প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এক সৈকত একাকী সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে, আর আপনি তন্ময় হয়ে সেই মায়াবী দ্বীপের আর তার সৈকতের আহবানে সাড়া দিতে ব্যাকুল... ভেবে দেখুন একবার। তখন সাগরে সকল ধরনের মাছ ধরার নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ। তাই চারিদিকে যতদূর চোখ যায় আমাদের নৌকা ছাড়া আর কোন নৌকার চিহ্ন নেই। সাগরের নোনা নীল জল ভেদ করে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলছে। ১৫ জনের আমাদের দল বিকেলের মিষ্টি রৌদ্রজ্জ্বল দিনে অপার বিস্ময়ে চেয়ে আছি সম্মুখপাণে। অনেক দূরে দিগন্তরেখায় দেখা যাচ্ছে আমাদেরে পরম কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার চর’। নৌকা যত এগোয়, তত আবছা থেকে স্পষ্ট হতে থাকে, এভাবে চলতে চলতে একসময় আমরা পৌঁছই সোনার চর। সৈকত থেকে শ’দুয়েক গজ সামনে নৌকো থেকে গেল, আর যাবে না। কি আর করা আমরা কোমর পানিতে নেমে হেঁটে এগিয়ে যাই এক স্বপ্নরাজ্যে।
গত কুরবানি ঈদে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ এর সাথে বেড়িয়ে পড়ি দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চল ভোলার উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রাথমিক ডেরা চর কুকরি-মুকরি। (সেই ভ্রমণের পুরো গল্প নিয়ে লেখেছিলাম চার চর আর তিন সৈকত - এ লাইফ টাইম মেমরেব্ল জার্নি ) সেখানে প্রথম দিন কাটিয়ে আমরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে শলাপরামর্শ করে পরদিন একটা ১৬ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনযুক্ত মাছ ধরার ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম তিনটি অপার সৌন্দর্যের চর আর তার সৈকত ভ্রমণে। সেদিন প্রথমে আমরা যাই ‘কালীর চর’, এর পর বহুল আলোচিত ‘তারুয়া দ্বীপ’ এবং দেখি তার নয়নাভিরাম সৈকত। গত বছর আমার একটা লেখা ছিল “বাংলাদেশের ডজন দেড়েক সমুদ্র সৈকত (মেগা পোস্ট)” । সেই লেখায় ছিল তারুয়া সৈকতের কথাও। একটি আনন্দের খবর শেয়ার করি সবার সাথে, এরই মধ্যে ঐ লেখার ডজন দেড়েকের মধ্যে প্রায় ১২-১৪টি সৈকত ইতোমধ্যে ঘুরে দেখেছি। বাকীগুলো ইচ্ছা আছে সামনের দিনগুলোতে দেখে ফেলার, যদি আল্লাহ্তায়ালা তৌফিক দান করেন।
তো যেখানে ছিলাম, সকালবেলা চর কুকরি-মুকরি থেকে রওনা দিয়ে কালীর চর আর তারুয়া দ্বীপ দেখে আমরা যখন সোনার চরে পৌঁছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলা। একে একে আমরা সবাই সেই দীর্ঘ নির্জন সৈকতে নেমে এলাম। আমরা ছাড়া সেখানে দুজন লোক দেখতে পেলাম, যারা মহিষ পালনে এবং নজরদারিতে সেখানে আছেন। স্থানীয়রা এই জায়গাটাকে মহিষের বাথান বলে। পালে পালে মহিষ এনে এখানে ছেড়ে দিয়ে যায় মহাজনেরা আর সাথে সপ্তাহব্যাপী এরকম দু’তিনজন করে লোক থাকে পাহারায়। সপ্তাহ পেরুলে আরেক দল আসে, আগের দল তখন নিজের পরিবারে ফিরে যায়। কালীর চরেও দেখেছি গরু এভাবে ছেড়ে দিয়ে প্রতিপালন করতে।
এবার আসুন একটু জেনে নেই এই প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের আধার এই ছোট্ট দ্বীপ সোনার চর সম্পর্কে। সোনার চরের অবস্থান গলাচিপা উপজেলার চরমোন্তাজে বঙ্গোপসাগেরের কোল ঘেঁষে। ৩০ এর দশকে জেগে ওঠা অপার সম্ভাবনা সৌন্দর্যের দ্বীপটির সোনালি বালুকাবেলা সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে দূর থেকে সোনার ন্যায় রঙ ধারণ করে যার থেকে লোকমুখে এই চরের নাম হয়ে যায় সোনারচর।
বঙ্গোপসাগরের কোল জুড়ে বেড়ে ওঠা সোনার চরের আয়তন প্রায় ১০ হাজার একর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা-লম্বি এ দ্বীপটি দুর থেকে দেখতে ডিমের মত। ২০০৪ সালে এটা প্রথম আলোচনায় আসে। এরপর পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগ বনায়ন করে এ চরে। বনে ছাড়া হয় তিনশ'টি হরিণসহ, বানর, বন্য মহিষ, শুকর ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। রয়েছে নানা প্রজাতির পাখ-পাখিও। পটুয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগ থেকে জানা যায়, ২০১১সালের ১৬ ডিসেম্বর সংরক্ষিণ এ বনভূমি বন্যপ্রাণীদের জন্য অভয়রণ্য ঘোষণা করে সরকার।
