somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসুর লাল জামা

১৬ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- মা, ও মা ঘুমাইয়া গেছ মা। ও মা, কথা কও না ক্যা। মা, ও মা।
- হাসু, যা তো বিরক্ত করিস না
- মা, হুনো না, ঈদের আর কয়দিন বাকী
- কালকাই তো ঈদ, যা বাইরে যাইয়া খেল, বাপ আমার একটু ঘুমাইতে দে
- আগে কও আমারে আইজি একটা লাল জামা কিনা দিবা। মাঝখানে লাল ছোপ ছোপ থাকব। কাইল আমি লাল জামা পইরা কুরবাণী দেখতে যামু।
- আইচ্ছা, হেইডা পরে দেহা যাইব। এখন যা তো।
- নাঃ আগে তুমি কইয়্যা লও। রোজার ঈদে বাবলু, খোকন, সজীব সবাই লাল জামা পইরা ঘুরতাছিল। ওরা আমার পুরান জামা দেইখা হাসছে।
- আইচ্ছা দেহা যাইব। এখন যা তো।

হাসু খাটের নিচ থেকে প্লাস্টিকের বল নিয়ে বাইরে চলে যায়।

গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা বারোটা ঘর, সেমি পাকা কিন্তু খুব ছোট ছোট। হাসুদের ভিটা ছিল মাদারীপুরের অজো এক পাড়াগায়ে। হাসুর বাবা, রমিজ মিয়া ক্ষেতখামার নিয়ে মোটামুটি ভালই দিনাতিপাত করছিলেন। কিন্তু আডিয়াল খা করাল গ্রাসে দু বছর আগে হাসুরা সব হারিয়েছে। হারান মিয়ার ঢাকায় আসার প্রস্তাব পেয়ে রমিজ মিয়া যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল। চার মাসে গলুয়ের চাল শেষ হয়ে এসেছিল। সেই দিনই হারান মিয়ার সাথে ঢাকায় এসে পরে রমিজের পরিবার। জুরাইনের এক সেমি পাকা বিল্ডিংয়ে ওদের ব্যাবস্থা করে দেয় হারান মিয়া।

ছোট ছোট খুপরীর মত পাশাপাশি বারোটা ঘর। বাড়ির গেটে হারান টোকা মারতেই ওরা এক মহিলার গোঙ্গানীর আওয়াজ পেল। ভাত দিতে দেরী হওয়ায় ওই মহিলার স্বামী তাকে অকথ্য গালিগালাজ করছিল। রমিজ মিয়ার যত সমস্যাই গিয়েছে সে মনোয়ারার সাথে কখনো এই ভাষায় কথা বলেনি। সেই বাসায় পা দিয়েই মনোয়ারার বুক কেপে উঠেছিল অজানা শংকায়। যাই হোক হারান মিয়ার কাছ থেকে একটা খুপড়ীর মত রুম বুঝে নিয়ে রমিজ মিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাচল। পরদিন হারান মিয়া রমিজ মিয়ে তার রিক্সা গেরেজে নিয়ে যায়। মহাজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রোজ ৬০ টাকা জমা। রমিজ মিয়া রিক্সা পেল। যদিও সে কিছুই চেনে না তার পরেও সে দিন ১২০ টাকা আয় হয়েছিল তার। টুকটাক কিছু সদায় করে বাড়ি ফিরছিল, আর তার একটা একটা সপ্নের জাল বুনছিল...ছেলেকে ভাল স্কুলে ভর্তি করতে হবে, মনোয়ারার জন্য একটা শাড়ী কিনতে হবে, টাকা জমিয়ে সে কি করবে এই সব হাজারো চিন্তা। সে দিনটার কথা রমিজ যে কতবার শুনিয়েছিল মনোয়ারাকে।এ ভাবে বছরটা ভালই গিয়েছিল। রমিজ মিয়া, হারান মিয়াকে ধরে রিক্সার লাইসেন্স বের করে ফেলল। তখন বেশী উপার্জনের জন্য বড় রাস্তায় চালানো শুরু করল। বড় রাস্তায় চালানোর দ্বিতীয় দিনেই এক্সিডেন্ট করে মারা যায় হাসুর বাপ। মনোয়ারা এখন বাসায় বাসায় কাজ করে।হারান মিয়াই তাদের আগলে রেখেছে।এই নিচু শ্রেণীতে ক্ষুধার্ত পুরুষের সব দৃষ্টি থেকে তাকে রক্ষা করে রেখেছে হারান মিয়াই।

