আমার জগতে ফুটবল নিয়ে প্রথম উন্মাদনার স্মৃতি হল ১৯৮৬’র বিশ্বকাপ। শিশু আমি সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। চারদিকে বড়রা শুধু বলে বেড়ায় ম্যারাডোনা, আর্জেন্টিনা। আমি তো সেই শিশু বয়সে ভেবেছিলাম এরা দুইজন দুই ভাই!

যাই হোক, ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আমি প্রাইমারীর শেষ করে একটু বড় হচ্ছি। এই বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক স্মৃতি। স্কুলের টিফিনের টাকা দিয়ে সবাই ভিউকার্ড কিনতাম প্রিয় দলের, প্রিয় খেলোয়াড়ের। স্কুলে আমাদের মধ্যে ছিল কম্পিটিশন কে কার কত ভিউকার্ড জমিয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলো একদিন ক্লাস চলাকালে লাস্ট বেঞ্চে দুজন ছাত্র কার্ড দেখা কালে টিচার দেখে ফেলেন। পরে ক্লাসের সবার ব্যাগ চেক করে করে সব ভিউকার্ড জব্দ করেন এবং আমাদের চোখের সামনেই সেগুলো ছিঁড়ে ফেলেন। এই বিশ্বকাপ আমার মনে চিরস্থায়ী একটা জায়গা করে আছে বিশেষ কারণে। মজার ব্যাপার জীবনে প্রথম বুঝতে শিখে আমি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বাদ দিয়ে সাপোর্ট করা শুরু করলাম হল্যান্ডকে, সাথে অবশ্য ক্যামেরুনও ছিল। কারণ, ঝাঁকড়া চুলের এক জাদুকর, রুদ খুলিত। তো আমি একদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে বসে বসে তাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেললাম (সেই বয়স থেকেই ছন্দ মিলানোর পোকা মাথায় ঢুকেছিল বলেই হয়ত আজো জীবনের ছন্দ মিলাতে পারি নাই)। বাসায় এসে সেই কবিতা আমার প্রতিবেশী, সম্পর্কে কাকী যে কিনা আমায় খুবই স্নেহ করতেন, দেখালাম। উনি পড়ে খুব রাগ করলেন, কারন? এই রুদ খুলিত আবার কে? ম্যারাডোনাকে নিয়ে কেন লিখলাম না? উনার কপট রাগ কিশোর মন বুঝতে পারে নাই। সাথে সাথে বললাম আচ্ছা এখনই লিখছি। বলেই কাগজ কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসে গেলাম। মজার ব্যাপার কয়েকদিন পর সেই কাকী আমায় সারপ্রাইজ দিলেন। উনি সেই কবিতা আমার মেজ মামাকে দেখিয়েছিলেন। মামা সেই কবিতা তার এক সাংবাদিক বন্ধুকে দিলে উনি তা পত্রিকায় ছেপে দেন। যতদূর মনে পড়ে ‘দৈনিক সংবাদ’। দুঃখের বিষয় ঐ পত্রিকার কোন কপি বা পুরো কবিতাটি আমার কাছে নেই। শুধু প্রথম দুই চার লাইন মনে আছে...
‘ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা, ও ম্যারাডোনা,
তোমার দেশের নামটি আর্জেন্টিনা।
তুমি খেল কত সুন্দর!
তাইতো জয় করেছো মোদের অন্তর।’
নিজের কাব্য প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ, হাসতে হাসতে শেষ। কিন্তু প্রথম কোন পাবলিক মিডিয়ায় নিজের লেখা, আজো সেই পত্রিকার কপি মিস করি। যাই হোক এরপর এল ১৯৯৪ এর বিশ্বকাপ। সুদুর আমেরিকায় খেলা, রাত জেগে জেগে খেলা দেখা, সামনে এস.এস.সি. পরীক্ষা। বড়দের বকুনি, চোখ রাঙ্গানি। এবার হল্যান্ডের সাথে যোগ হল ব্রাজিল। রোমারিও-বেবেতো জুটির সেই জাদুর খেলা! সেই বিশ্বকাপ রাতে খেলা হত, অনেকেই রাত জাগতে পারতেন না, কষ্ট হত। আমার এক আত্মীয়, সম্পর্কে নানা হন, একদিন তাদের বাসায় খেলা দেখছিলাম। উনি ঘুম তাড়াতে সোফা ছেড়ে কাঠের চেয়ারে বসে খেলা দেখতেন, যেন আরামে না ঘুমিয়ে পড়েন। যাই হোক, উনি সেই চেয়ারে বসেও ঘুমে ঢলতেন। সেদিন খেলা দেখছি, বল তখন মাঝমাঠে, অলসভাবে এর পা থেকে ওর পায়ে ঘুরছে। গভীর রাত, হঠাৎ সেই নানা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, “গোল!!!”। আমরা সবাই চমকে গিয়েই পর মুহূর্তে বুঝতে পারলাম উনি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে খেলা দেখছিলেন!
