পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা – ‘পাঠক আমি, আমার কেমন ফড়িং চঞ্চল মন?’
লেখকের দায়িত্ব লিখে যাওয়া, নিজস্ব চিন্তার জগত থেকে, নিজস্ব যুক্তিবোধের আঙ্গিকে, নিজস্ব জ্ঞানের আলোকে। এরপর তা পাঠকের দায়িত্ব সেই সাগর সেঁচে মুক্তা আহরণ করা। একজন নিয়মিত এবং মনযোগী পাঠক যেন একজন রত্নসন্ধানী, তার কাজই হল প্রতিটি লেখা থেকে রত্ন খুঁজে বের করা। প্রতিটি লেখাই তার কাছে অমূল্য, প্রতিটি লেখাই একটি অপার সম্ভাবনার আঁধার, প্রতিটি লেখার মাঝে ডুব দিয়েই সে খুঁজে পেতে চাইবে মুক্তোখণ্ড। কিন্তু একটি জহুরী যে পরিমান সময় দিয়ে একটি হীরকখণ্ড’কে হীরেতে রূপান্তর করে তোলে, একজন পাঠক হিসেবে কি আমি সেই সময়টুকু যে কোন লেখাকে দিচ্ছি? আপনি বলতে পারেন, লেখক যদি ছাইপাশ লিখেন, তাহলে সেখানে রত্ন খুঁজে কি লাভ? আরে ভাই, কয়লাই কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় হীরকে রুপান্তরিত হয়। তাই, আমি মনে করি একজন যৌক্তিক আগ্রহী পাঠক হিসেবে প্রতিটি লেখাই একটি অমূল্য লেখা, কারণ প্রতিটি লেখার মাঝেই থাকে পাঠকের জন্য মুক্তো সন্ধানের সম্ভাবনা। এখন পাঠক হিসেবে আমার দায়িত্ব সেই মুক্তোটি খুঁজে বের করার জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং চেষ্টা বিনিয়োগ করা। কিন্তু আদৌ কি আমি তা করছি এই পাঠ প্রক্রিয়ায়?
মনে পড়ে টিনএজ বয়সের শেষে যখন গল্প-উপন্যাস পড়াটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল সেই সময়টার কথা। এলাকার পঞ্চাশ বছরের পুরানো একটা গ্রন্থাগার ছিল, আমি ছিলাম তার আজীবন সদস্য, এখনও আছি। তখন একটা বই হুট করে ফুঁড়িয়ে যেত বলে আমি আমার ছোট ভাই আর একজন বন্ধুর নামে আরও দুটি সদস্যপদ নেই, যাতে করে একদিনে তিনটি বই বাসায় নিয়ে আসতে পারি। আর এখন ব্লগে ঢুকলে কিন্তু লেখার অভাব নেই, কেউ যদি চায়, তো সারাদিন পাঠ করেও লেখা শেষ করতে পারবে না, আমিও পারব না। কিন্তু সেই আগেরমত পড়া হয়ে ওঠে না, দেয়া হয় না সেই অখণ্ড মনোযোগ। কেন? সেই কথায় যাওয়ার আগে যে বিষয়টি বলতে চাই, তা হল লেখার মান ভাল না, এই যুক্তি দিয়ে পাঠক হিসেবে আমি ছাড় পেতে আগ্রহী নই মোটেও। তাই শুরুতেই অনেক কথা বলে নিয়েছি। এবার এর স্বপক্ষে একটা উদাহরণ দেই। দেশের স্বনামধন্য এবং ক্রিটিকসদের কাছে সস্তা জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটি অখ্যাত উপন্যাস থেকে একটি অনুচ্ছেদের তিনটি ভিন্ন পাতার তিনটি ছোট প্যারা তুলে ধরছিঃ
১.ইমন ভেবেছিল প্রথম যখন সে তার বাবাকে দেখবে, চিনতে পারবে না। বাবার চেহারা তার মনে ছিল না। নিউ জার্সির বাড়িতে বাবার ছবি থাকলে সে ছবি দেখে চেহারা মনে করত। কিন্তু সেই বাড়িতে তাঁর কোন ছবি নেই। মা’র পুরনো অ্যালবামে হয়তো আছে, কিন্তু মা অ্যালবাম তালাবন্ধ করে রাখে। ফ্যামিলি রুমে ফায়ারপ্লেসের পাশে কিছু অ্যালবাম রাখা আছে। সেখানে সবই নতুন ছবি। পুরনো ছবি একটাও নেই।
