এই ঈদে কোরবানি সংক্রান্ত অনেক গুলি পোস্ট ব্লগে এসেছে। বেশিরভাগ লেখাই আমি পড়েছি। লেখাগুলি পড়ে আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হচ্ছে, এই লেখা গুলিকে মুলত দুইভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথমতঃ অনেকে কোরবানির মাহত্ন্য, ইতিহাস, নিয়মাবলী, উপকার ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ পশু জবাই নিয়ে নাস্তিকদের করা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
যারা এই দুই বিষয়ে লেখেছেন, তাদের প্রতি যথাবিহিত সম্মান দেখিয়ে বলতে চাই যে, সবাই বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়েছেন, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে যে এই কুরবানি সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস বা আল্লাহ কি বলেছেন তা বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। বেশিরভাগ মানুষই এই ইতিহাস শিখেছে পরিবার, মোল্লা বা মসজিদের ইমামের কাছ থেকে। আবার অনেকেই কোরআনের অনুবাদ পড়েও জেনেছেন। কিন্তু কোরআনের অনুবাদ পড়ার সময় আগে থেকে জানা কোরবানির ইতিহাসের কারনে কোরআন থেকেও সঠিক বিষয়টা জানতে পারছেন না। আমি যেটা বুঝি যে, এই কথিত কোরবানির ইতিহাস যা আমরা সবাই জানি তার মুল অংশ বাইবেল থেকে নেওয়া, এই সংক্রান্ত হাদিস গুলির সাথে বাইবেলের অত্যাধিক মিল লক্ষণীয়, যেখানে এই বিষয়ে কোরআনের সাথে এই হাদিস বা বাইবেলের মিল খুব কম। আমি ইহুদীদের মুল গ্রন্থ “পুরাতন নিয়ম” বা “ওল্ড টেস্টামেন্ট” এবং মুসলমানদের প্রধান এবং মুল গ্রন্থ “কোরআন” থেকে এই কথিত কোরবানি সংক্রান্ত লেখা গুলি দেখব যাতে এই বিষয়ে দুই গ্রন্থের পার্থক্য বুঝা যায়, এবং সত্য ঘটনা কি ছিল তা বের করার চেষ্টা করব।
কে ইব্রাহিম কে তার পুত্রকে বলি/কোরবানি/যবেহ দিতে আদেশ করেছিল?
বাইবেল অনুসারেঃ জেনেসিস ২২:১-২
এ সমস্ত ঘটনার পর পরমেশ্বর আব্রাহাম কে যাচাই করলেন। তিনি তাকে বললেন, “ আব্রাহাম, আব্রাহাম!” তিনি উত্তর দিলেন “এই যে আমি”। তিনি বলে চল্লেন, “তোমার সন্তান কে, তোমার সেই একমাত্র সন্তান কে যাকে তুমি ভালবাস, সেই ইসায়াক কে নাও ও মোরিয়া দেশে যাও, আর সেখানে যে এক পর্বতের কথা আমি তোমাকে বলব, তার উপর তাকে আহুতিরুপে বলিদান কর।
কোরআন ৩৭:১০২
অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।
বিশ্লেষণঃ
বাইবেল অনুসারে ঈশ্বর ইব্রাহিম কে যাচাই করতে চান এবং ইব্রাহিমের পুত্রকে বলি দিতে বলেন। এইখানে এটা পরিষ্কার যে বাইবেল অনুসারে, ঈশ্বর স্বয়ং এই কাজের আদেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু কোরআনের ৩৭:১০২ আয়াত সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। এই আয়াত দরকার হলে আরেক বার পড়ে দেখুন। এই আয়াত কোরআনের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়...
