somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রকাশক বললেন, ‘আপনার লেখাটা ক্লাসিক হয়নি’

০১ লা আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘আপনার পান্ডুলিপিটা আমরা পড়েছি। আপনার কবিতা লেখার হাত ভালো। কিন্তু ভাই এই বইটা আমরা করতে পারবো না। আপনার লেখার ডেপথ নাই। সামগ্রিকতা ছুঁতে পারেন নি। এছাড়া এডাল্ট কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। সবাই পড়তে পারবে এমন বই-ই আমরা ছাপতে পারি। আপনার লেখাটা ক্লাসিক হয়নি।’ প্রকাশকের এমন ফোন পেয়ে কার না মন খারাপ হয়?
তরুণ কবি রাহি। রাফিন রাহি। কবিতাকে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান করেছেন। চোখে স্বপ্ন, অনেক বড় কবি হবেন। শেলি, ইয়েটস, জীবনানন্দ দাশ, ট্রান্সট্রোমার, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকের ক্লাসিক বই পড়ে যে বড় হয়েছে। জীবনে কবিতা ছাড়া যে স্বপ্ন দেখে না। শাহবাগের আঁতেলগুলোকে দেখলে যার হাসি পায়। সিরিয়াস কবিতা লিখে বন্ধুদের যে মুহূর্তে চমকে দিতে পারে। সাহিত্য সম্পাদকরা যার কবিতা পড়ে বিখ্যাত কবিদের নাম বলে উদ্ধৃতি টানেন। নতুন কবিযশপ্রার্থীরা তার কবিতা পড়ে বিখ্যাত কবির লেখা মনে করে ভুল করে। এসবই এতোদিন রাহি এনজয় করেছে। একটু সিনিয়ররাও গর্ব নিয়ে রাহির কথা বলে, ‘ছেলেটা খুব সিরিয়াস লেখা লেখে। ওর লেখাগুলো ক্লাসিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু প্রকাশকের এমন মন্তব্যে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের পরিবেশটা খুব বিদঘুটে মনে হলো। এমনিতেই সে খুব বেশি লোকজনের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে না। বিকেলে এসেছিল একটু ঘুরতে। কবিদের সঙ্গে আড্ডাটা সে এড়িয়েই চলে। দু’একজন কাছের বন্ধু ছাড়া সে কাউকে তেমন পাত্তা দেয় না। বন্ধুরা এখনো এসে পৌঁছেনি। সে আর তাদের জন্য দেরি করলো না। মনে হচ্ছে তার পা দুটো কাঁপছে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। একটা রিক্সা নিয়ে চলে এলো বাসায়। নবাবগঞ্জের আ. আজিজ লেনের এক অন্ধকার ঘরে তার বাস। ঘরে একটি জানালা। কিন্তু সেটি দিয়ে আলো বা বাতাস আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ না থাকলে সে সাধারণত ছাদে অথবা বাইরে গিয়ে সময়টা পার করে দিয়ে আসে। কিন্তু আজ আর তার বাইরে যেতে ইচ্ছে করলো না। গরমে সে ঘেমে যাচ্ছে। বাঁশের চাটাই দিয়ে বানান একটা হাতপাখা আছে। কিন্তু ওটা দিয়ে বাতাস নিতেও ইচ্ছে করছে না। ঘরে দিন-রাত বোঝা যায় না। অন্ধকার। একেবারেই অন্ধকার। আসলে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে। জীবন নিয়ে সে বাজি ধরেছিল। সে বোধহয় হেরে যাচ্ছে। বুকে প্রচন্ড ব্যথা মনে হচেছ। কাঁদতে পারলে অনেক হালকা হতে পারতো। কিন্তু চোখে তার একটা রোগ আছে। চোখে কখনই পানি আসে না। কোনো মৃত্যু সংবাদ বা যতো দুঃখের সংবাদই হোক সে কাঁদতে পারে না। কবি হতে পারলো না বলে কি সে সাধারণ মানুষের মতো কাঁদতেও পারবে না! এ তো অভিশপ্ত জীবন। সে মনে মনে বললো, হয় কবিতা, নয় চোখের পানি। একটা আমার চাই-ই ঈশ্বর।

রাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই কবিতা লিখতো। বিভিন্ন দেওয়াল পত্রিকা, স্মরণিকার দায়িত্ব পড়তো তার হাতে। কবিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারে নি। টিউশনি করে যা পেত তা দিয়েই অনায়াসে তার চলতো। লিটলম্যাগ করায় ঢাকা কেন্দ্রিক কবিদের সঙ্গে তার বেশ যোগাযোগ। দু’একটা পত্রিকা অফিসে কিছুদিন কাজও করেছে। কিন্তু ওসবে কবিতার কিছু খুঁজে পায়নি বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সহকর্মীরা তো শুনে অবাক। কিন্তু তার কথা, ‘কবিতার জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি। আর পত্রিকা অফিসতো সেখানে কিছুই না। একজন মানুষের পেট চালানোর জন্য এতো মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন নেই।’ ভন্ডামি সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। সে কবিতার জন্য জীবন দিতেও রাজি।
বাবা-মা অনেক বুঝিয়েছে। কিছুতেই কবিতার নেশা তার কাটে নি। গত বছর মা মারা যাওয়ার আগে ছেলের বউ দেখার বায়না ধরেছিল। ওটাও পাশ কাটিয়েছে। মা মারা গেছে। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে এক ক্লাসমেটের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল। কিন্তু তার আবার কবিতায় অরুচি। পদার্থের হিসাব-নিকাশ নিয়ে থাকতেই পছন্দ করে। ছাপছাপ জানিয়েছে, বাউন্ডুলে স্বভাবের কারো সঙ্গে সে সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে পারবে না। সম্পর্কটা আর এগোয় নি। কবিতার নেশায় পড়ে কোনো নারীকে পরিপূর্ণ মানুষও মনে হয়নি। বাবা তার আর খোঁজও নেন না। দুইটা টিউশনিতে তার ঘরভাড়া আর কোনো মতে খাওয়া-দাওয়া চলে যায়। মাঝেমধ্যে বইয়ের রিভিউ লিখে যা পায় তাতে বন্ধুদের সঙ্গে পিককে গিয়ে শেষ করে।

সে প্রায় সাত বছর চেষ্টা করে এই পান্ডুলিপিটা তৈরি করেছে। সে জানে এতে কী আছে। সমসাময়িক যারা কবিতা লেখে তাদের চেয়ে অনেক ভালো কবিতা সে অনায়াসে লিখতে পারে। এখানকার বেশ কয়েকটি কবিতা বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক পর্যায়ের বলে তার মনে হয়। তরুণ কবিদের কেউ কেউ তা স্বীকারও করেছেন। প্রতিবছর বইমেলায় যে-সব কবিতার বই ছাপা হয়। তার অধিকাংশই অপাঠ্য। সে সব বই দশকের ঘরই পেরোতে পারে না। সে জানে ওইসব কবিতার চেয়ে তার বইটা হাজার গুণ মানসম্পন্ন।

রাহি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না। সে পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো। সে ব্যাগ থেকে তার পান্ডুলিপিটা বের করলো। কিছুক্ষণ আগে বিদ্যুৎ এসেছে। সে পান্ডুলিপির প্রথম কবিতাটা আবৃত্তি করা শুরু করলো।

মৃত্যুর কাছাকাছি যে নক্ষত্র সেই বেশি আলো দেয়

‘মৃত্যুর কাছাকাছি যে নক্ষত্র সেই বেশি আলো দেয়’- এ কথা বলে প্রাচীন কুয়ার মতো এক দীর্ঘ বাতাস উড়ে গেল। থোকা থোকা লাল বটফলের মতো করুণ ক্ষুধার লোভে আমি এই শহরে হাঁটি। শহরের আইল্যান্ডে পাতা ঝড়ার শব্দে নদীর কান্না ভেসে আসে। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় জানালার কার্নিশে জোয়ার ভাটার শব্দে শহরের বয়স বাড়ে।

প্রতিটি ঘুমই মৃত্যুর কাছাকাছি বলে অন্ধকারের মতো রাতকে ওরা নিয়ন আলোয় ছড়িয়ে দেয়। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার মতো প্রতিটি ভোর শুরু হয় হাতুড়ির শব্দে। রেল লাইনের ওপর খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকে যে নারী ট্রেনের হুইসেলের মতো সভ্যতা তাকেও তাড়িয়ে দেয়। হৃদয়ের কালো কালো ক্ষত প্রথম প্রেমিকার মতো ভিমরতির উইলে নাম লেখায়। আবেগের মতো তপ্ত লোহা কালের আগুনে বার্ধক্যের মতো শীতল হয়ে যায়। কালের হাসি কসাইয়ের দোকানে ঝুলানো কলিজার মতো ভীত করে। সূর্য একবার অস্ত গেলে মৃত্যুর মতো আর ফেরে না।

কবিতাটা পড়া শেষে সে হা-হা-হা করে হাসলো। তারপর রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় পান্ডুলিপিটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেললো। কিছুক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদলো। কিন্তু তার চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও বের হলো না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৩১
১৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×