ঠিক কবে থেকে আমাদের মাঝে ভাব হয়েছিল, হয়েছিল বন্ধুত্ব তা আজ মনে নেই। আদৌ তেমন কোন অফিসিয়ালি ফ্রেন্ডশিপ হয়েছিল কি না তাও মনে নেই। যতদূর মনে পরে আমরা চারজন ক্লাস ফাইভ অথবা সিক্স হতে একসাথে হয়েছিলাম, স্থান ক্লাসের একেবারে শেষ বেঞ্চটা। স্যারেরা বলত, ‘ব্যাক বেঞ্চার’ আর আমরা গর্ব ভরে বলতাম ‘ব্যাড বেঞ্চার’। প্রতি বছর ক্লাস চেঞ্জ হত অথবা হত না, কিন্তু আমাদের চারজনের ঠিকানা ছিল ঐ একটাই, ক্লাসের সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চটা। অলিখিত কোন এক দলিল বলে ওটা যেন আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, ছিল আমাদের সাম্রাজ্য, আমাদের ‘ব্যাড বেঞ্চার’দের জগত।
সুবল, মিজান, জাহিদ আর আমি, দিদার; এই চারজনের দল ছিলাম আমরা। ক্লাসের বাকী সব ছেলেদের চাইতে আমাদের জগত, আমাদের চিন্তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের জগতে পড়ালেখা’র কোন স্থান ছিল বলে মনে পরে না। রাজ্যের যত দুষ্টুমি আর বদমায়েশি ছিল আমাদের সিলেবাস। সিক্সে থাকতেই শুরু হয়েচ্ছিল সিগারেট ফুঁকার হাতেখড়ি; আর এগুলোর লিডার ছিল মিজান, আমরা ডাকতাম মিজাইন্যা বলে। রাজ্যের যত নিষিদ্ধ কাজে ছিল মিজাইন্যার আগ্রহ, তার হাত ধরেই আমাদের ব্যাড বেঞ্চারদের ব্যাড হয়ে ওঠা। প্রথম সিগারেট, প্রথম বড়দের নিষিদ্ধ গল্প-ছবি, প্রথম নীল ছবির সন্ধান সবই ছিল মিজানের আবিষ্কার। আমরা বাকী তিনজন ছিলাম তার ফলোয়ার।
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি আমরা, আমাদের প্রাইমারীর ক্লাসমেটরা ততদিনে কলেজে পা রেখেছে, জাহিদ ছাড়া আমরা তিনজনই বুঝি নাপিতের হাতে গালের শোভা বাড়িয়ে ফেলেছি ততদিনে। একদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে সবাই মাধববাবু’র জমিদার বাড়ীর দীঘি’র পাড়ে আড্ডা দিচ্ছি, মিজান বলল, ‘দোস্ত চল, আমার এক মামার বাসায় যেতে হবে, জরুরী কাজ আছে। ফেরার পথে স্পেশাল খাওয়াব’। স্পেশাল কি তা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। যাই হোক, বদের হাড্ডি আমাদের যেখানে নিয়ে গেল তা আমরা কল্পনাও করতে পারি নাই। জায়গাটা ছিল আমাদের পাশের ইউনিয়নের নিষিদ্ধ পল্লী। সেখানে গিয়ে এই কথা শোনার পর সুবলের কি কান্না, ওর কোন কাকা নাকি এই এলাকাতেই থাকে। সুবলের কান্না দেখে আমরা হাসতে হাসতে শেষ। একি আমাদের সেই সুবল, আমরা যাকে গুণ্ডা সুবল বলি। ডানপিটে সুবলের মারামারি খ্যাতি আমাদের স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আশেপাশের পাঁচদশটা স্কুল অবধি পৌঁছেছিল। শেষের দিকে তো, কোথাও কোন গণ্ডগোল বাঁধলে সুবলকে হায়ার করে নিয়ে যেত। সেই সুবলের কান্না দেখে হাসি আসাটাই স্বাভাবিক ছিল, তাই না। আসলে সুবলের আত্মসম্মানবোধ তখনও মরে যায় নাই, আর আমাদের আদৌ কখনো ছিল কিনা তা এক বিশাল প্রশ্ন।
