আগের পর্বঃ মানালি-কুলু-মানিকারান (সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস ভ্রমণ ২০১৫)
মানালি থেকে মানিকারান যাওয়ার দিন সকাল বেলা আমরা পথিমধ্যে বিয়াস নদীতে যাত্রা বিরতি করি, উদ্দেশ্য ছিল এডভেঞ্চার রাইড, বোট রাফটিং। আমার মত পানসে অলস টুরিস্টের ভাগ্যে তো আর এক্সট্রিম কোন এডভেঞ্চার জুটবে না, তাই পাথুরে খরস্রোতা নদী বিয়াসে সাত কিলোমিটার ট্রেইলে একটা বোট রাফটিংই অনেক পাওয়া। আমাদের ড্রাইভার বিপিনকে মানালি আসার দিনই বলে রেখেছিলাম বোট রাফটিং এর কথা। ও ওর পরিচিত একটা বোট রাফটিং করায় এমন জায়গায় গাড়ী পার্ক করল। দরদাম করে জনপ্রতি ছয়শত রুপী চুক্তিতে আমরা চারজন সাতকিলোমিটার বোট রাফটিং এর জন্য রাজী হলাম। সাথে এক্সট্রা আরও চারশত রুপী দিতে হবে যদি রাফটিং এর ভিডিও করতে চাই। আমরা সানন্দে রাজী হলাম। দুঃখের ব্যাপার হল আমার মোবাইলে এই রাফটিং এর ভিডিও এবং ছবি ব্যাকআপ নিয়েছিলাম, থাকলে হয়ত শেয়ার করা যেত। কিন্তু ভাল খবর হল, ওরা ভিডিওটা একটা ডিভিডি’তে রাইট করে দিয়েছিল, সেটা আরেক ভ্রমণসঙ্গীর কাছে আছে নিরাপদে।
মানালি হতে কুলু যাওয়ার পথে আমরা নির্দিষ্ট রাফটিং পয়েন্টে যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম। এই রাফটিং পয়েন্ট এবং এর দূরত্ব সরকার কর্তৃক “হিমাচল ট্যুরিজম কর্পোরেশন” এর তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিভিন্ন কোম্পানি এখানে লাইসেন্স নিয়ে রাফটিং করিয়ে থাকে। ৩, ৫, ৭, ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বোট রাফটিং অফার দেখেছি। চাইলে এরচেয়ে বেশীও আপনি করতে পারেন। আমাদেরটা ছিল সাত কিলোমিটার, আধঘণ্টার মত সময়। প্রতিটি বোট রাফটিং এ পর্যাপ্ত সেফটি উপকরন এবং সুদক্ষ গাইড/চালক থাকে, থাকে তার নির্দেশনা। রেট এখানে ভেরিয়েবল, আপনার দরদাম করে নিতে হবে। এমনিতে এই আধঘণ্টার সাত কিলোমিটার রাফটিং রেট হল ২,০০০-২,৫০০ রুপী পার কাপল। কিন্তু আমরা আমাদের ড্রাইভার বিপিন এর কল্যাণে এবং কিছুটা আমাদের বারগেইন এর সুবাদে ২,৪০০ রুপীতে চারজন রাফটিং করেছিলাম।
দরদাম শেষে, সবাই লাইফ জ্যাকেট, হেলমেট পড়ে বোটে উঠে বসলাম। রাফটিং বোট বাতাসে ফুলানো বিশেষ ধরনের নৌকা, যা খুব হালকা, কিন্তু মজবুত এবং টেকসই। নৌকায় উঠার পর বছর বিশেকের আমাদের ড্রাইভার এন্ড গাইড, একটা নেপালি ধাচের উপজাতি ছেলে, সে আমাদের বোটে বসার কৌশল এবং বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন কমান্ডে আমাদের কি