ঘুম থেকে উঠে হাসুকে নিয়ে কাজের বাসায় যায় মনোয়ারা। আজ একটু দেরী হয়ে গেছে। মনোয়ারা এই বাসাতে কাজ করছে প্রায় মাত্র এক মাস। বেগম সাহেবার একটা ছেলে আছে, সে হাসুর চেয়ে বড়ই হবে। হাসু তার সাথে খেলতে পারে। আগে যে বাসায় কাজ করত তার সাহেবের বদলী হওয়াতে তারা চট্টগ্রাম চলে গেছে। এখন এই নতুন বাসায় ঈদের বখসিস চাওয়াটা তার বাধছে...মাত্র এক মাস কাজ করেছে সে এখানে। লজ্জামাখা মুখে সে বেগম সাহেবার কাছে হাসুর জন্য একটা জামা আবদার করল।বেগম সাহেবা এত অল্পদিনে ঈদের বকশীশ দিতে চাইলেন না, আবার মনোয়ারার মনও ভাঙ্গতে চাইলেন না। ও এই কথা দাঁড়াও বলে সে তার ছেলের একটা লাল জামা নিয়ে এলেন। আর বললেন, এই জামাটা অনেক দামী, এক হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। বাবু এটা দু মাস মাত্র পরেছে। এদিক দিয়ে একটু ছিড়ে গেছে, একটু সিলিয়ে নিও। ঠিক আছে, খুশি তো। মনোয়ারা আর কিছু বলতে পারল না। মনোয়ারা দেখল, জামাটা ছেড়া হলেও দেখতে সুন্দর...ধোয়া মনে হল তার কারন ময়লা নেই। হাসুর গায়ে মানাবে। একটু সেলাই করতে হবে এই আর কি? মনোয়ারা হাসুকে ডাক দিলেন, “হাসু, চল চল বাড়ি চল, আর খেলতে হবে না, জামা কিনতে হবে না।” বেগম সাহেবা কিছু বুঝলেন না। মনোয়ারা তাকে আরো বিভ্রান্ত করতে মুচকি হাসি দিয়ে হাসুকে নিয়ে চলে আসল।

- মা, ও মা
- কি কস
- আমি স্কুলে যামু। অনিকের অনেক বই। আর আমার বই একটা। অনিকের বইতে কত রকম ছবি আকা আছে।আমারি তুমি কিন্তু একটা ছবিয়ালা বই কিনা দিবা।
- কি ব্যাপার মা, বাড়ির দিকে ঢুকতাছ ক্যান, মার্কেটে যাইবা না। আমার জামা কিনবা না।
- হ বাবা, ক্ষুধা লাগছে তো, আগে গোসল টোসল কইরা লই, তার পরে খাইয়া একটু ঘুমাবি। তার পর তরে নিয়া মার্কেটে যামু। এখন গেলে তরে মাইনষে দেখলে কি কইব।
- কি কইব
- কইব, ইস ক্যামুন দেহা যায়।খায় নাই, ঘুমায় নাই।
- ঘুম থাইক্যা উইঠ্যাই কিন্তু তুমি আমারে লইয়া মার্কেটে যাইবা।
- হ হ ঠিক আছে এখন তাড়াতাড়ি চল।

বাড়িতে এসে আর ঝামেলা করে না হাসু। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে মনোয়ারা পাড়ার দোকানদারের কাছে গিয়ে রিপু করিয়ে এনে ইস্ত্রী করিয়ে এনে একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। হাসু ঘুম থেকে উঠেই দেখল তার পাশে একটা শপিং ব্যাগ পরে আছে। দেখে ওটার মাঝে একটা লাল জামা। লাল জামা দেখেই তার মনটা যেন খুশীতে টগবগ করতে লাগল। লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমেই চিৎকার করা শুরু করল, “মা, ওমা”
- আইতাছি, হাক দিল মনোয়ারা।
- মা, ও মা,
- আরে বাবা আইতাছি তো
- এইডা আমার নতুন জামা
- হ বাবা, পর তো দেহি, গায়ে লাগে নাকি দেহি

মনোয়ারা জামার ভাজ খুলে পরিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলের হাসি ভরা খুশী মুখ দেখে তার মনটা ভড়ে গেল। হাসুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার রমিজের মুখখানি মনে পড়ে গেল। হাসুকে কতই না ভালবাসত রমিজ। আর তাদের ভালবাসাবাসির ধনকে নাকি অন্যের ফেলে দেয়া জামা পড়াতে হচ্ছে। হঠাৎ বুকটা তার ভারী হয়ে গেল। বুক ফেটে যেন একটা গরম বাতাস বের হয়ে গেল। হাসুর সে দিকে খেয়াল নেই, মা এটা ভাজ করে রাইখ, কাইলক্যা পড়মু। হাসু জামাটা মার দিকে ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে বাইরে খেলতে চলে। গেল। মনোয়ারা হাসুর যাবার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর চোখ দিয়ে যেন তপ্ত লালঅশ্রু বয়ে যাচ্ছে....।


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৩৮
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×