১৯৯৮ বিশ্বকাপ মনে থাকবে আজীবন ফ্রান্স এবং জিদান এর কল্যাণে। শুধু আমার না, যারা সেই বিশ্বকাপ দেখেছে সবার। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পরাজয়ে দুঃখও পেয়েছি আবার জিদানের কারনে ফ্রান্সের জয় এ সেই দুঃখও কিছুটা ভুলেছি। কারণ, একজন খেলোয়াড় একা কীভাবে একটি দলকে বিশ্বসেরা করতে পারে তা উনি করে দেখিয়েছিলেন। সাথে ব্রাজিলের টাকলু রোনাল্ডো, আমার অন্যতম প্রিয় প্লেয়ার। তার কারনেও অনেকেই এই বিশ্বকাপ মনে রাখবেন, তাকে নিয়ে সেই ফাইনালের বিতর্ক।
এরপর এল আমার জীবনের সেরা বিশ্বকাপ ২০০২। বিশ্বকাপের আগে এলাকায় দুই গ্রুপ, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। আমি ব্রাজিলের লিডিং দিচ্ছি। পুরো এলাকা পতাকায় সয়লাব (তখন পতাকা উড়ানোতে কোন বাঁধা নিষেধ ছিল না)। এক পতাকা বানালাম প্রায় ১২ ফুট লম্বা, সেই পতাকা এলাকার সবচেয়ে উচু এক ছয়তলা ভবনের ছাদের প্রায় ২০ ফুট লম্বা এক বাঁশের মাথায় বেঁধে দিলাম। তখন পুরাতন ঢাকায় এত উচু ভবন ছিল না, তাই প্রায় এক-দুই কিলোমিটার রেডিয়াস জুড়ে এলাকা হতে সেই পতাকা দেখা যেত। আশেপাশের এলাকা হতে আমাদের এলাকায় এই উন্মাদনা দেখতে ছেলেপেলেরা চলে আসতো। সেই বিশ্বকাপের খেলা দেখেছি একসাথে প্রায় ২০/২৫ জন মিলে এক বন্ধুর পাঁচতলা বাসার ছাদের চিলেকোঠা ঘরে। ছোট্ট পনের ইঞ্চি মনিটর, টিভি কার্ড, সাথে ক্রিয়েটিভ এর স্পিকার। অথচ সবার ঘরে বড় সাইজের টেলিভিশন ছিল। কিন্তু সবাই সারাদিন পড়ে থাকতাম ঐ রুমে। ২/৩ জন ছিল যারা রাতেও বাসায় যেতাম না। সারাদিন আড্ডা, সিনেমা দেখা, কার্ড খেলা। আর দুপুরের পর হতে একে একে সবাই জড়ো হওয়া শুরু হত। তবে বেশীরভাগই ছিলাম ব্রাজিলের সাপোর্টার, কিন্তু আর্জেন্টিনার সাপোর্টারও ছিল, সংখ্যায় কম। সেই রুমে ব্রাজিলের খেলার দিন, ব্রাজিলের জার্সি পরে সবাই ড্রাম (ঢোল, যা স্কাউটস এর প্যারেডে ব্যাবহার হত), বাঁশি (ভুভুজেলা তখন আসেনি ভাগ্য ভালো), খঞ্জনি নিয়ে সেই ১০ বাই ৮ ফুটের ঘরে জড়ো হতাম। খেলা চলাকালে সারাক্ষন এগুলো বাজতেই থাকতো। উফ! কি এক স্বপ্নের দিন ছিল সেই দিনগুলো। মিস করি অনেক। শেষে আমাদের উন্মাদনায়, নাকি রোনাল্ডিনহো নামক জাদকরের কল্যাণে সেবার কিন্তু ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়। আর হ্যাঁ এবার কিন্তু এশিয়ান দেশগুলোর খেলায় সবাই একজোট হয়ে খেলা দেখেছি। এখনো চোখে ভাসে সেই লাল নীল গ্যালারী।
এরপর ক্যারিয়ার আর পেশাগত ব্যাস্ততা নিয়ে বিশ্বকাপ দেখেছি দুইটা। ২০০৬ আর ২০১০ এর বিশ্বকাপ। এই দুই বিশ্বকাপে প্রতিটি বড় দলের খেলাই এনজয় করেছি। বিশেষ করে ২০১০ এর বিশ্বকাপে সেই শৈশবের প্রিয় দল হল্যান্ড এর খেলা তন্ময় হয়ে দেখেছি। খুব আশা ছিল এবার অধরা স্বপ্ন ধরা দিবে। যদিও ভালো দলই জিতেছে, স্পেন। এবারের ২০১৪ এর বিশ্বকাপ ফুটবলে আমার সাপোর্ট পাবে পাঁচদল। প্রথম দুটি সেই পুরাতন প্রেম... ব্রাজিল এবং হল্যান্ড। এরপর রয়েছে স্পেন, জার্মানি আর জাপান। আপনার পছন্দের তালিকা কোনটি?