১। কোরআন অনুযায়ী (৩৭:১০২) কোথাও বলা নেই যে আল্লাহ নবী ইব্রাহিম কে এই কাজের আদেশ দিয়েছেন। বরং বলা হয়েছে নবী ইব্রাহিম একটা স্বপ্ন দেখছিলেন, এবং কোরআনে কোনভাবেই বলা হয়নি এই স্বপ্ন আল্লাহ দেখিয়েছেন।
২। আমরা কোরআনে দেখতে পাই, আল্লাহ বলেছেনঃ
“মুসলমানের কাজ নয় যে, মুসলমানকে হত্যা করে; কিন্তু ভুলক্রমে (And never is it for a believer to kill a believer except by mistake)”......(৪:৯২)
যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্যে ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।(৪:৯৩)
আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জান না।(Say, "Indeed, Allah does not order immorality. Do you say about Allah that which you do not know?") (৭:২৮)
সুতরাং উপরের এই তিনটি আয়াত পড়লে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আল্লাহ কোন খারাপ কাজের আদেশ দেন না, এবং মানুষ হত্যা অথবা বিশ্বাসীদের হত্যা করা অনেক বড় পাপ কাজ, যার শাস্তি চিরকাল জাহান্নাম। আল্লাহ তাহলে কিভাবে মানুষ হত্যার আদেশ দিতে পারে যেখানে ইব্রাহিম এবং তার ছেলে উভয়েই বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত। যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই আদেশ আল্লাহ দিয়েছেন, তবে কোরআনের ৭:২৮ আয়াতের সাথে সরাসরি কনফ্লিক্ট করে যা কোন ভাবেই সম্ভব না। আমরা জানি আল্লাহর কথা চিরন্তন এবং উনার কথা বদল হয় না (The word of Allah is absolute and Allah never change His mind). এই জন্য ৩৭:১০২ আয়াতে এই স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এই ধরনের কোন কথা বা ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। এইটা বাইবেলের প্রভাবের দরুন মোল্লারা ঐ খান থেকে কপি করেছে। এটা বাইবেলের গল্প কোরআনের নয়।
৩। আমাদের মোল্লারা স্মার্ট। তারা বলেন নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে ওহী। কথা সত্য, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। এর কারন হচ্ছে যদি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন স্বপ্ন দেখানো হয় তাহলে যদি এই স্বপ্ন সত্যি না হয়, তবে এই স্বপ্ন আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এটা সত্য নয়। কারন “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদার অন্যথা করেন না" (৩:৯৩) । সুতরাং যদি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন কিছু দেখানো হয় এবং এটা সত্য না হয়, তবে এটা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে তা বলা যাবে না। উদাহরণ সরূপ আল্লাহ আমাদের নবীকে স্বপ্নের মাধ্যমে যা দেখিয়েছেন তা পূর্ন হয়েছে (৮:৪৩, ৪৮:২৭)। আবার নবী ইউসুফ যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়িত হয়েছে (১২:৪, ১২:১০০)। কিন্তু নবী ইব্রাহিমের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নের সময় আল্লাহ তা থামিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর কোন কথার মধ্যে বৈপিরিত্ত নেই (৪:৮২)। যেই জিনিষ আল্লাহ স্বপ্নের মধ্যে দেখিয়েছেন (যদি তা আল্লাহ দেখিয়ে থাকেন) তা করতে কেন তিনি বাধা দিবেন? সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। তার অর্থ ঐ স্বপ্ন আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি।
৪। নবীরাও মানুষ। তারাও বিভ্রান্ত হতে পারে। আল্লাহ বলেছেন “আমি আপনার পূর্বে যে সমস্ত রাসূল ও নবী প্রেরণ করেছি, তারা যখনই কিছু কল্পনা করেছে, তখনই শয়তান তাদের কল্পনায় কিছু মিশ্রণ করে দিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ দূর করে দেন শয়তান যা মিশ্রণ করে। এরপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়”।(২২:৫২)
