পরদিন ভোরবেলা আমাদের পরিকল্পনা ছিল পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপটি সৈকত ধরে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে নয়জনের দল বের হয়ে পরলাম সাড়ে ছয়টা নাগাদ। দক্ষিণপার ধরে আমরা হাঁটতে আরম্ভ করলাম। আমাদের সাথে সাথেই যেন যাত্রা শুরু করলো রক্তিম সূর্য পুবাকাশে...। ধীরে ধীরে আমরা লোকালয় পার হয়ে গেলাম, সাথে সূর্য মামা তার রূপ পাল্টাতে লাগলো, তীব্র হতে লাগলো রোদের তেজ। কিন্তু ভালো লাগাও বাড়তে লাগলো, সমুদ্রের নীল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল। কখনো ঝোপঝাড়, কখনো নুড়িবালি, কখনো কোরালের ঢিবি মাড়িয়ে আমরা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গিয়েছি তীর ধরে। সমুদ্রের নীল রূপ কিছু কিছু জায়গায় এতই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, সেখান থেকে নড়তে মন সায় দিচ্ছিলো না। বাকহীণ হয়ে শুধু চেয়ে থাকা...! ১২ কিলোমিটার পথ প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টায় মাড়িয়ে ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে এসে পৌঁছলাম......
ছোট বেলা থেকে আমার একটা কাল্পনিক জগত ছিল সমুদ্রকে ঘিরে। আমার কাছে সমুদ্র মানেই চোখে ভেসে উঠত একটি ছবি। বিশাল এক বালুতট, ঠিক আমাদের কক্সবাজার সৈকতের মত দীর্ঘ, কিন্তু তার কূল ঘেঁষে আছে কিছু ছোট ছোট ঝাউবন আর সুদীর্ঘ নারিকেল গাছের সারি। সৈকতের প্রস্থ প্রায় শ’পাঁচেক মিটারতো হবেই। সেই সৈকতে আমি একটি বেঞ্ছিতে শুয়ে আছি, মাঝরাত, আকাশে এক বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। জোছনায় সমুদ্রের পানি চিকচিক করছে। দূরে ছোট ছোট জেলে নৌকা দেখা যায়। জোছনার আলো ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় আলো নেই সেই সৈকতে। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া আর কোন দ্বিতীয় শব্দ নেই সেই স্থানে। কিন্তু বিধিবাম, প্রথমবার সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমার আশৈশব লালিত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। সেবার প্রথমে গিয়েছিলাম পতেঙ্গা, সেখান থেকে কক্সবাজার এবং টেকনাফ। হ্যাঁ ইনানী সি-বিচেও গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও আমার সেই স্বপ্নের সৈকতের দেখা পাই নাই। অনেকে সেবার বলেছিল যে সেন্টমার্টিন গেলে তুমি তোমার স্বপ্নের সৈকত দেখতে পাবে। কিন্তু অনেক কারনে আর সেন্টমার্টিন যাওয়া হল না। হুমায়ুন আহমেদের “দারুচিনি দ্বিপ” এর মত আমার প্রতিবারই সেন্টমার্টিন যাওয়া থেমে গেছে টেকনাফ পর্যন্ত গিয়ে। সেই গল্পে আজ আর নাই গেলাম। এবার মূল গল্পে আসি।
গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ একটা ইভেন্ট রাখলো “নারিকেল জিঞ্জিরায় পূর্ণিমায় মধুচন্দ্রিমা অথবা জোছনা বিলাস”!!! গ্রুপের এক নিউলি ম্যারিড কাপল এর কথা মাথায় রেখে। ফ্যাসাদে পরলাম আমরা কর্মজীবীরা। দুইদিনের ছুটি ম্যানেজ করে যোগ দিলাম ইভেন্টে। বৃহস্পতিবার রাতের বাস ছিল, ঢাকা টু টেকনাফ। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ফকিরেরপুল থেকে গাড়ি ছাড়ল, দলের চারজনকে ফেলে রেখে! সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, পুরো ঢাকা শহর জ্যামে প্যাক। দলনেতা রবিউল হাসান খান মনা সবাইকে ফোন করে ৪টার দিকেই এই খবর জানিয়ে দেয়ার পরও ঐ চারজন লেট করে বের হওয়ার খেসারত দিল বাস মিস করে। যাই হোক আমরা বাকী ১৬জনের দল রওনা হলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। পথে কোন তেমন একটা জ্যামে না পরায় আমরা সকাল আটটা নাগাদ টেকনাফ এর সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের ঘাটে পৌঁছে গেলাম।
সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে আমরা “কুতুবদিয়া” নামক জাহাজে করে রওনা হলাম সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ। বলে রাখা ভালো সিজনে এই রুটে চারটি জাহাজ চলাচল করে। টেকনাফ থেকে ছাড়ে সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ আর টেকনাফ থেকে দুপুর তিনটা নাগাদ। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই জাহাজগুলো বন্ধ থাকে। তখন স্পীড বোট আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা হয় একমাত্র ভরসা, যদিও তা রিস্কি।
জাহাজ ছাড়ার কিছু সময় পর নাফ নদী ছেড়ে আমাদের জাহাজ পড়ল বঙ্গোপসাগরের জলে।
সাথে সঙ্গী হয়ে উড়তে থাকলো মায়াকারা সিগালের ঝাঁক। শ’খানেক সিগালের উরন্ত ঝাঁক আর সাগরের বুক চিরে সফেদ ঢেউ দেখতে দেখতে পৌঁছলাম নারিকেল জিঞ্জিরা। ও হ্যাঁ পুরো সময় জুড়ে চারটি জাহাজ একসাথে চলেছে, আর তাই জেটিতে ভিড়লোও একসাথে। কিন্তু লম্বাটে জেটি হওয়ায় একটির গাঁয়ে আরেকটি, এভাবে ভিড়ল; আমাদেরটা পড়ল তিন নাম্বারে। আড়াই ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা’র আনন্দ মাটি করে দিল জলযান থেকে অবতরণের এই যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। পুরো এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এবং ভিড়ের মাঝে আলুভর্তা হয়ে সেন্টমার্টিন এর মাটিতে পা রাখলাম বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। কিন্তু একি! এই রুপ স্বপ্নের সেন্টমার্টিন এর? আশাহত হলাম। বাজার মনে হল একটা, মানুষ আর মানুষ, দোকানপাট, হই-হুল্লোড়... সব মিলে বিশ্রী অবস্থা।
যাই হোক আগে থেকে আমাদের জন্য “সমুদ্রপুরী রেস্টহাউজ” বুকিং করে রেখেছিলেন ‘আন্ডার ওয়াটার স্কুবা ড্রাইভার’ মুজিব ভাই। জেটি সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত ঘেঁষা রেস্ট হাউজে আমরা ষোল জনের দল লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। অনেকে গোসল সেরে নিলাম, ছেলেরা দৌড় দিলাম মসজিদের দিকে... জুম্মা নামাজ ধরতে।
নামাজ শেষে লাঞ্চের পালা, গেলাম ‘প্যারাডাইস প্যালেস’ হোটেলের রেস্টুরেন্টে। খুবই মানসম্মত খাবার, আর স্বাদও ভালো। আমরা তিনদিন ছিলাম সেন্টমার্টিন এ, সেই তিনদিন প্রতিবেলাই ওখানে খাবার খেয়েছি। খাবার শেষে হুমায়ুন আহমেদ এর ‘সমুদ্র বিলাস’ সংলগ্ন সৈকতে হাঁটতে বের হলাম কয়েকজন, কয়েকজন গেল রেস্ট হাউজে রেস্ট নিতে। আমি আর বন্ধু মনা সস্ত্রীক সূর্যাস্ত পর্যন্ত হেঁটে বেড়ালাম সৈকতের বালুতটে। সেন্টমার্টিন এর সেই সূর্যাস্ত আজীবন মনে থাকবে। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ রেস্টহাউজে ফিরলাম। রাতের খাবার খেয়ে আবার হাঁটাহাঁটি করতে বের হলাম সমুদ্রপারে। কিন্তু ভালো লাগছিলো না, সেন্টমার্টিন এর যে রূপের কথা শুনে এসেছি, তা খুঁজে পাচ্ছিনা যে...।
