একটি বহুজাতিক কোম্পানির ত্বকের রঙ (নাকি রঙ্গ?

প্রথমেই কিছু দেশী-বিদেশী কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কথা বলে নেই। শুরু করি “ফেয়ার এন্ড লাভলি”র কথা দিয়ে যা উপরেই বলেছি। কিছুদিন আগেও এই ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমগুলোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে, গত মাসেই প্রিয় ব্লগার, ভ্রাতা জাফরুল মবীন কসমেটিকসে বিষঃরূপচর্চা নাকি সেলফ পয়জনিং ? শিরোনামে লেখা উপহার দেন যা স্টিকি পোস্ট আকারে ছিল বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। আজকের আমার ফোকাস তাদের মার্কেটিং পলিসি নিয়ে। একটা বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানি কি করে পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের’কে দেশী কোম্পানি হিসেবে তুলে ধরছে?
গত ঈদে রবি যা করলো, তাদের “এই ঈদে কার মুখে হাসি ফুটাবেন” শিরোনামে, তার সম্পর্কে কি বলা যায়। গ্রাহকদের কাছ থেকে ঈদের জামা’র কথা বলে চাঁদা তুলে তা দিয়ে বিশ হাজার জামা, যা রবি’র নিজস্ব মার্কেটিং এর ব্র্যান্ড লোগো সম্বলিত লাল টিশার্ট জাতীয়, ফতুয়া তৈরি করলো। কত চাঁদা উঠেছিল আর কত টাকার জামা বানানো হয়েছে সেই প্রশ্নে গেলাম না। এই জামার জন্য কি তারা চাঁদা তুলেছিল? তাহলে গ্রাহকদের কেন তা আগে বলা হল না? এটা নিয়ে একটা বিশাল মামলা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয় নাই। পথশিশুদের তাদের লোগো ছাপানো জামা দান করে বিশ হাজার জীবন্ত পোস্টার সারা দেশে বিনে পয়সায় ছড়িয়ে দিল, কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। জয়তু মার্কেটিং ক্যাম্পেইন, জয়তু সোশ্যাল কর্পোরেট রেসপনশিবিলিটি!!!



“রূপচাঁদা সরিষা তেল” তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির সরিষার তেলের বিজ্ঞাপন কাউণ্টার করতে গিয়ে নতুন যে বিজ্ঞাপনটি প্রচার করছে তাতে সরিষা দানার গুনাগুন, আর্দ্রতা ইত্যাদির সাথে যোগ করেছে “তেঁতুল কাঠের তৈরি ঘানীতে, অভিজ্ঞ ওস্তাদ দ্বারা” প্রস্তুতকৃত। বিজ্ঞাপন দেখে আগের মতই মুখে আসলো, ‘ওয়েট, ওয়েট, জাস্ট এ মিনিট... তেঁতুল কাঠের তৈরি ঘানীতই আপনাদের সব সরিষার তেল তৈরি হচ্ছে? আর আপনাদের দৌড়াত্মে বেকার হয়ে যাওয়া সেইসব ঘানীতে তৈল উৎপাদনকারী ওস্তাদদের আপনারা কর্মসংস্থান করেছেন!!! আলহামদুলিল্লাহ্... যারপরানই খুশী হলাম’। কথা হল কোটি টাকা ব্যায়ে প্লান্ট বসিয়ে যখন সেই প্ল্যান্ট বিজ্ঞাপনে দেখাতে গিয়ে বাহিরের দেশ হতে তুলে আনা কিছু মেশিনারিজের ভিডিও ক্লিপ জুড়ে দিয়ে প্রচারনা চালাতে পারেন, আর তেঁতুল কাঠের ঘানীতে উৎপাদন করাটা দেখানোর সৎ-সাহস হল না! আমি ব্যাক্তিগতভাবে যব ক্যারিয়ারে সয়াবিন শিল্পের একটি ছোট্ট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, এবং আমার জানা মতে, তৈল উৎপাদন কেন? পোলট্রি ফিড উৎপাদন ফ্যাকটরিতেও সয়াবিন, সরিষা, ভুট্টা প্রভৃতির ময়েশ্চার পরিমাপ অনেক জরুরী বিষয়, এটা রূপচাঁদা সরিষার তেলের জন্যই শুধু প্রযোজ্য নয়।
কেয়া বিউটি সোপ এতোই আধুনিক হয়েছে যে, তারা ভিন্ন ভিন্ন তেল ব্যাবহার করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন সাবান প্রস্তুত করছে। মজা পাইছি। সাবানের জন্য কোন কোম্পানি কি তেল ব্যাবহার করে আর কোন তেলের মূল্য কত এবং সেই তেলে উৎপাদিত সাবানের মূল্য কত হতে পারে তা একটু ভাবলেই বের হয়ে যায় আসল সত্য। এই সাবানটির মূল “টার্গেট কাস্টমার” মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ। তাই হয়ত এই মিথ্যাচার দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরিতে তাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নাই। কিন্তু এই গ্রামাঞ্চল আর সেই গ্রামাঞ্চল নাইরে মফিজ, দিন বদলাইছে না! পাবলিক সবই বুঝে, কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা যে তাগো হাতে নাইরে!!!
ড্রিংকস নিয়ে কি বলবো? কোনটা রেখে কোনটা বলি? এই দুইদিনে বেশী চোখে পড়ল “ইউরো অরেঞ্জ” ড্রিংকস এর বিজ্ঞাপনটা। তাত্তিকভাবে এই পানীয়তে অরেঞ্জ ফ্লেভার থাকবে, কিন্তু অরেঞ্জ পাল্প বা এমন কিছু নয়। বিজ্ঞাপনের ঢঙ্গে মনে হয়, কমলার রসে বোতল ভরা। প্রাণ সাহেবের কথা নাই বললাম। আসলে পানীয় জগতের কথা বলতে আসলে “ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়” হবার যোগাড় হবে যে! শুধু পানীয় কেন, যে সেক্টরের কথাই বলতে যাই না কেন... সাধু’রা যে সবখানেই রয়েছে।
আগে জানতাম দুধ খেলে শক্তি বাড়ে, এখন দেখি দুধ খেলে লাভ নেই!! যদি না এতে হরলিক্স মেশানো হচ্ছে