জাহিদ ছিল সবচেয়ে মিচকা শয়তান, ওর মাথায় ভর করত রাজ্যের সব দুষ্টবুদ্ধি। টাইগার রফিক স্যার ছিল স্কুলের সবচেয়ে রাগী স্যার, তাকে দেখলে পুরো স্কুল কাঁপত। সেই স্যারকে টয়লেটে একবার তালা মেরে দিল! পাক্কা আধঘণ্টা টয়লেটে বন্দী ছিলেন টাইগার রফিক স্যার। হাজারো এমন কাজ নিত্যকার রুটিনে ছিল আমাদের জাহিদের, আমরা তাকে ডাকতাম জ্যাডহ্যাড। যুগে যুগে সকল ক্লাসেই কিছু স্টুডেন্ট থাকে যাদের কাজ হয় ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হওয়া, যেমন আমাদের কাজ ছিল প্রতি এক্সামে সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট করা। তো, তখন আমাদের ক্লাসে ফার্স্টবয় অজিত, তার জন্মদিনে সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিল, আমরাও বাদ গেলাম না। পরেরদিন স্কুলে যেতে হেডমাস্টার আমাদের চার পাণ্ডবকে তলব করলেন, তারপর আচ্ছামত ধোলাই। সবচেয়ে বেশী ধোলাই খেয়েছিল মিজান, মজার ব্যাপার ও অজিতের জন্মদিনেই যায় নাই। স্কুল শেষে ঘটনা জানা গেল, গিফটে কে যেন অজিতকে র্যা্পিং করে প্রাপ্ত বয়স্কদের চটি বই গিফট করেছিল। গিফট খোলার সময় সরাসরি তা অজিতের বাবার হাতে! আমরা হাসতে হাসতে শেষ, এটা ছিল জাহিদের কাজ। ও আগেই বলেছিল অজিতের জন্য স্পেশাল গিফট নিয়ে যাবে, তাই বলে এমন গিফট তা আমাদের মাথায় আসে নাই। মজার উপর আরও মজা ছিল, দোষ করল জাহিদ, ধোলাই খেলাম সবাই, আর সবচেয়ে বেশী ধোলাই খেল মিজান। মজার ব্যাপার এই অজিতই কিন্তু মেট্রিক পরীক্ষার পর মাস তিনেক সারাদিন আমাদের সাথে ঘুরেছে, আড্ডাবাজী করেছে, আর বাকীটুকু নাই বা বললাম।
মনে আছে, টেস্ট পরীক্ষার পর, একদিন স্কুলে অজিতসহ আরও কিছু গুডু বয়ের সাথে দেখা, জিজ্ঞাসা করল, প্রিপারেশন কেমন? আমার উত্তর শুনে সবকয়টা হ্যাবলার মত চেয়ে রইল। উত্তরটা মজার ছিল, ‘ফটোকপি সব শেষ, কাইট্যা সাইজ করা বাকী আছে’। আসলে আমাদের কাছে পড়ালেখাটা ছিল ভয়াবহ টর্চার, কেন যে ‘পড়ালেখা’ নামক জিনিষটা দুনিয়াতে আছে খোদাই জানে। স্কুলের শেষের দিকে সুবলের পকেটে সবসময় একটা লাল রঙা বাটের ক্ষুর থাকত। এই প্রসঙ্গ উঠলে সুবল ক্ষুরটা হাতে ঘষে ঘষে বলত, ‘যে ব্যাডায় পড়ালেখা আবিষ্কার করছে, হালারে পাইলে একটানে ভুঁড়ি নামায়া দিতাম।’
স্কুলে মোটামুটি সকল টিচার আমাদের দুচক্ষে দেখতে পারতেন না, সুযোগ পেলেই বেতের মাধ্যমে মনের ঝাল মেটাতেন। সবচেয়ে বেশী খ্যাপা ছিলেন বাংলা ব্যাকরন স্যার, জয়নাল স্যার। জয়নাল স্যারকে নিয়ে এতো মজার ঘটনা আছে যে বলে শেষ করা যাবে না। স্যার তখন নতুন বিয়ে করেছেন, থাকেন স্কুলের লাগোয়া কোয়ার্টারে। টিফিনের পরের পিরিয়ড ছিল জয়নাল স্যারের। ক্লাস শুরু হয়েছে সবেমাত্র, আমরা গল্পে তখনো মশগুল। দেখি ক্লাসে পোলাপাইনসব ফিসফাস করে আরে ঠোঁট টিপে হাসে। ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেল, জয়নাল স্যারের প্যান্টের চেইন খোলা। ধীরে সংক্রামক ব্যাধির মত পুরো ক্লাসে হাসি ছড়িয়ে পড়তেই স্যার টেবিলে ডাস্টার দিয়ে শব্দ করে চিৎকার করলেন, ‘সাইলেন্ট, চুপ সব। এতো হাসি কিসের? মনে রঙ লাগছে?’