ডেরায় পৌঁছে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে ইয়া বিশাল সাইজের ডাবের শীতল মিষ্টি পানি পান করলাম। নাশতা সেরে রেস্টহাউজে ফিরলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে ঢাকায় ফেলে আসা চারজনকে নিয়ে ক্লাব সভাপতি টুটু ভাই হাজির হলেন। বিশজনের দল দুপুরবেলা গেলাম সমুদ্রস্নানে। ঘণ্টা তিনেকের সমুদ্রস্নান শেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে লাঞ্চ শেষ করে রেস্টহাউজে ফিরে সবাই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
বিকেলে নৌকায় করে রওনা হলাম ছেঁড়া দ্বীপের দিকে। ঢেউয়ের দুলুনিতে ভয়-আনন্দ-শিহরন মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে প্রায় আধঘণ্টার বেশী সময় পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম ছেঁড়াদ্বিপে। সে জায়গাটায় ও দেখালাম বাঁশের ছাউনি দিয়ে টঙ্গের দোকান নিয়ে বসে আছে লোকজন, সাথে চিপস, জুস ইত্যাদির প্যাকেট। হায়রে বাণিজ্য। যাই হোক আমরা সেখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিলাম। সূর্যাস্ত শেষে সাতজনের একটি দল হেঁটে হেঁটে রেস্টহাউজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। পূর্ণিমা রাতে জোছনার আলোয় হাঁটতে ভালই লাগছিল। কিন্তু পা সারা দিতে চাইছিলো না, সারা দিনে মোট ২১ কিলোমিটার এর হাঁটা, তাও আমার মত হাল্কা-পাতলা মানুষের?
রাতে আয়োজন ছিল বারবিকিউ পার্টির, সামুদ্রিক মাছ সাথে চিকেন। আগুনে ঝলসানো মাছ-মাংসের সাথে ছিল পরাটা, সালাদ, আচার, সস উইথ কোল্ডড্রিঙ্কস। জোছনায় স্নাত হয়ে খোলা আকাশের নীচে আলোআঁধারির মায়াময় পরিবেশে সেই বারবিকিউ ছিল অপূর্ব। সকালবেলার ১২ কিলোমিটার জার্নি আর এই বারবিকিউ এই ট্যুরকে করেছে স্মৃতিময়। যারা সেন্টমার্টিন গিয়েছেন অথচ সমুদ্র সৈকত ধরে পুরো দ্বীপ হেঁটে ঘুরে দেখেন নাই, তারা আসলে খুব বিশাল কিছু মিস করেছেন। খাওয়া শেষে রাত বারোটা নাগাদ জেটি সংলগ্ন ভেড়ানো মাছ ধরার নৌকায় বসে কিছুক্ষণ গল্প আর গানে মেতে থেকে ঢুকে পরলাম জেটি সৈকত সংলগ্ন আমাদের রেস্টহাউজে।
শেষের দিন সকালে প্রথমেই সবাই নিজ নিজ লাগেজ গুছিয়ে নিলাম। সেদিন ছিল এই ইভেন্টের মূল আকর্ষণ স্নরকেলিং এবং স্কুবা ড্রাইভিং। মুজিব ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে জনা চারেক ভ্রমণসাথী মেতে উঠল স্কুবা’র প্রাথমিক দীক্ষায়; আগামীতে স্কুবা ড্রাইভ দিবে দারুচিনি দ্বীপের নীল জলে।
দুপুর নাগাদ সমুদ্রস্নান শেষে আমরা লাঞ্চ করে তিনটার দিকে উঠে বসলাম ফিরতি জাহাজে। পেছনে ফেলে আসা মায়াময় দ্বীপ বারেবারে কেমন করে যেন ডাকছিল আমায়। ফিসফিস করে বললাম আসছি আবার, খুব শীঘ্রই...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:১৮