শুনেছি দেশে বিজ্ঞাপন নীতিমালা আছে, আছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন। কিন্তু এগুলো যে কি জিনিশ, খায় না মাথায় দেয়, আজো বুঝতে পারলাম না। অনেক আগে টেলিভিশনে একটা নিউজ হয়েছিল, কনডেন্সড মিল্ক ক্ষতিকর পাম অয়েল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। নিউজটা পড়ে সংবাদ পাঠিকা বিজ্ঞাপন বিরতি নিলেন। এবং সেই বিরতির প্রথম বিজ্ঞাপন ছিল কোন এক কনডেন্সড মিল্ক কোম্পানির, এরেই বলে ব্যাবসা!!! সেই মুহূর্তে, ঘটনা দেখার সাথে সাথে, তাৎক্ষণিকভাবে আমার সিগারেটের প্যাকের সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ ধুমপান সাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কথাটি মনে পড়ল। এরাতো তার চেয়ে খারাপ।
ইংরেজি ETHICS যে কোন প্রফেশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। প্রায় প্রতিটি প্রফেশনেই একটা “কোড অব কন্ডাক্ট” থাকে এই ETHICS কে মূল ফোকাসে রেখে। তো ETHICS জিনিশটা কি? এটা স্পেসিফিকলি সংজ্ঞায়িত করাটা দুরূহ হলেও, সাদামাটা ভাষায় বলা যায়, ‘কোন একটি বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ সমষ্টি যা ঐ লক্ষ্যের অনুসারীদের অবশ্য পালনীয়’। ডাক্তার, একাউনটেণ্ট, লইয়ার, ইঞ্জিনিয়ার সহ যে কোন পেশায়, তাত্ত্বিকভাবে কিছু ইথিকাল রুলস এন্ড রেগুলেশন থাকে। কিন্তু কতটুকু ব্যবহৃত হচ্ছে, বা মানা হচ্ছে, বা প্রয়োগ হচ্ছে? আচ্ছা চোরের ETHICS কি জানেন তো? "চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি নাহি পড় ধরা"

আর বিজ্ঞাপনগুলোতে যারা মডেল হিসেবে অভিনয় করছেন, তাদের মাঝেও কি এই মূল্যবোধ আছ? নয়ত কি অবলীলায় তারা প্রতিটি পন্য’র বিজ্ঞাপনে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে মিথ্যা বলে যান। আর তাইতো দেশী একটি বিজ্ঞাপনে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুখ ঢেকে গোপনে সেই বিস্কুট ক্রয় করে, খেয়ে নিয়ে, তারপর নিজে স্বাক্ষর দিয়ে বলেন, সেই বিস্কুটই সেরা। কি হাস্যকর!!! নির্মাতা এবং কোম্পানিও অনুভব করছে বিজ্ঞাপনে বলা তারকাদের কথা এখন মানুষ আর বিশ্বাস করে না। ভারতীয় একটি রাবার স্যান্ডেলের বিজ্ঞাপনে বলিউডের বিশাল তারকা সালমান খান নিজ মায়ের নামে কসম খেয়ে বিজ্ঞাপন করেছেন, আরেকটা প্রোডাক্টে তাকে তার বাবার রেফারেন্স দিয়ে পন্যের প্রচার করতে দেখেছি। কি মজার ব্যাপার, তাই না! তাদের বিজ্ঞাপনই বলে দিচ্ছে যে, তারা বিজ্ঞাপন তৈরি করে মিথাচারের বুনিয়াদে। তারপরও আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে, কখনো অসচেতনতায়, কখনো বা মিথাচারে প্রলুব্ধ হয়ে এসব পণ্যই প্রতিদিন কিনে চলেছি। কি করার আছে আমাদের? হাতের কাছে কোন সাবসটিটিউট বা কমপ্লিমেণ্টারি প্রোডাক্ট কি আছে যা আসলেই এগুলোর বদলে কিনে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারি?

যত লিখবো, লেখা তত বড় হতেই থাকবে। প্রোডাক্ট প্রাইসিং নিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলাম। তাত্ত্বিক জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে অনেক লেখা যেত। কিন্তু লাভ কি কিছু হবে? জানি উত্তর হল, “না”। তবু মনের তাগিদ থেকে এই মধ্যরাতে পোস্টখানা লিখলাম। সন্ধ্যা হতে ঈদের অনুষ্ঠানমালা’র নামে বেশীরভাগ সময় জুড়ে এই মিথ্যার বেসাতী দেখে মাথা গরম হয়ে যায়। গত ঈদে সীতাকুণ্ড ট্যুরে কোমরে ব্যাথা পেয়ে বেশ কয়েক ঈদ পরে এই ঈদে কোথাও বেড়াতে যেতে পারলাম না। তিন তিনটা গ্রুপ গেল তিন দিকেঃ নিঝুম দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন আর সিলেট-সুনামগঞ্জ; আমি কোথাও যেতে পারলাম না। ভেবেছিলাম এই ঈদে নাহয় টিভি দেখেই কাটাবো। কিন্তু গা জ্বালানো এইসব বিজ্ঞাপন দেখলে মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। এরা কি মনে করে সাধারণ জনগন’কে? সবাই কি “বোকা মানুষ”



সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:২৬