আর মাত্র একদিন পরে আগে ঘটা করে পালিত হবে বাংলা নববর্ষ। এই নববর্ষ উদযাপনে দিন দিন নিত্যনতুন অনুষঙ্গযুক্ত হচ্ছে এবং আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে যা মিশে যাচ্ছে। এটা দোষের কিছু নয়, সমস্যা হল কতিপয় অতিউৎসুক মানুষ ইতিহাস বিকৃত করে এগুলোকে আমাদের বাংলা’র ইতিহাস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আসুন একটু সংক্ষেপে দেখি বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কিছু ইতিহাস।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ঋতু বৈচিত্রকে ধারন করবার কারণে বাংলা সনের জনপ্রিয়তা এসেছে ।
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দু’টি মত আছে ৷ প্রথম মত অনুযায়ী প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন ৷ দ্বিতীয় মত অনুসারে, উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রিয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো হিজরি সন। ১২০১ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজয় এর পর থেকে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে ব্যবহৃত হতো হিজরি সন। দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে বর্তমানে প্রচলিত বাংলা সন কে বৈজ্ঞানিক ভাবে নির্ধারন করা হয়।
খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মুসলিম আমলের আগে শশাংক কর্তৃক প্রবর্তিত শকাব্দ ও বিক্রমাব্দ সহ বিভিন্ন ধরনের সন গননা প্রবর্তিত ছিল। আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার চালু হওয়ার পরও এই বাংলাদেশেই অন্যতম প্রচলিত ক্যালেন্ডার ছিল শকাব্দ বা শালিবাহন বর্ষ।
এখন আসা যাক, নববর্ষ উদযাপন প্রসঙ্গে। মুসলিম পুর্ব ভারতবর্ষে বিভিন্ন সন প্রচলিত ছিল। বাংলায় তখন যে সন প্রচলিত ছিল তার প্রথম দিন ছিল ১লা অগ্রাহায়ন। হায়ন শব্দের অর্থ বছর বা সুর্যের একটি পরিক্রমন এর সময়। একারনে সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত বাংলাসনের আগে বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপিত হতো ১লা অগ্রহায়ন। এছাড়া কার্তিক ও চৈত্র মাসকেও বিভিন্ন সময় বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারনের প্রমান পাওয়া যায়। আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত।
আমাদের বাংলাদেশে যে আধুনিক বাংলা বর্ষ প্রবর্তিত রয়েছে, তা মূলত বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাংলা সন সংশোধিত বর্ষ গণনা প্রক্রিয়া যার মূল প্রোথিত রয়েছে ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো হতে উত্তরণের প্রস্তাববালী প্রদান করেন । বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের । যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে । এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড । এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয় । ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দীতে যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য । জ্যোর্তিবিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি । বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের । এই সমস্যাগুলোকে দূর করবার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদূল্লাহ কমিটি বাংলা একাডেমীর কাছে কতকগুলো প্রস্তাব করে । এগুলো হচ্ছে-
• বছরের প্রথম পাঁচ মাস বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের
• বাকী মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন হতে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস
• প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমী সরকারীভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে ।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”।
মূলত পহেলা বৈশাখ ছিল গ্রাম বাংলার একটি অবিচ্ছেদ্য জীবনাচারের অংশ, এদিন পুরাতন বছরের হিসেব চুকিয়ে নতুন বছরের হিসেব খোলা হত। গত দুই দশকে এই অনুষ্ঠানে কর্পোরেট বানিজ্য এবং আমাদের যে কোন বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত আদিখ্যেতার জোয়ারে হারিয়ে গেছে গ্রাম বাংলার পহেলা বৈশাখ, জন্ম নিয়েছে নতুন এক হাইব্রিড পহেলা বৈশাখ। যেখানে হাজার টাকায় পান্তা ইলিশ খাওয়া হয়, বৈশাখী কনসার্ট আয়োজন করা হয়, বৈশাখী ডিজে পার্টি, বৈশাখী ফ্যাশন শো হয়, আরও কত কি হয় তা আমার জানা নেই।
এত কথার শেষ কথা, আপনি যে কোন উৎসব পালন করার স্বাধীনতা রাখেন যে কোনভাবে, কিন্তু সেই উৎসবকে আপনার মনের মত করে রাঙিয়ে কোন গোষ্ঠী, দল, জাতির কাছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। প্রায় হাজার বছরের পুরানো বাংলা বর্ষ এবং নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস নিশ্চয়ই কয়েকযুগ আগে কতিপয় ব্যাক্তি দ্বারা প্রচলিত রীতি দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে ইতিহাস আমাদের দোরগোড়ায় চলে আসবেই। তাই অধুনা প্রচলিত ‘বাংলা নববর্ষ উদযাপন’ই হাজার বছরের প্রচলিত বাংলা বর্ষবরণ সংস্কৃতি নয়। কোথায় রয়েছ কৃষিভিত্তিক বাংলার বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ? হালখাতা, বর্ষ শেষের ঝাড়ামোছা, গ্রাম বাংলার সেই বৈশাখী মেলা?
একেবারে শেষে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, সব কিছুতে হাজার বছরের বাঙালীর ইতিহাস জুড়ে দিবেন না। হাজার বছর অনেক লম্বা সময় আর ইতিহাস অনেক গভীর একটি বিষয়।
(গতবছর লিখেছিলাম একটি বিশাল পোস্ট, যা আরও বিশদ জানতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেনঃ বাংলা বর্ষ এবং বর্ষবরণ (একটি ইতিহাস ভিত্তিক পর্যালোচনা) )
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:৩৪