প্রতি রমজানের শুরুতেই সকল মিডিয়ার আলোচ্য খবর হয় পুরাতন ঢাকার চকবাজারের ইফতার। প্রথম কয়েকদিন এই খবরই দখল করে রাখে পত্রিকার প্রথম পাতার কিয়দংশ। আজকের দিনে পুরাতন ঢাকার ইফতার মানেই হল চকবাজারের ইফতার। কিন্তু সেখানে কি আসলেই ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সব ইফতারের খাবারগুলো পাওয়া যায় অথবা বিক্রয় হয়? চকের ইফতারি বাজারের বয়স চার শ’ বছরের পুরনো। ইতিহাসবিদের মতে, ঢাকার বয়সের সমান চকবাজারের ইফতারির বাজার।
যতদূর জানা যায়, ১৭০২ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ চকবাজারকে আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। আর এই বাজারস্থ চকবাজারের শাহী মসজিদের সামনে একটি কূপ ছিল। তার চারপাশেই চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে বিক্রি করা হতো ইফতারের বিভিন্ন উপকরণ। নাজির হোসেনের 'কিংবদন্তির ঢাকা' বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজার জমজমাট হয়। রোজার সময় মোগলাই খাবার এবং রকমারি ইফতার বিক্রি করা হতো এখানে। বিশ শতকের প্রথম দিকেও ঢাকায় ইফতারির বাজার বলতে শুধু চকবাজারকে বোঝাত। বিংশ শতকের শুরুর দিকেও এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তবে চল্লিশের দশকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে ইফতারির অস্থায়ী দোকান। এটা অবশ্য চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইফতারির সঙ্গে যোগ হয় গ্রামবাংলার পিঠা-পুলি। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রমজান ও ইফতারের আয়োজন ও বৈচিত্র্য বেড়ে যায় অনেক গুণ।
তো কি ছিল সেই ইতিহাসখ্যাত ইফতারের পদগুলো? আসুন দেখে নেই সেইসব ইফতার মেন্যুর খাবারগুলো আর মিলিয়ে নেই আজকের চকবাজার ইফতার বাজারে খুঁজে পাওয়া খাবারগুলোর সাথে।
ঢাকার খাবারের পুরো ইতিহাস জুড়েই রয়েছে মোঘলদের ছাপ। ষোড়শ শতকে মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়ে ঢাকায় ডেরা ফেলার সময়টায় তারা সাথে করে নিয়ে আসে তাদের রাঁধুনি দলকে। কারণ, মোঘলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আরাম আয়েশ আর বিলাস বহুল জীবনাচার যার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল তাদের মুখরোচক নানান খাবার দাবার। আর এসব খাবারের অন্যতম উপাদান ছিল হরেক রকম মশলা আর তেলের যথেষ্ট ব্যবহার। আর মোঘলদের এই বিলাসী জীবন যাপনের জন্য সাথে করে বয়ে আনা কর্মচারী-খানসামা-বাবুর্চি একসময় যথেষ্ট হয়ে উঠে না, ফলে আশেপাশের লোকালয় হতে বহু লোকের চাকুরী জোটে মোঘল পরিবারসমূহে। অন্যান্য পদের মত হেঁসেলেও স্থান হয় কতিপয় রন্ধন কারিগরের। আর তাদের হাত ধরেই মোঘল খাবার প্রাসাদের বাইরে বিস্তৃতি পায়।
মোঘলরা তাদের বিলাসী জীবনাচারের ধারাবাহিকতায় রমজানের ইফতারকে উৎসবে পরিণত করে। আর সেই ধারা ধীরে ধীরে ক্রমবিকশিত হয় তৎকালীন ঢাকা এবং এর আশেপাশের জনপদে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের বাহারিস্থান-ই-গায়বী গ্রন্থে লিখেছেন, ১৬১০/১৬১১ সালের দিককার কথা। মির্জা নাথান তখন এখানকার সেনাপতি। এই এলাকায় সেটা ছিল তার প্রথম রমজান। পরিবার পরিজনের কথা ভেবে তার মন খারাপ, পরিবারের সাথে ইফতারের কথা ভেবে মন বড়ই কাতর। দিল্লীর পুরনো সেই দিনের কথা ভেবে বিষণ্ণ মনে বন্ধু মির্জা আলম বেগের তাঁবুতে হাজির হলেন তিনি, সেখানে তার ইফতারের দাওয়াত ছিল। সেদিন সেখানে নানান গণ্যমান্যজনের ইফতারের দাওয়াত ছিল। মির্জা নাথানের সেখানে পৌঁছেতে একটু দেরী করে ফেলেছিলেন। পর্দা সরিয়ে তাঁবুর ভেতর প্রবেশ করে দেখলেন ইফতারের আয়োজন মোটেও মন্দ নয়, অনেকটা তার দিল্লীর ইফতার আয়োজনের স্বাদের মতন।