মিজাইন্যা হুট করে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘স্যার আপনার পোস্ট অফিসের দরজা খোলা’
মিজান আর জয়নাল স্যারের আরেকটা মজার ঘটনা ছিল, ক্লাস টেনে, প্রিটেস্ট পরীক্ষা খাতা দেখানো হচ্ছে। ক্লাসে ভালো ছাত্র যারা, সবার খাতা মোটামুটি দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেউই ভালো মার্ক পায় নাই। সবার শেষে স্যার মিজানের নাম বললেন, মিজান হাইয়েস্ট নাম্বার পেয়েছে, পঞ্চাশে উনপঞ্চাশ। স্যার মিজানকে বললেন টিচার্স কমনরুম থেকে বেত আনতে, গুডু গুডু স্টুডেন্ট সবার চেহারা শুকিয়ে কাঠ, আর আমরা খুশীতে ডগমগ করছি। কিন্তু মিজান বেত নিয়ে ফেরার পর সবার আক্কেলগুড়ুম! স্যার সমানে মিজানকে পেটাতে শুরু করে দিলেন! এতো ভালো নাম্বার পেয়ে রাম ধোলাই! সবশেষে যা জানা গেল, মিজান যে প্রশ্ন’র ভুল উত্ত দিয়েছিল তা ছিল, ‘দুই বর্ণের মিলনকে কি বলে?’। মিজান যে উত্তরে টিক দিয়েছিল, তা হল, ‘কারক বিভক্তি’!!!
যেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিল, আমাদের চারজনের যেন চাঁদরাত ছিল। মাঞ্জা মেরে সবার আগে আগে স্কুলে গেলাম, যথারীতি রেজাল্ট হল। রেজাল্ট দেয়া শেষে আমরা রওনা হলাম স্কুল থেকে সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে, এমন দিনটা সেলিব্রেট না করে পারা যায়? স্কুল গেট থেকে বের হবার সময় অজিতের সাথে দেখা। ও এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে তোরা কোথায় যাচ্ছিস?’ জেলা মেধা তালিকায় ও দ্বিতীয় হয়েছে, চোখেমুখে খুশী ঝরে পড়ছে। জাহিদ বলল, ‘সিনেমা দেখতে। যাবি?’ ও মাথা নেড়ে না বলল, সাথে প্রশ্ন, ‘তোদের রেজাল্ট কি?’ সমস্বরে আমাদের উত্তর ছিল, ‘আবার জিগায়... ফেইইইইলল।’
মেট্রিকের পরে মিজান ছাড়া আমাদের সবার স্কুলের পাঠ চুকিয়ে নানান পথে যাত্রা করতে হল। আমি জয়েন করলাম সুপার মার্কেটের এক দোকানে, ঝাড়ামোছা’র কাজে। জাহিদ একটা লেদমেশিনের ফ্যাক্টরিতে। আর সুবল এলাকার দাদাগিরিতে। মিজান পরেরবছর মেট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল ‘ব্যাড বেঞ্চার’দের সেই ‘ব্যাক বেঞ্চ’গুলো।
দুই যুগ আগের কথা, আজো চোখে ভাসে সব। গতকাল রাতে টিভি নিউজে দেখলাম সুবল ক্রসফায়ারে মারা গেছে। বুকের খুব গভীরে কোথায় যেন প্রচণ্ড একটা কষ্ট অনুভূত হল। এ কিসের অনুভূতি আমি জানি না। আমার মত সুপারমার্কেটের সেলসম্যানদের অনুভূতি নামক শব্দ’র সাথে কোন পরিচয় নাই। মাস তিনেক আগে মিজানের সাথে দেখা হয়েছিল, মতিঝিলে। স্যুটটাই পড়ে পুরোপুরি অফিসার, আমাকে দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়েছিল, চিনেও না চেনার ভান। নাম ধরে ডাকতে গিয়েও থেমে গেছি, যে পরিচয়কে ও অস্বীকার করতে চাচ্ছে, সেই পরিচয়ের সুত্র ধরে ডাক দেয়ার কোন মানে হয় না। জাহিদ নিজের লেদমেশিনের ফ্যাক্টরি দিয়ে সুখেই আছে, কখনো দেখা হলে হই হই করে জড়িয়ে ধরবে; শুরু হবে গল্প। জোর করে ধরে নিয়ে যাবে তার কারখানায়। এরপর সেইরকম খানাপিনার আয়োজন। বোঝা যায় ব্যবসা ভালোই জমিয়েছে শালার ব্যাটায়। আমি অস্বস্তি বোধ করলে জোরে হাসতে হাসতে বলবে, ‘শোন মামা, সবার উপর সইত্য হইল, উই আর ব্যাক বেঞ্চারস। না না না, ‘ব্যাড বেঞ্চারস’।’
উৎসর্গঃ জীবন চলার পথে ফেলে আসা সকল ব্যাক বেঞ্চার তথা ব্যাড বেঞ্চার বন্ধুদের, "দোস্ত তোরা ভালো থাকিস"।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৫