সোনার চরের অভ্যন্তরে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল-উপখাল। এসব খালের দুপাশে যেন সবুজের নিচ্ছিদ্র দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি উপজেলার চরকাজলের বন বিভাগের অধীন সোনার চর। যা পটুয়াখালীর মূল ভূখন্ড থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে অবস্থিত এবং পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে। নদী বা সমুদ্রই হচ্ছে যাতায়াতের একমাত্র পথ। সোনার চরে রয়েছে বিশ হাজার ছাবিবশ হেক্টর বিস্তৃত বনভূমি। রয়েছে সুন্দরী, কেওড়া, গড়াল, গর্জন, খইয়া বাবলা ও ছইলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সেইসাথে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত রয়েছে সোনার চরে।
ছবিতে (গুগল ম্যাপে) বৃত্তাকার চিহ্নের ভেতরের ভূখণ্ডটি সোনার চর।
এমনিতে এই চরে যাওয়ার বহুল ব্যাবহৃত রুট হচ্ছে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে সড়কপথে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে পানপট্টি লঞ্চঘাট। সেখান থেকে সামনে এগিয়ে গেলেই আগুনমুখা মোহনা। ট্রলার কিংবা লঞ্চযোগে আগুনমুখা মোহনা থেকে ঘণ্টা তিনেক এগুলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপচর তাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছাতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ সামনে এগুলেই সোনারচর। প্রায় ১০ কিমি দীর্ঘ একটি অনন্য সুন্দর চোখ জুড়ানো সমুদ্রসৈকত। কিন্তু আমরা গিয়েছিলাম ভোলার চর ফ্যাশন এর কচ্ছপিয়া ঘাট হতে প্রথমে চর কুকরি-মুকরি, তারপর সেখান হতে একে একে কালীর চর এবং তারুয়া দ্বীপ হয়ে সোনার চর।
দীর্ঘ এই চরে নেমে আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম, খুশীতে কেউ কেউ লাফাতে লাগলো। কেউবা ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফটোগ্রাফীতে, কেউ কেউ জলে পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে সৈকত ধরে হাঁটতে লাগলো। পুরো সৈকত জুড়ে কাঁকড়ার বাসা, থেকে থেকে উনারা মুখ বের করে আবার লুকিয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ তাদের এই লুকোচুরি’র সাথে আমরা যোগ দিলাম, উদ্দেশ্য উনাদের ছবি তোলা।
(এই ছবিটি travelnewsbd.com Click This Link হতে নেয়া )
একসময় সবাই মিলে সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটতে লাগলাম পূর্ব হতে পশ্চিম মুখি হয়ে এই মায়াবী সৈকত ধরে।
এভাবে পুরো বিকেলটা পার করে সূর্য যখন সমুদ্রের বুকে মুখ লুকোতে ব্যাকুল, তখন আমরা ফেরার জন্য নৌকায় উঠলাম। সাথে চলল সূর্যের ডুবে যাওয়ার মায়াময় দৃশ্য অবলোকন।
নৌকো থেকে দেখতে লাগলাম চরের বনের পেছনে রাঙ্গা কুসুমের ন্যায়্ সূর্যটার হারিয়ে যাওয়া।
যাই হোক নৌকা ছাড়ার আধঘণ্টার মধ্যে আকাশের বুক জুড়ে আঁধারের চাদর মেলে দিল প্রকৃতি। চারিদিকে সাগরের অথৈ জলের মাঝে আমরা ১৫ জন, একটা ছোট্ট মাছ ধরার নৌকায়। আকাশে উঠলো পূর্ণিমার এক বিশাল থালার ন্যায় অদ্ভুত মায়াময় চাঁদ। সেদিনের সেই চাঁদের রূপ আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এমন রোমান্টিক চাঁদ আর কবে দেখবো জানা নেই। কেমন গোলাপি আর হলদেটে’র মিশেলে অদ্ভুত এক রঙ, ঘোর লাগা তার জোছনা। আমার কাছে ভালো ক্যামেরা না থাকায় সেই রূপ তুলে আনতে পারি নাই। থাক, সব জিনিষ ছবির ফ্রেমে বন্দী করতে নেই। কিছু জিনিষ না হয় মনের ফ্রেমেই বন্দী থাকুক।
প্রায় তিন ঘণ্টার সেই নৌকা ভ্রমণ শেষে রাত নয়টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম চর কুকরি-মুকরি। পেছনে ফেলে আসলাম এক মায়াময় বিকেলবেলা আর সাথে নিয়ে এলাম আজীবন মনে রাখার মত অসংখ্য সুন্দর স্মৃতি। এই ভ্রমণ ছিল আমার এযাবৎ কালের সবচেয়ে সেরা ভ্রমণ।
সোনার চর নিয়ে ব্লগার আমি আজব পোলা ইনফরমেশন বেইজড একটা লেখা লিখেছিলেন ২০১০ এ। আগ্রহীরা এই লিংকে গিয়ে সেই লেখাটা পড়তে পারেন। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:১৪