্পানীর প্যাকেজের। ফলে গাড়ীর ড্রাইভার বেশীরভাগই একই কোম্পানীর সহকর্মী। যদিও অবিশ্বাস্য, এদের বেতন মাত্র ৫,০০০-৮,০০০ রুপী। প্রায় মাসের তিন-চতুর্থাংশ সময় এরা গাড়ীতে কাটিয়ে দেয়। আমরা যখন রাতে হোটেলে আরামের নিদ্রা দেই, তখন এরা এদের গাড়ী ড্রাইভিং সিটের সাথের ফ্রন্ট সিটটা পুরোপুরি এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে কোন পার্কিং এরিয়ার অথবা হোটেলের পার্কিং এ।
“গুড মর্নিং, নিন্দ আচ্ছা হুয়া?” আমাকে দেখেই বিপিনের জিজ্ঞাসা। এই কয়দিনে ও আমার সাথে জমে গেছে, সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে মজা করছে, আমি তাকে নিয়ে। অথচ দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে পিক করার পরের ঘণ্টা কয়েক আমার মন এ কারনে খারাপ ছিল যে, কি এক কাটখোট্টা উজবুক টাইপ ড্রাইভার পেলাম রে বাবা... এ কারনেই বলে নেভার প্রেডিক্ট এট ফার্স্ট সাইট... কে বলে? আমি মনে হয় কিন্তু আপনি যে আবার বলেন, “মর্নিং সউজ দ্যা ডে...” কোনটা সঠিক? ধাঁধাঁ রইল।
আমরা সবাই গাড়ীতে উঠে পড়তেই বিপিন গাড়ী স্টার্ট দিল। হোটেলের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে তার দিগন্ত রেখায় প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে আছে একটা পাহাড়, আর তার চুড়োয় বরফ পড়েছে রাতভর। সেই শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের শীর্ষ সকালের সোনালী আলোয় রুপোর মত ঝিলমিল করছিল। আমি গাড়ীর ফ্রন্ট সিটে বসে সেই পাহাড়ের ছবি নিতে ব্যস্ত। বিপিন বলল, “রুখো ইয়ার, সামনে বাহুত মিলে গা”। মনে পড়ল গত সপ্তাহে জম্মু থেকে মুঘল রোড হয়ে শ্রীনগর যাওয়ার পথে বলা সাহিলের কথা... যাই হোক এর মাঝে চলছে বিপিনের প্রশ্নোত্তর পর্ব। সে ট্যুরের শুরু হতে আমাকে নানান তথ্য দিচ্ছে আর পরে সেগুলো আবার পড়া ধরার মত করে জিজ্ঞাসা করছে। হয়ত গতকাল এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একটা পাহাড় দেখিয়ে তার নাম, ইতিহাস এসব বলেছে, এখন সেটা জিজ্ঞাসা করছে। কখনো জিজ্ঞাসা করছে, বলত মানালির নদী দুটোর নাম কি?
হোটেল হতে যাত্রা করে পথিমধ্যে একটা জায়গায় গাড়ী থামানো হল, এখান থেকে শীত পোশাক এবং গামবুট ভাড়া নিতে হবে। সারি সারি পর্যটকবাহী গাড়ী এখানে এসে থামছে। আমাদেরটাও থামল, আমরা তিনজন শীত পোশাক ভাড়া করলেও রওশন আপা করলেন না। উনার ভাগ্য ভাল, আমার সাথে আমার লেদার জ্যাকেট ছিল, পরবর্তীতে উনি সেটা দিয়ে কাজ চালিয়েছেন। তবে এখান থেকে ২৫০ রুপী দিয়ে জামা ভাড়া না নিয়ে দুটো গরম জামা গায়ে দিয়ে বের হবেন, সাথে একটা বাড়তি নিয়ে নিবেন, তাতেই কাজ হবে। আসলে পুরো পথে তেমন ঠাণ্ডা নাই, মূলত ঠাণ্ডা হল রোহটাং পাস এ, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, ১৩৫০০ ফিট উচ্চতা তার সাথে এমনিতেই আপনাকে কাবু করে দিবে, সেই গল্পে আসছি একটু পরে।
জামা নেয়া শেষে আবার গাড়ী চলা শুরু করল। পথে একটা জায়গায় বিপিন গাড়ী থামাল, একটা মন্দির মত স্থাপনা, এটাকে ঘিরেই এই লোকালয় গড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে সেটার নামধাম মনে পড়ছে না, সব ভিডিও করেছিলাম সেই হারিয়ে যাওয়া মোবাইলে। ভেবেছিলাম পরে সেখান হতে তথ্য সব নিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু হায়! মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক... যাই হোক, সাপের ন্যায় বাঁকানো পাহাড় বেয়ে আমরা উঠে যাচ্ছিলাম স্বপ্নের রোহটাং পাসে। এতদিন নানান ছবি আর ইউটিউব ভিডিওতে দেখা ভয় ধরানো সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কেন যেন ভয় লাগেনি মোটেই। হতে পারে সেটা বিপিনের সুদক্ষ গাড়ী চালনা থেকে, আবার হয়ত বা গত দশ-বারো দিন ধরে পাহাড়ী এলাকা ঘুরে ঘুরে চোখ-মন সয়ে গেছে। একবার তো একপাশের চাকার অর্ধেক মাটির বাইরে চলে গেল, আরেক গাড়ীকে পাশ দিতে গিয়ে। কিন্তু আমরা কিছুই যেন আঁচ পেলাম না, বিপিনের চালনার দক্ষতায়।