করনীয় তা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। তার কথাবার্তা শুনে একটু ভয়ই পেলাম। যাই হোক, সব প্রস্তুতি শেষে আমাদের যাত্রা শুরু, আর উপরে আমাদের ক্যামেরাম্যান একটা জীপ গাড়ী করে পাড় দিয়ে দিয়ে আমাদের ভিডিও করতে করতে ছুটে চলল। মাঝে মাঝে সে উধাও, কারণ পুরো পাড় ঘেঁষে রাস্তা নাই। হুট করে দূরে কোন এক ঝোপঝাড় এর আড়ালে তাকে দেখা যায়, আমাদের গাইড আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার দিকে, আমরা হাত নেড়ে, সেইরকম ভাব নিয়ে পোজ দিয়ে যাই। কিছুক্ষণ ভালই যাচ্ছিল, মাঝখানে কয়েকবার আপ-ডাউন কমান্ড দিল সে। আমরা মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়ে পজিশন নিলাম, কোথায় কি, অহেতুক কষ্ট, জাস্ট একটু পানির ঝাঁপটায় ভিজে গেলাম। শীতের মাঝে বরফ শীতল পানিতে পুরাই জমে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে শরীর এডজাস্ট করে নিল, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিল বিধায় মন্দ লাগছিল না।
এর মাঝে হুট করে গাইড বলে শক্ত করে ধরে বস, যখন কমান্ড দিব ঠিকঠাক মত করবে। আমি ভাবলাম, ধুর, ছ্যামরা হুদাই মজা লয়। যথারীতি কমান্ড, মাথা ঠিক মত নিচু করিনি, সাই করে একগাদা নোনা পানি নাকের মাঝে দিয়ে সোজা মাথার তালু পর্যন্ত পৌঁছে গেল, মাথার জ্বলুনি কাকে বলে। এরপর শুরু হল নৌকার সেইরকম দোলাদুলি। হুট করে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঢালু হয়ে ইয়া বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে ধপাস করে পড়ল পানিতে, একবার ডান দিকে কাত তো আরেকবার বাম দিকে। আর আমাদের গাইড মাঝখানে অবলীলায় বসে বসে নৌকা সামলাচ্ছে আর আমাদের কমান্ড দিচ্ছে। আর আমরা আপ এন্ড ডাউন করতে করতে পেরেশান। কিছুক্ষণের মাঝেই এই বিনোদন শেষ হল, দূরে একটা জায়গায় আমাদের সেই ক্যামেরাম্যান আর জীপগাড়ী দেখা গেল।
এখন আমাদের মাঝে আলোচনা, এরা আমাদের ঠকিয়েছে, কোন মতেই আধঘণ্টা হয় নাই, আর এতোটুকু পথ কোন মতেই সাত কিলোমিটার হবে না। বড়জোর তিন কিলোমিটার। আমি বুঝাতে গিয়ে ধমক খেলাম একটা। কিন্তু সরকারী দূরত্ব পরিমাপক বোর্ড দেয়া আছে, এখানে ঘাপলা কেম্নে করবে। যাই হোক, পাড়ে ভেরার পর নিজেদের ক্যামেরায় সবাই ছবি তুলে নিল। এরপর জীপ গাড়ীতে আমরা আর ছাঁদে সেই রাফটিং বোট, নিয়ে আমাদের স্টার্টিং পয়েন্ট এর দিকে যাত্রা শুরু হল। ওমা, রাস্তা তো শেষ হয় না, প্রায় পনের মিনিটের মত চলার পর পৌঁছলাম যাত্রা শুরুর সেই পয়েন্টে। তখন মুচকি হেসে শুধু বললাম, কি কত কিলোমিটার?