এরকম নানান ঐতিহাসিক সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে পুরাতন ঢাকার ইফতারের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, সেখানে দেখা যায় নানান রুটি আর কাবাবের প্রাধান্য। রুটির মধ্যে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় ছিল মোঘল সেনাদের তাবুর জনপ্রিয় পদ ‘নান তাফখান’, যা ছিল মূলত বাদামমিশ্রিত গমের একপ্রকার রুটি। এছাড়া আরও জনপ্রিয় ছিল সুজি দিয়ে তৈরি হওয়া রুটি শিরমাল, যা ‘শিরমালি রুটি’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া থাকত আকবরি নানখাতাই যা শীতকালে বেশী খাওয়া হত। এছাড়া পরবর্তীতে ক্রমে যুক্ত হতে থাকে বাকরখানি, বোগদাদি রুটি, শবরাতি রুটি, কাকচা, কুলিচা, হরেক রকমের নানরুটি। এসবের খুব কম সংখ্যক পদই এখন আপনি পুরাতন ঢাকার ইফতার বাজারে খুঁজে পাবেন।
আসুন এবার দেখে নেই কাবাব, যা ছাড়া উপরের রুটিগুলো মুখে রুচবে না। সবচেয়ে আলোচিত যে কাবাবের নাম জানা যা যায়, তা ছিল ‘পাসান্দ কাবাব’। এটা মূলত তৈরি হত বিশাল ১০-১৫ সের ওজনের মাংসের টুকরো হতে, এর অপ্রভংশ রূপই বর্তমানের সুতি কাবাব। এছাড়া আরও যে সকল কাবাবের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে শামি কাবাব, জালি কাবাব, হাণ্ডি কাবাব, তাশ কাবাব, টিকা কাবাব, মোরগ কাবাব, মুরগী মোসাল্লাম প্রভৃতি। এসব মুখরোচক কাবাবের সাথে থাকত নানা পদের কারী আইটেম। রুটির সাথে এগুলো দিয়ে উদরপূর্তি করতেন শৌখিন ভোজনবিলাসীর দল।
ইফতারের আরেকটা অনুষঙ্গ ছিল পানীয়। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকা হওয়াতে শরবত দিয়েই শুরু হত ইফতার পর্ব। আগেকার দিনে বরফকল না থাকাতে মাটি অথবা কাসা/পিতলের হাঁড়ি বা কলসে নানান পদের শরবত তৈরি করে তা মুখ বন্ধ করে কুয়োর ভেতর ডুবিয়ে রাখা হত। ইফতারের আগে আগে কুয়া হতে সেই হাঁড়ি বা কলস তুলে পান করা হত হিম শীতল শরবত। শরবত তৈরিতে দুধ প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর সাথে থাকতো নানান রসালো ফলের নির্যাস, আর নানান বাদাম, কিশমিশ, পেস্তা, জাফরান প্রভৃতির সমাহার। তোকমার শরবত, বেলের শরবত, বেদানার শরবত, লেবু ও তেঁতুলের শরবত ইত্যাদিও তখন থেকেই জনপ্রিয় ছিল। তোকমার শরবতের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল তাখসে রায়হান। শরবতের পাশাপাশি থাকত ফালুদা, ফিরনী সহ নানান পদের মিষ্টান্ন। এছাড়া মোঘল ইফতারের তালিকায় হালিম সদৃশ খাবারের উপস্থিতির কথাও জানা যায়। মাংস, মসলা, লেবুর রস ও গম দিয়ে তৈরি সেই খাবারও বেশ জনপ্রিয় ছিল। এর বাইরে ছিল নানান পদের বিরিয়ানি আর পোলাও এর সমাহার যার মধ্যে অন্যতম ছিল শাহী মোরগ পোলাও, খোরাসানি পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, কোপ্তা পোলাও, সাদা পোলাও, তেহারি, মাসালা বিরিয়ানি সহ আরও অনেক নাম।
চকবাজারের ইফতার, ঐতিহ্য-বাস্তবতা-অপপ্রচার এবং কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা। শিরোনামের এই পোস্টটি গত রমজানে লিখেছিলাম, যা তখন ভাল সাড়া পেয়েছিল পাঠকের কাছ থেকে। মজার ব্যাপার আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে কয়েকটা তথ্য খুঁজতে খুঁজতে দেখি আমার সেই লেখাটি হরেক জায়াগায় হরেকভাবে কপি পেস্ট করা হয়েছে। কোথাও নামকা ওয়াস্তে মূল লেখার লিংক দিয়ে, আবার কোথাও কোন কিছুর বালাই না করে। যাই হোক, মূল কথা হল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া, সেটা যদি সফল হয় তবে এই লেখার পরিশ্রমও সফল। আজ এখানেই শেষ করছি, সামনে আবার কোন লেখায় পুরাতন ঢাকার কোন নতুন ইতিহাস নিয়ে লিখবো আশা রাখি। পবিত্র রমজান সবার জীবনে বয়ে আনুক সংযম ও ধৈর্য, সাথে শান্তি ও সমৃদ্ধি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০২৩ বিকাল ৪:১৫