২.বাবার আরেকটা জিনিস ইমনের খুবই ভালো লাগল। তাঁর মধ্যে ন্যাগিং ভাব নেই। সে যখন বলল, হাতের জিনিসটা দেয়া যাবে না, তখন বাবা এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করেন নি। অন্য যে কেউ হলে বলত, কেন দেয়া যাবে না? মা শুধু এই প্রশ্ন করেই চুপ থাকত না। মা বলত, দেখি প্যাকেটটা খোল। আমি দেখতে চাই এমন কী মহার্ঘ বস্তু যা আমার হাতে দেয়া যাবে না।
৩.জীবনের প্রথম চা ইমন বানাল রাত ন’টায়। তাঁর কাছে মনে হলো, প্রথম কাপ চা বানিয়ে সে হঠাৎ অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। শওকত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে চলে। তবে তেমন ভালো হয় নি। দুধ বেশি হয়েছে। চিনিও বেশি হয়েছ।আমার ধারনা পরের বার থেকে ঠিক হয়ে যাবে। ইমন লক্ষ্য করল, তাঁর বাবার সঙ্গে তাঁর মায়ের একটা বড় ধরণের আমিল আছে। ইমনের বানানো প্রথম চা যত খারাপই হোক, মা চুমুক দিয়েই বলত- অসাধারণ হয়েছে। আমি আমার জীবনে এত ভালো চা খাই নি। বাবা সে-রকম বলে নি।
[যদিও সন্ধ্যা – হুমায়ূন আহমেদ; অন্যপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ৪৬-৫৪]
চার-পাঁচ লাইনের প্রথম প্যারা, সাদামাটা বিবরণ, কিন্তু পাঠক হিসেবে আমার কাছে অনেক কিছু বলে গেছে, এখন আমার দায়িত্ব সেই না বলা কথাগুলো বুঝে নেয়া, উপলব্ধি করা। ইমন, ছোট একটি ছেলে যে মায়ের সাথে নিউ জার্সি থাকে, মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর সাথে। ইমন একটি ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান, যে বাবাকে মিস করে, কেননা বাসায় বাবার কোন ছবি নেই, এটি নিয়ে সে সজাগ, এ থেকেই বুঝা যায়। সে তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে লক্ষ্য করছে এখনকার সব ছবি থাকলেও আশেপাশে পুরানো ছবি নেই। সে এটাও জানে তা মায়ের কাছে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। আবার একটু ভাবা যাক ইমনের মায়ের কথা, সে সচেষ্ট ছেলেকে নতুন পরিচয়ে, নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত করাতে। তাই পুরানো স্মৃতি আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করছে। একইভাবে সেই স্মৃতিসব নষ্ট করতে চাচ্ছে না, আগলে রাখছে সযত্নে, তালাবদ্ধ করে। এভাবে পাঠক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল না বলা কথাগুলো খুঁজে ফেরা, কিন্তু তা কি খুঁজে ফিরি প্রতিটি পাঠে? আমার ‘কুঁড়িয়ে পাওয়া সাজা’ নামক একটি ছোট গল্পে শেষে নোট দিয়ে গল্পের কিছু সমাপ্তি ব্যাখ্যা করেছিলাম, অনেকেই এর সমালোচনা করেছিলেন, আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ব্লগার আরণ্যক রাখাল এর মন্তব্যটি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না: শেষটা আরও ভালো হতে পারতো। আপনি সারসংক্ষেপের মতপ কিছু কথা লিখেছেন, যেটা আমার একটুও ভালো লাগেনি। আসলে আপনার কাজ গল্প লেখা, সেটা বুঝতে পারার দায়িত্ব পাঠকের, আর বঝাতে চাইলে সেটা গল্পের মাধ্যমেই বঝাতে হবে, নোট দিয়ে নয়।