কোরআনের ৩৭:১০২ এ যা বলা হয়েছে “তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ”- এই বাক্যটুকু দ্বারা বুঝা যায় যে স্বপ্ন দেখার পর নবী ইব্রাহিম কিছুটা কনফিউসড ছিল। কারন যদি তিনি সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত হতেন যে এটা আল্লাহর আদেশ তবে উনি এই বিষয়ে উনার ছেলের অভিমত জানতে চাইতেন না। উনি সরাসরি আদেশ বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি উনি নিশ্চিত না সেই জন্য উনি তার ছেলের আভিমত জানতে চেয়েছেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে নবী ইব্রাহিম যে স্বপ্ন দেখেছেন তা আল্লাহর কাছ থেকে এসছে বা আল্লাহ এই স্বপ্ন দেখিয়েছেন কোরআন অনুসারে এই ধরনের কথার কোন ভিত্তি নেই।
আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের পুত্রের বলি/কোরবানি/যবেহ বদলে কি দিয়েছেনঃ
বাইবেল অনুসারেঃ জেনেসিস ২২:১৩
তখন আব্রাহাম চোখ তুলে দেখতে পেলেন, পাশে একটা ভেড়া, তার শিঙ একটা ঝোপের মধ্যে জড়ানো। আব্রাহাম গিয়ে সেই ভেরাটা নিলেন ও নিজের ছেলের বদলে আহুতি রুপে তা বলিদান করলেন।
কোরআন ৩৭:১০৭
وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
We made a concession for him in place of a great slaughter
And We ransomed him with a great sacrifice
And We ransomed him with a momentous sacrifice
বিশ্লেষণঃ
আমাদের মুসলমানদের মধ্যে যে গল্প চালু আছে যে নবী ইব্রাহিমের ছেলের পরিবর্তে আল্লাহ একটা ভেড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন, এবং নবী ইব্রাহিম ঐ ভেড়া জবাই করেছেন তার উৎস ঐ বাইবেল। কোরআনে এই ধরনের কোন কথা বলা হয় নি।
কোরআনের ৩৭:১০৭ আয়াতে তিনটা শব্দ এসেছে। প্রথম শব্দ وَفَدَيْنَاهُ বা “ফাদাইনাহ” এর অর্থ concession or ransom । এর অর্থ কোনভাবেই কোরবানি বা স্যক্রিফাইস না । এর জন্য ২:১৯৬ দেখুন।
দ্বিতীয় শব্দঃ بِذِبْحٍ “বিজিবিহিন” অর্থ “with slaughter” or “in place of slaughter” কোরআনের ৩৭:১০৭ এর অর্থ অনুযায়ী এই slaughter দ্বারা নবী ইব্রাহিমের পুত্রকে জবাই করা অর্থে বোঝানো হয়েছে, অন্য কোন প্রানী বা ভেড়া কে বুঝানো হয়নি। কারন ৩৭:১০২ এ أَذْبَحُكَ শব্দ দ্বারা নবী ইব্রাহিমের পুত্রকে জবাই করা অর্থে বোঝানো হয়েছে। তাহলে ৩৭:১০৭ এ কেন অন্য প্রানী বা ভেড়া জবাই করা উদ্দেশ্যে এই শব্দ ব্যবহার হবে যেখানে কোথাও এই ধরনের প্রানীর অস্তিত্ব নেই।
তৃতীয় শব্দঃ عَظِيمٍ শব্দের অর্থ Great
এখন এই কোরআনের প্রেক্ষিতে এই তিনটা শব্দের অনুবাদ করলে যা অর্থ দাড়ায় তা হল ঃ, যদিও এই আদেশ আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিলনা, তবু নবী ইব্রাহিম এটাকে আল্লাহর আদেশ ভেবে তার সবচেয়ে প্রিয় একমাত্র সন্তানকে জবাই করতে উদ্যত হতে দ্বিধা করেন নাই। সেই জন্য ৩৭ঃ১০৫, ১১০-১১ অনুযায়ী আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের প্রতি তার আল্লাহ ভক্তির কারনে খুশি হয়ে আল্লাহ সরাসরি হস্তক্ষেপে নবী ইব্রাহিম কে একটা বড় পাপ কাজ (৪:৯৩)থেকে রক্ষা করেন এবং তার পুত্রকেও জবাই হওয়া থেকে রক্ষা করেন । এইরকম ঘটনার আরও উদাহরণ হচ্ছে সূরা ইউসুফ যেখানে নবী ইউসুফ কেও আল্লাহ সরাসরি পাপ কাজ (ব্যভিচার) থেকে বিরত রেখেছিলেন (১২:২৪)।
সাধারণত আল্লাহ কাউকে পাপা বা পুন্য কাজে বাধা প্রদান করেন না। মানুষ পাপ বা পুন্য করে তার ইচ্ছা বা ব্যক্তি স্বাধীনতা অনুযায়ী (ফ্রি উইল)। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আল্লাহ সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। আর এই জন্যই আল্লাহ একে বলেছেন concession or ransom। আর এটাই হচ্ছে নবী ইব্রাহিমের আল্লাহ ভক্তির পুরস্কার।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কোরবানি নিয়ে প্রচলিত যে গল্প আমাদের মধ্যে চালু আছে তা আসলে বাইবেলের গল্প। আমরা কোরআনে যা বলেছে তা না দেখে অথবা বাইবেল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোরআনের অনুবাদ করে এর অর্থ পরিবর্তন করে বাইবেলের গল্পকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ভোর ৪:৩২