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা শেষে একসময় সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে তের হাজার ফুট উচু রাস্তার ধারে সারি সারি গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমাদের গাড়ী সেগুলোকে পেছনে ফেলে আরেকটু সামনে গিয়ে পার্ক করল। গাড়ী হতে নেমেই পেলাম চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশে বয়ে যাওয়া কনকনে হিমেল হাওয়া। সেই জায়গা হতে ৫০০ ফিট উঁচুতে দুই কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে সাদা বরফের আস্তরণ। প্রতিটি পর্যটক ছুটছে সেই পানে। প্রায় সবারই গায়ে সেই ভাড়া করা জামা, দুয়েকজন ব্যতিক্রম আছে, যেমনটা আমাদের ইয়াসমিন আপা। দলের সবাই এগিয়ে গেল সামনে আমি ছবি তুলতে তুলতে সবার পেছনে চলছি। আমার ক্যামেরায় কোন মেমরি কার্ড কাজ না করায় পুরো ট্যুরেই আমার ছবি তুলতে হয়েছে মোবাইল দিয়ে। কিন্তু গ্লাভস হাতে টাচ স্ক্রিনে ছোঁয়া দিয়ে ছবি তোলা সম্ভব না। আর সেই তাপমাত্রা হাত থেকে গ্লাভস খুলে জাস্ট একটা ছবি তুলতেই হাত যেন জমে যাচ্ছিল ঠাণ্ডায়, দ্রুত ফের গ্লাভস পরে নেয়া। এভাবে করতে করতে আমি একসময় দল থেকে অনেক পেছনে পড়ে গেলাম। তাতে কি, আমি আমার মত চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। একসময় মধ্য বয়স্ক এক দম্পতিকে ক্রস করছি, তখন তারা অনুরোধ করল তাদের ছবি তুলে দিতে। ক্যামেরা এগিয়ে দিল, কয়েকটি ছবি তুলে দিলাম একটি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড ভাল করে নিতে বসে ছবি তুলতে গেলাম। বসে ছবি তুলছি এমন সময় হুট করে আমার জ্যাকেটের চেইন গেল ছিড়ে। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে লাগল সেই ফাঁক গলে। মিনিট পাঁচেক চেষ্টা করলাম জ্যাকেটকে জড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম। ফলে রিস্ক না নিয়ে আবার ফিরে এলাম গাড়ীর দিকে, তাও মিনিট দশেক সময় লাগল।
গাড়ীর সামনে এসে দেখি গাড়ী লক করা, বিপিনকে আশে পাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটা গাড়ী পেরিয়ে আরও পেছনের দিকে গেলে পরে দেখা মিলল তার। ছয়জন ড্রাইভার (সব ঐ একই এজেন্টের) একসাথে এক গাড়ীতে বসে গল্প করছে। আমায় দেখে বিপিন নেমে এল। তাকে বললাম, গাড়ী খোল, আমার জ্যাকেটের চেইন ছিড়ে গেছে। গাড়ী খুলে দিলে আমি ভেতরে গিয়ে সামনের সিটে বসলাম, বিপিন পুরো সিট এলিয়ে দিল, বলল চুপচাপ শুয়ে থাক কিছুক্ষণ, ঠিক হয়ে যাবে। ঐ সময় ঠাণ্ডার সাথে সাথে কিছুটা শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা শুয়ে রইলাম, মৃদু ভলিউমে গান চলছে, আর গাড়ীর জানালার কাঁচ ভেদ করে রোদে ঝলমল করা পাহাড়ের সারি পুরো ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলেই। দূরের পাহাড়ের চুড়োয় সাদা বরফের দলা। অদ্ভুত সুন্দর কিছু মুহূর্ত... মনে থাকবে আজীবন।
আধঘণ্টা পর আমার সাঙ্গোপাঙ্গ সব ফিরে এলে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম। তারা ফিরতেই বিপিন ভোল পালটে আমাকে পচাতে শুরু করল। সবাইকে অভিনয় করে দেখাল আমি নাকি ইয়া লম্বা জিহবা বের করে প্রায় যাই যাই অবস্থায় এসেছি, এসেই ফিট... এমন ফাজিল আর মজার ক্যারেক্টার মেলা ভার। কিছুক্ষণ এই খুনসুটি চলল, সেই সর্পিল পথে আমরা নেমে যাচ্ছি আবার মানালির দিকে। অক্টোবর মাসের সেই সময়ে রোহটাং পাস হয়ে লেহ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লাদাখ যাওয়া হল না। ইচ্ছে আছে আসছে সেপ্টেম্বরে মানালি দিয়ে লাদাখ হয়ে কাশ্মীর দিয়ে বের হওয়ার, একটা জীপ সাফারির, আয়জন এখনো পরিকল্পনা পর্যায়েই আছে, দল মোটামুটি তৈরী, এখন সব ফাইনাল করা। যদি যাওয়া হয়, তাহলে আশা করি আপনাদের জম্পেশ একটা ভ্রমণ কাহিণী উপহার দিতে পারব।
তো আর কি? আমাদের গন্তব্য তখন রোহটাং পাস হতে সোলান ভ্যালী’র দিকে... পাহাড়ি রাস্তার সর্পিল পথ বেয়ে নামার সময় করলাম ভিডিও। একমাত্র এই ভিডিওটার কিছু অংশই রয়ে গিয়েছিল, কারন মোবাইল দিয়েই রাতে হোটেলে ফিরে এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার দিয়েছিলাম। তাই আমার সেই ট্যুরের একমাত্র ভিডিও বলতে এই এক মিনিটের ক্লিপ।
আসুন দেখি আরও কিছু ছবি, ধৈর্য আছে তো?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:২১