আসলেই তো ঠিক কথা, এতটুকু দায়িত্ব কিন্তু পাঠক’কে নিতেই হবে। লেখক-পাঠক পারস্পরিক দায়িত্ব রয়েছে। আমি নিজেই অনেক অনেক গল্প-কবিতা পোস্টে গিয়ে একবার পড়েই কমেন্টে বলে আসি, বুঝি নাই। একটু ভদ্রতা করে বলি, হয়ত এটা আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা। অথচ আমি দুবার, চারবার পড়ে বুঝার চেষ্টা কেন করলাম না? বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় উপন্যাস, বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ আমি ছয়বার লাইব্রেরী থেকে তুলেছিলাম, সপ্তম্বারের চেষ্টায় পুরোটা পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম। তাঁর আগে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ পাতা পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার প্রথমবার পুরোটা পড়ার পর কিন্তু আরও তিন-চারবার পড়েছি এই উপন্যাস। তো কেন ছিল এই চেষ্টা? বিখ্যাত উপন্যাস, পড়তেই হবে। তো, ব্লগে কেন সহব্লগারের লেখাকে তেমনভাবে মুল্যায়ন করে সময় দিয়ে পড়া হয় না আমার? আমি পুরো লেখায় আমায় নিজেকে দোষারোপ করছি, আপনি চাইলে নিজেকে আমার জায়গায় ভেবে নিতে পারেন।
উল্লেখিত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের বাকী দুটি প্যারা নিয়ে কয়েক পাতা আমি লিখতে পারি, তাতে লেখার পরিধি বড় হয়ে যাবে বলে সেই পথ হাঁটছি না। যে কথা বলতে এসেছিলাম, পাঠক হিসেবে আমার ব্যর্থতা। আসলে এখন ব্লগিং হয় ফেসবুক স্টাইলে, আর ফেসবুকে চলে ব্লগিং। একটা মন্তব্য হওয়া উচিত বিশ্লেষণাত্মক, পাঠ শেষে আমার অনুভূতি, মতামত, অনুধাবন এর সাথে লেখার ভালো-মন্দ দিক নিয়ে কিছু মতামত। কিন্তু এতো সময় কোথায়? আমাকে যে রোজ শখানেক পোস্ট পড়তে হবে, নইলে আমার পোস্টে পাঠক পাবো না, মন্তব্য পাবো না। অথচ, একটি পরিপূর্ণ মন্তব্য, একটি পোস্টের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। ব্লগে তিন বছর হতে চলল নিয়মিত এবং মোটামুটি একটিভ ছিলাম, অথচ তেমন মন্তব্য করতে দেখেছি খুব হাতে গোনা; আর নিজে কখনো করেছি কি না মনে পড়ে না। এখানে আরেকটা সমস্যা আছে, লেখক যেমন সমালোচনা সহ্য করেন না, মন্তব্যকারী’রাও কিন্তু লেখকের আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া উত্তর সহজভাবে নিতে পারেন না। একারনে ব্লগে এখন কার্টেসি মেইনটেইন করে মন্তব্য করা হয়, তাঁর প্রতিত্তর দেয়া হয়।
আরেকটা ব্যাপার হল ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কিছু লেখক-পাঠকে আমরা বন্দী হয়ে থাকি বেশিরভাগ সময়। অনুসারিত আর নির্বাচিত পোস্টের বাইরে পোস্ট অনেক সময় পড়াই হয় না। আর সবমিলে যতগুলো পোস্ট পড়া হয়, তাঁর বেশিরভাগই ক্যাজুয়ালি, চোখ বুলিয়ে যাওয়া। সিরিয়াস পাঠকই সিরিয়াস লেখক তৈরি করে, তাই আমি যদি যেনতেন করে একটা পোস্ট পড়ে বেড়িয়ে আসি তাহলে কিন্তু আমি ঐ লেখককে আমার চাহিদা জানান দিতে ব্যর্থ হলাম। অথচ মনোযোগ দিয়ে পড়ে, ভালমন্দ উভয় দিক নিয়ে ছোট্ট করে একটা অভিমত রেখে আসি, তাহলে লেখক উপকৃত হবে, পাঠক হিসেবে আমার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, সাথে অন্য পাঠকেরাও