কেনে পিরিতি শিখাইলা ও বন্ধু
চলে যাইবা যদি।
আমি কেমনে রাখিব তোর মন
আমার মনের ঘরে বাঁধি...
রে বন্ধু চলে যাইবা যদি।
বাউল গানের কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিম এমন অসংখ্য গান রচনা করে গেছেন যা পাথরের বুকেও ভালবাসা জাগায়। আর এই আব্দুল করিমসহ অসংখ্য প্রেমময় উপাখ্যান নির্মাতার আবাসভূমি হাওরকন্যা উত্তরের সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের পল্লী ও লোক সংস্কৃতিতে আমরা পাই মাঝির ভরাট গলার গান, রাখালের বাঁশির সুর। এছাড়া হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য আউল, বাউল, পীর, ফকির, দরবেশ, বৈষ্ণব-সন্ন্যাসীদের অসংখ্য সৃষ্টিশীল গান যা মানুষকে পরমেশ্বরের সন্ধান পেতে সাহায্য করে। এগুলোও আমাদের এক মূল্যবান রত্নভান্ডার। আর এই সবকিছু যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তা হল এই অঞ্চলের হাওরসমূহ।
হাওর আসলে কি? হাওর হলো সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর। প্রচলিত অর্থে হাওর হলো বন্যা প্রতিরোধের জন্য নদীতীরে নির্মিত মাটির বাঁধের মধ্যে প্রায় গোলাকৃতি নিচুভূমি বা জলাভূমি। তবে হাওর সব সময় নদী তীরবর্তী নির্মিত বাঁধের মধ্যে নাও থাকতে পারে। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতি বছরই মৌসুমী বর্ষায় বা স্বাভাবিক বন্যায় হাওর প্লাবিত হয়, বছরের কয়েক মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং বর্ষা শেষে হাওরের গভীরে পানিতে নিমজ্জিত কিছু স্থায়ী বিল জেগে উঠে। গ্রীষ্মকালে হাওরকে সাধারণত বিশাল মাঠের মতো মনে হয়, তবে মাঝে মাঝে বিলে পানি থাকে এবং তাতে মাছও আটকে থাকে। সমগ্র বর্ষাকাল জুড়ে হাওরের পানিকে সাগর বলে মনে হয় এবং এর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়। বছরের সাত মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ পানি শুকিয়ে গিয়ে সেই স্থানে সরু খাল রেখে যায় এবং শুষ্ক মৌসুমের শেষের দিকে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে হাওরের পুরো প্রান্তর জুড়ে ঘাস গজায়, গবাদি পশুর বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠে। হাওরে আগত পানি প্রচুর পলিমাটি ফেলে যায় যা ধান উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাওর অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়।
আর এই হাওরগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর বা টাঙ্গুয়া হাওর, বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি । স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন।
[রামসার কনভেনশন (ইংরেজি: Ramsar Convention) হলো বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের রামসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসমূহ কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরবর্তিতে এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ১,৮২৮টি স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।]
টাংগুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রুপ জলমহালগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তেসুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০.০০০ একর।
টাংগুয়ার হাওর প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ। এ হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়। এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশী গাছগাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় ১৪১ প্রজাতির ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ।নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। শীত মৌসুমে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওর। বিলুপ্ত প্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংষ্টর্ক, শকুন এবং বিপুল সংখ্যক অতিথি পাখি ছিল টাঙ্গুয়ার হাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর। সাধারণ হিসাবে বিগত শীত মৌসুমের প্রতিটিতে ২০/২৫ লক্ষ পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে ছিল বলে অনুমান করা হয়। কোন কোন স্থানে কিলোমিটারের বেশী এলাকা জুড়ে শুধু পাখিদের ভেসে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখী এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী।
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরণা) এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ ও কৃষিজমি। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' (Ramsar site) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। এ হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওড়ে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল, জলকুক্কুট (এই হাওরের ২৮-২৯%) ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে। এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো)। ২০১১'র পাখিশুমারীতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।
এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর। এছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই পাওয়া যেত।
এই ঈদের ছুটিতে বেরিয়ে আসতে পারেন উত্তরের জনপদের টাঙ্গুয়ার হাওর।
Photo Courtesy: vromonbangldesh হাওর, হাওর & হাওর
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৪ রাত ৯:২৬