এবার সেখানের ড্রেস চেঞ্জ রুমে গিয়ে সবাই একএক করে ভেজা জামা পাল্টে নিলাম। পাশেই একটা ধাবা টাইপ খাবার দোকান, স্থানীয় এক মহিলা চালায়। উনাকে বলতেই চলে এল গরম গরম চা। শীতে কাবু হয়ে রোদের নীচে সেই চা ছিল অসাম। কিন্তু চা খাওয়া শেষে কাপগুলো রেখেছিলাম আমাদের সুইফট ডিজেয়ার গাড়ীর বনেটের উপর। সেই বনেটের ঢাল বেয়ে হুট করে সব কাপ পড়ে গেল এবং দুটি কাপ ভেঙ্গে একাকার। মহিলাকে বিল দিতে গিয়ে সরি বলে যতই ঐ কাপের দাম দিতে চাই, সে নিবেই না, তার এককথা, ‘দোকানদারিমে এয়সা হোতা হ্যায়...’। কি আর করা আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম, তার আগে ভিডিও এবং ছবি নিয়ে নিলাম ওদের কাছ থেকে। আমাদের গন্তব্য মানিকারান, গাড়ী ছুটে চলল, সেই গল্প তো আগের পর্বেই হয়েছে।
ফেরার সময় আমরা এলাম সেই কুলু তিব্বতীয় মনস্ট্রি দেখতে, নাম “HIMALAYAN NYINMPA BUDDHIST MONASTERY” যা KAIS Monastery of Kullu নামেও পরিচিত। এই মনস্ট্রিটি অধুনা তৈরি, ২০০৫ সালের মে মাসে দালাই লামা এটা উদ্বোধন করেন। বিয়াস নদীর তীরে অবস্থিত এই মনস্ট্রি হতে ছবির মত পাহাড়ি উপত্যকা, বিয়াস নদী আর সুদূরের পাহাড় সারি দেখলে আপনি সেখান হতে দৃষ্টি সরাতে পারবেন না। তাই সেখানে ঢুঁকে আমার সাথীরা যখন পুরো মনস্ট্রি ঘুরে ঘুরে ছবি তোলায় ব্যস্ত, আমি তখন একটা বেঞ্চে বসে প্রকৃতির রূপসুধা পানে মত্ত। কিন্তু হঠাৎ চেয়ে দেখি কালো রঙের ইয়া বড় এক কুকুর তার ধারালো দাঁত আর জিহবা বের করে আমার থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে! আমি ভয়ে জমে গেলাম, আশেপাশে কেউ নেই যে আমাকে সাহায্য করে। কি করি ভেবে যখন পেরেশান, তখনই একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু টাইপ ছাত্র সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, আমাকে দেখে বুঝল আমি ভয় পাচ্ছি। সে এগিয়ে এসে কুকুরটাকে ধরে নিয়ে গেল, কুকুর ব্যাটা নড়তে চায় না... তাকে কসরত করে সরানো হল, আমি জলদি করে দলের সাথে ভিড়ে গেলাম। সেখানে থেকে যখন বের হচ্ছিলাম, তখনও দেখি সেই কুকুর আমার দিকে চেয়ে আছে, যেন সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এই মনস্ট্রি কুলু হতে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি এমন একটা স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে যে, বিয়াস নদীর উভয় প্রান্ত থেকে এর পূর্ণ ভিউ পাওয়া যাবে। তিনদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা, সামনে বয়ে চলা বিয়াস, তার অপর পাশে আবার পাহাড়ের সারি উপত্যকা শেষে, মাথার উপর সুবিশাল নীলাকাশ... ভেবে দেখুন কি অপূর্ব। আসলে ছবিতে পুরোটা একসাথে ধরা সম্ভব না। এই মনস্ট্রি নির্মাণ করা হয় তিব্বতীয় জনগনের কালচার এবং ধর্ম বিকাশে ভুমিকা রাখতে, যার জন্য দালাই লামা বিশেষভাবে ভারতীয় সরকার এবং হিমাচল প্রাদেশিক সরকারকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছিল, যেখানে তিব্বতীয় নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে শুরু করে স্থানীয়রা অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে পর্যটকের দল মানালি আসলে অতি অবশ্যই এখানে ঢুঁ মারতে ভুল করে না।
আমাদের ঘণ্টাখানেকের ঘোরাঘুরি শেষে বিপিনকে ফোন দিতে সে দূরের পার্কিং থেকে গাড়ী নিয়ে চলে আসল, আমরা মানালির দিকে যাত্রা করলাম। সন্ধ্যের আগে আগে বিপিন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল মানালি মলের কাছে। আজ কিছুটা মলে ঘোরাঘুরি হবে, আগামীকাল যাত্রা রোহটাং পাস। আমাদের এই পনের দিনের ভারত সফরের আনুষ্ঠানিক শেষ গন্তব্য। এরপর ফিরতি পথে মানালি শহরের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে দিল্লী, সেখানে একটা রাত থেকে পরের দিনের বিমানে সোজা ঢাকা। দেশ ছেড়ে থাকতে আর ভাল লাগছিল না, মনে হচ্ছিল এখনই দেশে চলে যাই। আগামী পর্বে তাহলে রোহটাং পাসের পথে দেখা হবে সবার সাথে...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ৮:২৭