এতে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। এরকম করে যদি শক্তিশালী শ’দুয়েক পাঠক এই ব্লগে পাওয়া যায়, তবে শক্তিমান শখানেক লেখক পাওয়া যাবে অতি শীঘ্রই। আর এরকম শখানেক লেখক যখন নিয়মিত লিখবে সামুর আঙ্গিনায়, তখন ভিজিটর এমনিতেই বাড়বে, বাড়তে বাধ্য। আমি নিজেই তখন আমার পরিচিতজনদের সেই লেখা পড়তে দিব। ব্লগার জাফরুল মবীন, বশর সিদ্দিকী’র বেশ কিছু পোস্ট আমি আমার কাজিন রিলেটিভদের পড়তে দিয়েছি, প্রিন্ট করে, মেইল করে, শেয়ার করে। নিয়মিত যখন ভালো লেখকদের লেখা প্রকাশ পাবে, পাঠক ঠিকই খুঁজে নেবে। আর সিরিয়াস টাইপ লেখার যখন মূল্যায়ন পাঠক হিসেবে আমি করব, আপনি করবেন, তখন আমরাই কিন্তু সচেষ্ট হব সিরিয়াস টাইপ পোস্ট করতে, লেখা লিখতে। এখন সবাই লিখি, সরি, বলি আমি লিখি, হিটের জন্য, আমার পোস্ট কতজন পড়ল, কতটি মন্তব্য পেলাম, পেলাম লাইক এই নিয়ে ভেবে মরি। ফলে পোস্ট নির্বাচন করার ক্ষেত্রে মাথায় থাকে পোস্ট হিট হবে কি না তা। শিরোনাম, পোস্ট প্রচ্ছদ আর প্রথম প্যারা এমন কিছু দিয়ে শুরু করতে হবে যেন পাঠক পড়তে আসে। কিন্তু কেন এমন হয়? কারণ পাঠক এগুলো তাদের চাহিদা হিসেবে লেখকের মনে তথ্য প্রদান করেছে সময়ে সময়ে।
ভ্রমণ সঙ্কলন করার সময় এমন অনেক ভালো পোস্ট দেখি যার পাঠক সংখ্যা দেখে লেখকের জন্য মায়া হয়, এতো ভাল লেখা, কিন্তু পাঠক পড়ল না। আবার অনেক ফাও পোস্টে হিট আর কমেন্টের ছড়াছড়ি। মোদ্দকথা হল, পাঠকই কিন্তু লেখার ধরন এবং লেখক’কে নিয়ন্ত্রণ করেন; পাঠকের রুচির চাহিদার পথ ধরে পরিবর্তিত হয় লেখকের লেখার গতিপ্রকৃতি। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম পাঁচটি উপন্যাসের সাথে শেষের পঞ্চাশটা উপন্যাসের মিল পাবেন না। কারণ কি? কারণ ঐ একটাই, পাঠকের চাহিদা। তাই, আসুন একজন ভাল পাঠক হওয়ার চেষ্টা করি, তবেই আরও ভাল লেখা পাব সামহোয়্যার ইন ব্লগে। ভাল লেখা যত বাড়বে, ততই বাড়বে পাঠক সংখ্যা, ভিজিটর সংখ্যা। আর এভাবেই হয়ত একদিন আমাদের প্রিয় ব্লগের পাঠক সংখ্যা প্রতিদিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
কথা দিচ্ছি, প্রতিবার লগইন করে একটি লেখা হলেও যত্ন সহকারে অতি মনোযোগ দিয়ে পড়ব, সুযোগ হলে প্রতিদিন। শিরোনামে বলা কথাটির প্রয়োগ ঘটাতে চাই, ‘একজন মনোযোগী পাঠকই পারে একজন সৃষ্টিশীল লেখকের উন্মেষ ঘটাতে’। একদিনে পঞ্চাশটি নয়, পাঁচটি পোস্ট পড়ি, পড়ার মত পড়ি, পড়ার পর ভাবনার জগতে বিচার বিশ্লেষণ করি, গঠনমূলক একটি মন্তব্য করে ব্লগীয় পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া অর্থবহ করে তুলি। নিজের পাঠক মনের খোরাক হোক প্রতিটি পাঠ, তৃপ্ত হোক মন। ব্লগ হোক মেধা-মনন উৎকর্ষতার স্থান, টাইম পাস বা গসিপিং এর নয়। আমি চেষ্টা করব আজ থেকে ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে এটাকে বাস্তবায়ন করতে।
উৎসর্গঃ দেরীতে হলেও, এটাই রইল এবারের ‘ব্লগ ডে’ উপলক্ষ্যে সহব্লগারদের জন্য বোকা মানুষের উপহার। শুভ ব্লগিং।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩১