যখন (সেই আদিম কালে)প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়, তখন তৎকালীন এই কার্যসংশ্লিষ্ট এক মহারথী ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন “সারা পৃথিবীর জন্য পাঁচটির বেশী কম্পিউটারের প্রয়োজন নেই”!!! অথচ আজ অনেক মানুষের ব্যাক্তিগত পর্যায়ে পাঁচটি কম্পিউটার (অথবা কম্পিউটার বেইজড) যন্ত্র রয়েছে, যেমন ধরুন ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাব, মোবাইল, ক্যালকুলেটর। “অদূরদর্শিতা” অত্যন্ত অদ্ভুত একটি ব্যাক্তিগত অন্তঃশক্তি যার দেখা পাওয়া খুবই বিরল। খুব কম মানুষই ঐ পর্যায়ের বিচক্ষণ হতে পারে যার মাঝে এই অদূরদর্শী হওয়ার সক্ষমতা গড়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ ঐ মহারথী’র মত ঋণাত্মক অদূরদর্শী হয়ে যায়...
মূল লেখায় প্রবেশের আগের এই প্রারম্ভিক কথন মূল লেখার সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে এর অবতারণা। আজকের লেখার উপজীব্য “বাংলাদেশের পর্যটন এবং এর ধারক-বাহকেরা”। পর্যটন এক সময় অতি রোমাঞ্চ আর বিত্তশালীর বিনোদনের ঘেরাটোপে বন্দী থাকলেও আজ পর্যটন নিজের একটা আলাদা স্থান করে নিয়েছে সারা বিশ্বময়, সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাত্রায়। পর্যটনের এই আধিপত্য ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে দিনকে দিন। World Council of Travel and Tourism এর তথ্যমতে ২০১০ সালে সমগ্র বিশ্বের (বৈশ্বিক) জিডিপি’র ৯.৫% এসেছে ট্যুরিসম বা পর্যটন খাত থেকে। এই হার ২০০১ সালে ছিল ৪.২% অর্থাৎ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশী। বিশ্বের অনেক দেশই সীমিত প্রাকৃতিক রিসোর্স স্বত্বেও শুধুমাত্র পর্যটনকে কেন্দ্র করে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের অন্যতম প্রধান শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান এবং মূল উৎস হল পর্যটন খাত। World Tourism Organization (UNWTO) এর হিসেব মতে ২০১০ সালে ১.০৮৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক আয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী পর্যটন খাত থেকে যা সারা বিশ্বের মোট রপ্তানি আয়ের ৬%। মালদ্বীপের মত দেশের জিডিপির ২৮% আসে পর্যটন খাত থেকে। থাইল্যান্ড ২০১২ সালে পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে ৩৩.৮ বিলিয়ন যা ২০১৩ সালে বেড়ে গিয়ে ৪২.১ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ শুধু পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজিয়ে তা হতে দেশের ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছে। আর সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, চরম সুযোগ এবং সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আয়ের কত শতাংশ পর্যটন খাত থেকে আসে জানেন কি? সিঙ্গাপুর এমন একটা রাষ্ট্র যার আয়তন ঢাকা শহরের চেয়ে কম, অথচ তার রাষ্ট্রীয় আয়ের ৭৫% আসে পর্যটন খাত থেকে। আর বাংলাদেশের? পর্যটন খাত থেকে ২০০৯ সালে ৫৭৬ কোটি ২২ লাখ, ২০১০ সালে ৫৫৬ কোটি ২৯ লাখ, ২০১১সালে ৬২০ কোটি ১৬ লাখ, ২০১২ সালে ৮২৬ কোটি ৩৭ লাখ এবং ২০১৩ সালে ৯৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়। শতকরা হিসেব নাই বা দিলাম।
এখন কথা হল এমনটি কি হওয়ার কথা ছিল। যে দেশে পর্যটন খাতের জন্য তিন তিনটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা রয়েছে, সে দেশে কি এমন হওয়ার কথা! আপনি হয়ত ভাবছেন তিনটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা!!! জ্বী হ্যাঁ, তিনটিঃ পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন কর্পোরেশন আর পর্যটন বোর্ড। আজকের লেখার মুখ্য কথন কিন্তু এই “পর্যটন বোর্ড”কে নিয়েই। আমি বলি কি প্রয়োজনে আরও আট দশটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান যোগ হোক, তবুও পর্যটন বিকশিত হোক।
২০১০ সালে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইন, ২০১০ পাশ হয় যার অরগানোগ্রাম অতিসম্প্রতি চূড়ান্ত হয়েছে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর পর্যটন বোর্ড আইন আর তারও পাঁচ বছর পর সেই বোর্ডের অরগানোগ্রাম! এই আইনের ৪। (১) ধারায় বলে হয়েছে, “এই আইনের উদ্দেশ্যে পূরণকল্পে পর্যটন সংরক্ষণ বিষয়াদির উন্নয়ন, নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় সাধন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, সরকার, এই আইন কার্যকর হইবার পর যথাশীঘ্র সম্ভব, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড (Bangladesh Tourism Board) নামে একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করিবে।” যার অরগানোগ্রাম ঠিক করতেই পাঁচ বছর লেগে গেল! যাই হোক এই আইনে পর্যটকের আধুনিক অর্থনৈতিক সংজ্ঞা পাওয়া গেছে, “"পর্যটক" অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি তাহার স্বাভাবিক বসবাসের স্থান হইতে অন্য কোন নতুন স্থানে উপার্জনমূলক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য ব্যতীত অবকাশযাপন, বিনোদন, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বা অন্য যে কোন কারণে গমন করিয়া অনধিক এক বৎসর অবস্থান করেন;”! আচ্ছা ব্যবসা কি কোন উপার্জনমূলক কর্মসংস্থানের আওতামুক্ত?
লিখতে ভাল লাগছে না, অনেক কিছু লিখবো বলে শুরু করেছিলাম; কিন্তু লেখা অসমাপ্ত রেখে সমাপ্তি টানতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইন, ২০১০ এ বলা আছেঃ বোর্ডের কার্যাবলী হইবে নিম্নরূপ, যথাঃ-
(১) এই আইনের লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, সুপারিশ প্রদান ও বিদ্যমান পর্যটন সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়নে সহায়তা;
(২) পর্যটন শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা প্রদান;
(৩) পর্যটন-আকর্ষণ চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষন, বিকাশ ও গণসচেতনতা তৈরী;
(৪) দায়িত্বশীল পর্যটন (responsible tourism) বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সরকার, ব্যক্তিখাত, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও, নারী সংগঠন ও মিডিয়ার অংশগ্রহণের ব্যবস্থাকরণ;
(৫) বিদেশি পর্যটন প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশীয় সরকারি বা বেসরকারি পর্যটন সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সহযোগিতা প্রদান ও কাজে সমন্বয় সাধন;
(৬) বাংলাদেশে পর্যটকদের আগমন এবং অবস্থানকে সহজতর ও নিরাপদ করাসহ অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় সাধন;
(৭) পর্যটন শিল্প সহায়ক সুবিধাসমূহ সৃষ্টি এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান ও দেশে-বিদেশে বিপণনের বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বিভাগ বা দপ্তরের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও সমন্বয় সাধন;
(৮) পর্যটন শিল্পের মানব সম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দিকনির্দেশনা প্রদান;
(৯) পর্যটন-আকর্ষণের মান নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যটকদের স্বার্থ রক্ষায় মানসম্পদ পর্যটন সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
(১০) প্রতিবন্ধী পর্যটকদের অংশগ্রহণের সুবিধাদি নিশ্চিতকরণ;
(১১) পর্যটন শিল্পে নারীর অধিকার ও অংশগ্রহণ সংরক্ষণ;
(১২) পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য গবেষণা, আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণপূর্বক যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ;
(১৩) পর্যটন সম্পৃক্ত রুগ্ন শিল্পকে সহায়তা প্রদানকল্পে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান;
(১৪) পর্যটন সম্পর্কিত যাবতীয় মেলার আয়োজন ও প্রচার বা প্রকাশনামূলক কার্যক্রম গ্রহণে দিকনির্দেশনা প্রদান;
(১৫) পর্যটন সংক্রান্ত ডাটাবেস তৈরী করা;
(১৬) সরকার কর্তৃক সময় সময় অন্য যেইরূপ দায়িত্ব অর্পণ করা হইবে সেইরূপ দায়িত্ব পালন।
আইন পাশ হওয়ার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, এই সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ পর্যটন এলাকা ঘুরেছি, কোথাও এই কার্যক্রমগুলো’র বাস্তব প্রয়োগ দেখতে পাইনি। হয়ত ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, আমি টের পাইনি বা বুঝিনি। হাজার হলেও বোকা মানুষ বলে কথা! আর তাই বাংলাদেশের পর্যটনে বোকা মানুষের টেনশন করে কি লাভ?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১:২০