সক্রেটিস ( Socrates) সম্পর্কে আমরা বেশিরভাগ জানতে পারি তারই একজন শিষ্য বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর (Plato) বিভিন্ন লেখনী থেকে। প্লেটো সক্রেটিসের নিকট দীর্ঘ আট বছর শিক্ষা নিয়েছিলেন। সক্রেটিসের বিচারের সময় প্লেটোর বয়স ছিল আটাশ বছর। তিনি সক্রেটিসের বিচারের কার্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন। প্লেটো তার "অ্যাপোলজি (Apology)" নামক রচনায় সক্রেটিসের আত্মপক্ষ সমর্থনের বর্ণনা অত্যন্ত সততার সাথে চিত্রিত করেছেন।
সক্রেটিস, যিনি - " নিজেকে জানো ( know thyself)" এবং " সদগুণই জ্ঞান (Virtue is knowledge) " এ দর্শনের জন্য সুপরিচিত - তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি অধর্মাচার, দেবতা বিরুদ্ধতা এবং এথেন্সের যুবকদেরকে কলুষিত পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রকৃত অভিযোগ ছিল অন্য। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়, এ বলে যে, তিনি স্পার্টাদের সাথে এথেনীয়দের যুদ্ধচলাকালে বিদ্রোহীদের সঙ্গ দিয়েছিলেন। এবং, ৪০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের পরাজয়ের পরও ততকালীন অভিজাত শ্রেণির গনতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবের ষড়যন্ত্র করছিলেন।
এছাড়া তিনি চারমাইডিস, ক্রিটিয়াস ও আলচিবাইডিস - যিনি এথেন্সের একজন কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক - এর সঙ্গ দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
তবে তাকে মৃত্যদন্ড দেয়া মূল উদ্দেশ্য ছিলনা। উদ্দেশ্য ছিল তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা; তিনি যাতে করে তার দার্শনিক যুক্তি ও সমালোচনার মাধ্যমে এথেনীয় গনতন্ত্র কাঠামোরর ভিত্তি দুর্বল করতে না পারেন। প্লেটো তার অ্যাপোলজি-তে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, সে-সমাজের রীতি অনুযায়ী সক্রেটিসের দেশ ত্যাগের সুজোগ ছিল।
সক্রেটিস চাইলেই এ মৃত্যুদণ্ড সহজে এড়িয়ে যেতে পারতেন, যদি তিন বিচারক ও অভিজাত নাগরিকদের নিয়ে অবজ্ঞা প্রকাশ না করতেন, অথবা যৎসামান্য জরিমানা দিতেও রাজি হতেন কিংবা দেশত্যাগ করে চলে যেতেন । (মূলত বিচারক এবং অভিজাত শ্রেণীর প্রতি প্রকাশ্যে অবজ্ঞা প্রদর্শনই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।)
কিন্তু পালায়ন করা বা অর্থদণ্ড প্রদান করা তার কাছে ছিল অপরাধ স্বীকার করারই নামান্তর ।
সক্রেটিসের মতে - পালিয়ে যাওয়া হল সম্পূর্ণ রূপে বেআইনি, অনৈতিক আর সমাজের সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিক যে সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ তার বরখেলাপ ।
এছাড়া তিনি যুক্তি দেখান যে - ব্যক্তিকর্তৃক সমাজের কোন বিধান ভঙ্গ হলে পরে তা দলবদ্ধ জীবনের ভিত্তিমূলে আঘাত করে।
সক্রেটিস তার দর্শনের বিমূর্ত সত্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। আর তাই সব কিছুর সাথে আপোষহীন হয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুদণ্ড নিয়েছিলেন ।
৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বের সেইদিন আদালত হেমলক বিষ পানে সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। রায়ের মাস খানেক পর সক্রেটিস তার হিতাকাঙ্খী বন্ধুদের উপস্থিতি তে হেমলক বিষ পান করেন।
প্লেটো বলেন, সক্রেটিস আদালতে তার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাই মূলত - অ্যাপোলজি - অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থন । তিনি বিচারকদের বাধ্য করেছিলেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে। এবংকি তিনি কোনো ধরণের লঘুদণ্ড নিতেও অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু কী এমন দর্শন যার জন্য সক্রেটিস মৃত্যুদণ্ডকে বেছে নিয়েছিলেন ?
প্লেটোর বর্ণনায় সেদিনের আদালতে সক্রেটিস যে বিষয় গুলি আলোকপাত করেছিলেন সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ -
১। "সত্যিকারের প্রজ্ঞা নিহিত থাকে কিছু না জানার সহজ স্বীকারোক্তির মাঝে।"
তিনি এ কথা এজিন্যই বলেছিলেন যে- ডেলফাইয়ে অবস্থিত এপোলো তীর্থের বিখ্যাত ওরাকলের মতে জীবিত আর কেউ নেই যে সক্রেটিসের মত জ্ঞানী । সক্রেটিস এটা বিশ্বাস করলেন না। তিনি জুরিদের বললেন যে তিনি তাদের কথা ভুল প্রমাণিত করবেন। এর পর তিনি নানান জ্ঞানী মানুষের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন।
সক্রেটিস প্রথমে রাষ্ট্রনায়কদের সাথে দেখা করলেন এবং দেখলেন যে তারাই সবচেয়ে বড় জ্ঞানহীন ।
এরপর তিনি কবিদের কাছে গেলেন এটা দেখার জন্য যে- তাদের কেউ তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী কিনা। তিনি দেখলেন যে তাদের কবিত্বের ভিত্তি প্রজ্ঞা নয়, বিরং প্রেরণা । তারা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন কিন্তু জানেনা তার কিছুই। তারা কবিত্বের বলে বড়াই করে বলে যে, তারা সর্বজ্ঞ।
তারপর তিনি চারু ও কারুশিল্পীদের কাছে গেলেন । তারা অনেক সুন্দর জিনিষ তৈরি করতে পারেন । কিন্তু তারাও কবিদের মতো তাদের সৃষ্টি ক্ষমতার জন্য খুব বড়াই করতে লাগলেন এবং জুতা তৈরি করার মতো দক্ষতার জন্য নিজেকে সর্বজ্ঞ দাবী করতে লাগলেন। এতেকরে তাদের জ্ঞানের দাবী দুর্বল হয়ে পড়লো । সক্রেটিসের কাছে বিষয় গুলো দৃষ্টিকটু লাগলো।
সক্রেটিস অবশেষে বুঝতে পারলেন যে- রাষ্ট্রনায়ক, কবি, কিংবা ভাস্কর - এরা কেউই প্রকৃত জ্ঞানী না।
ওরাকলের ভাষ্যের মানে এটা ছিলনা যে - সক্রেটিস সবচেয়ে জ্ঞানী বরং এটা ছিল যে,সক্রেটিস অন্তত জানেন যে তিনি কিছুই জানেন না।
২। সক্রেটিসের দ্বিতীয় দর্শনটি হল : আত্মার উৎকর্ষ ঘটানো , সত্য ও প্রজ্ঞার পরিচর্যা করে পরম শুভ ও কল্যাণে পৌঁছানো ।
সক্রেটিসের মতে অর্থসম্পদ থেকে উৎকর্ষ অর্জন হয় না। তিনি সত্য ও প্রজ্ঞার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করার আগেই অর্থখ্যাতি-সম্মান বা দৈহিক চাহিদা হতে বিরত থাকতে বলেন।
তারমতে - আত্মার উৎকর্ষ অর্জন হলেই কেবল মানবজাতি , ব্যক্তি এবং সাধারণের অর্থসম্পদ সহ যাবতীয় কল্যাণ অর্জন হতে পারে।
সক্রেটিসের বলেন, " আমার এই মতবাদ যদি যুবসমাজকে কলুষিত করে তবে অবশ্যই আমি অনিষ্টকারী । আর কেউ যদি বলে যে আমি এছাড়া অন্যকিছু প্রচার করি বা শিক্ষা দিই, তবে অবশ্যই সে মিথ্যাচারী ।"
৩। সক্রেটিস বলেন, "তোমরা আমাকে যদি দোষারোপ কর তাহলে যে ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন তোমরা তার বিরুদ্ধে পাপ করবে।"
সক্রেটিসের মতে তিনি হলেন এক উড়ন্ত মাছি ( Gadfly ) যাকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন এই পশুর ন্যায় বিশাল আকৃতির ধীরগতি আর জড়সড়ভাব রাষ্ট্রকে হুল ফুটিয়ে জাগ্রত করার জন্য।
তিনি বলেছিলেন, " তোমরা আমার মতো আরেকজনকে পাবেনা "।
৪। সক্রেটিসের ভাষণের ৪র্থ বিষয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল : "সদগুণই জ্ঞান ( Virtue is knowledge )" এই নীতি । এ নীতি অনুযায়ী সৎকর্ম কি তা জানার অর্থ হল সৎকর্ম করা। আর দুষ্ট, অনাচার বা কুঅভ্যাস হল জ্ঞানের অভাব বা অজ্ঞতা ।
সদগুণই যদি জ্ঞান হয়ে থাকে বা ভালো কী তা চিনতে পারাই যদি ভালো কাজ করা হয়ে থাকে, তবে অন্যায়ের উৎস হল, ভালো কী, তা না-চিন্তে পারা।
তার একটি বিখ্যাত উক্তি হল, " কেউ স্বেচ্ছায় অশুভ বা দুষ্ট কাজে লিপ্ত হতে পারেনা ।"
মানুষ কখনোকখনো বলে যে, সে তার সদ্বিবেচনার বিরুদ্ধে কাজ করেছে বা সে এর চেয়েও ভালো কিছু করবার যোগ্য। কিন্তু সক্রেটিসের মতে, এটা একটা উদ্ভট দাবী ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, আপনি যদি সত্যি সত্যি সঠিক কাজ কি তা জানতেন , তাহলে অবশ্যই তা করতেন। আপনার বিচার ক্ষমতা যদি সত্যই উন্নত হতো তাহলে আপনি তার পক্ষে কাজ করতেন। বিপক্ষে নয়।
সক্রেটিস দাবী করেন - মানুষ যখন কোনো দুষ্ট কাজে লিপ্ত হয়, তখন সে সেটা থেকে লাভ পাওয়ার আশা থেকেই সেটা করে। চুরি করা ভুল জেনেও যখন কোনো চোর একটা হীরার আঙটি চুরি করে, তখন সে তা করে কোনো সুন্দরী ললনার মন পেতে বা তার যৌনবাসনা চরিতার্থ করার আশায়। আবার কেউ যখন সম্পদ, ক্ষমতা, বা সুখ্যাতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করে, তখন সে সুখী হওয়ার বিশ্বাস থেকেই তা করে।
তিনি বলেন, মানুষ জানে না কোন কর্ম,সৎকর্ম। মানুষের জন্য - শুভ কী, কোন কর্ম তার জন্য সুখ আনতে পারে, বা কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে - এসব জানতে হলে জানতে হবে মানুষের সঠিক প্রকৃতি । মানুষের প্রকৃতিকে না জেনে, কোন জিনিস মানুষের জন্য মঙ্গলজনক তা না জেনে, তার জন্য প্রচেষ্টা করা, কোনো কিছু অর্জন করার লড়াই হলেও, তা থেকে সুখলাভ সম্ভব নয়।
আর এসব যারা জানেন না, সক্রেটিসের ভাষায় তাদের জীবন অপরীক্ষিত । তার মতে , " অপরীক্ষিত জীবন-যাপন করা অর্থহীন ।"
সক্রেটিস হেমলক পান করে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন, এবং তিনি এটা করেন তার বন্ধুদের সামনে যারা তাকে পালিয়া যেতে বলেছিল। প্লেটোই সর্বপ্রথম সক্রেটিসকে শহীদ হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। তিনি তার ফিডো নামক রচনার শেষ লাইনে লিখেছিলেন :
"এটাই আমাদের বন্ধুর শেষ পরিণতি, যিনি ছিলেন তার সময়ের সবচাইতে প্রাজ্ঞ, জ্ঞানী এবং ন্যায়নিষ্ঠ" ।
তথ্যসূত্র বই :- সক্রেটিস থেকে সার্ত্রে; দার্শনিক অন্বেষা
লেখক: টি জেড লেভিন।
April 14,2020
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৩