ইমাম মেহেদী নামক এক ব্যক্তি নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনেক ধরনের গল্প চালু আছে। এই ব্যক্তি নিয়ে গল্পের মূল বিষয় হচ্ছে উনি একদিন পৃথিবীতে আসবেন এবং মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিবেন, মুসলিম উম্মাহ সাফল্যের শিখরে উঠবে, এরপর কিয়ামত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কমবেশি সবাই এই গল্প জানেন। আমার প্রশ্ন হল আপনি এই গল্প কিভাবে জানেন? আরেকজনের কাছে শুনেছেন, কোন বইয়ে পড়েছেন অথবা কোন হুজুরের বয়ান শুনেছেন, অথবা সবগুলি। বিভিন্ন বইয়ে আপনি এর স্বপক্ষে হাদিসের থেকে রেফারেন্স পেয়েছেন, হুজুরেরা বলেছে, খুব বেশি হলে আপনি ঐ হাদিসের রেফারেন্স মিলিয়ে দেখেছেন। যার ফলে আপনার বিশ্বাস জন্মেছে যে এই ঘটনা সত্য, এবং এর ফলে আপনি এর উপর নির্ভর করে বসে আছেন যে উনি একদিন এসে মুসলমানদের কে সব ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি দিবেন। কিন্তু সময় চলে যায় আর উনিও আসেন না এর ফলে মুসলমানদের দুর্দশাও শেষ হয়না। কিন্তু আপনি স্বপ্ন দেখে যেতেই থাকেন। আপনি স্বপ্ন দেখতে থাকুন, এর মধ্যে আমি উনার সম্পর্কে যে তথ্য গুলি পাওয়া যায় তা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করে দেখি যে আসলে এই রকম কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে কি না বা উনার সম্পর্কে যে কথা গুলি বলা হয় তা কতটুকু সত্য। আমি এই সম্পর্কে যাদের সাথে কথা বলেছি , একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি যে কেউ এই সংক্রান্ত সবগুলি হাদিস জানেনা, এবং বিভিন্ন বিপরীতমুখী হাদিসের পার্থক্যটা ধরতে পারেন না। আমি এইখানে উনার সম্পর্কে সবগুলি গল্প/হাদিস (আমি যতগুলি জানি আর কি) একসাথে করে দেখব, মূল বিষয়টা কি দাড়ায়ঃ
ইমাম মেহেদী এবং কোরআনঃ
এর আগে আমি ঈসা (আঃ) যে আবার পৃথিবীতে আসবেন না তা আমি কোরআন থেকে প্রমান করে দেখিয়েছি। এটা খুব সহজ একটা বিষয় ছিল যেহেতু ঐ ক্ষেত্রে আমি কোরআনের রেফারেন্স দিতে পেরেছি- যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। (বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ Click This Link ) কিন্তু এই ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন এই কারনে যে, কোরআনে মেহেদী সংক্রান্ত কোন কথা বলা নাই। যেহেতু মেহেদী নামক কোন কনসেপ্ট কোরআনে নাই, সেহেতু এইখানে কোরআন থেকে এই সম্পর্কে বলার কিছু নাই, কিন্তু আমরা কোরআনের নিয়ম প্রয়োগ করলে দেখব যে কোরআনের নিয়ম অনুযায়ী এই মেহেদী কনসেপ্ট ইসলামে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কোরআন অনুযায়ীঃ
১। দ্বীন সম্পূর্ণ (৫:৩)
২। কোরআন সত্য মিথ্যা পার্থক্য নির্ণয় কারী (ফুরকান) (২:১৮৫, ২৫:১)
এই আয়াতগুলির সম্মিলিত অর্থ হচ্ছে ঃ
“কোরআনে যা কিছু বলা হয়নি তা আমাদের ধর্ম/দ্বীন এর ব্যপারে গুরুত্তপুর্ন নয় এবং যা কিছু কোরআনের সাথে সাঙ্গর্সিক তা অবশ্যয় বর্জনীয়”।
সুতরাং, যারা কোরআন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তাদের জন্য “মেহেদী বলে কিছু নাই অথবা মেহেদী কোনভাবেই ইসলামে গুরত্বপুর্ন নয়” কোরআন অনুযায়ী এটাই সঠিক বিশ্বাস।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে বেশিরভাগ মুসলমানই শুধুমাত্র কোরআনের কথা মানতে চান না। যদি বলেন, আল্লাহ কোরআনে এইটা বলেছে, তাহলে সাথে সাথে তারা আরও দশটা হাদিস নিয়ে আসবেন যেখানে ঠিক এইটার বিপরীত কথা বলে হয়েছে। এই সমস্যাটা ব্যপক। কোন ভাবেই বোঝানো যায়না কোরআন কোনভাবেই হাদিসের সাব-অর্ডিনেট না, বরং এর উলটাটাই সত্য। কোন কারনে হাদিস কোরআনের সাথে কনফ্লিক্ট করলে কোরআনের কথাই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এর উলটা টা প্রমান করার চেস্টায় ব্যস্ত। যারা কোরআন বিশ্বাস করেন তাদের জন্য এখানেই শেষ। যারা হাদিস থেকে মেহেদীর আগমন সংক্রান্ত বিষয় প্রমান করার চেষ্টায় ব্যস্ত এবং মনে করেন এই বিষয়টা খুবই গুরত্বপুর্ন তাদের জন্য আমার এই চেষ্টা।
ঐতিহাসিক পটভূমিঃ (ইতিহাস এবং ষড়যন্ত্র)ঃ
ধারনা করা হয় “আব্দুল্লাহ বিন-সাবাহ”- এই মুনাফিক (আগে ইহুদী ছিল, পরে মুসলমান হয়) প্রথমে এই ঈসা (আঃ) এবং মেহেদী আসার গল্প/গুজব ছড়ায়। এমনকি সে মুহাম্মদ (সাঃ) আবার পৃথিবীতে আসবেন এই গুজবও ছড়ায়। তার এই ছড়ানো এই গুজব সেই সময়ে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু প্রথম বীজটা সেই রোপণ করেছে এইটা অনেকের বিশ্বাস। যখন উমাইয়া খিলাফত এবং আব্বাসীয়দের মধ্যে দ্বন্ধ চরমে, তখন আমরা একজন বিশেষ সন্দেহভাজন মানুষের আবির্ভাব দেখি। উনি হচ্ছেন আবু মুসলেম খোরসানি। তিনি ইস্ফানে জন্ম গ্রহণ করেন এবং কুফায় বেড়ে উঠেন। মুহাম্মদ আব্বাসির ছেলে ইব্রাহিম তার মেধায় আকৃস্ট হয়ে তাকে তার পক্ষে প্রচারনা চালানোর দায়িত্ব দেয়। সে প্রচার করে যে খুব শিগ্রই ইমাম মেহেদী খুরসান প্রদেশ থেকে আসবেন এবং তার সেনাবাহিনীর পতাকা এবং পোশাকের রং হবে কাল। এই প্রচার যখন চরমে পৌছাল, সে খুরসান থেকে নিজে কাল পাতাকাবাহী এবং কাল রঙের পোশাক সম্বলিত সেনাবাহিনী নিয়ে বের হল এবং বানু উমাইয়া খিলাফত আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করল। (ইমাম মেহেদীর আর্মির সাথে যুদ্ধ করার মানসিক জোর তখন উমাইয়া খিলাফতের ছিলনা বলেই মনে হয়)। এইভাবেই উমাইয়া খিলাফতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের শুরু হয়। আব্বাসীয় খলিফা তার মেধায় মুগ্ধ হয়ে এবং তার ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে , যাতে ভবিষ্যতে নিজেরা এই ধরনের বিপদে পড়তে না পারে সেই জন্য তাকে হত্যা করেন। আর এইভাবেই ইমাম মেহেদী নাটকের মধ্য দিয়ে এক ক্ষমতার পালা বদল, এবং এই ধরানার উৎপত্তি।
ধর্মীয় পটভূমিঃ
ইমাম মেহেদীর বিশ্বাসের উত্থান ইরানে (তৎকালীন পার্সিয়ান স্ম্রাজ্য)। ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে এইটা মুলত শিয়াদের আবিষ্কার, পরে সুন্নীরা এই ধারণা গ্রহণ করে, যদিও ইমাম মেহেদী নামে কেউ একজন আসবে এই ধরনের কোন অথেনটিক হাদিস সুন্নী গ্রন্থে পাওয়া যায় না। আমরা এখন এই মুসলমানদের এই দুই দল শিয়া এবং সুন্নীদের মধ্যে কিভাবে ইমাম মেহেদী নামক ধারনার জন্ম হয়েছে তা দেখব।
শেহের বানুর ইতিহাসঃ
শিয়া কাহিনী অনুযায়ী, খলিফা হযরত উমরের সময় যখন পারস্য স্ম্রাট ইয়াজদগার্ড (Yazd Gard) মুসলমানদের হাতে পরাজিত হল, তখন তার মেয়েদেরকে উমরের সামনে যুদ্ধবন্দী হিসাবে উপস্থিত করা হল। উমর তাদেরকে ওপেন সেলের অর্ডার দিল, কিন্তু হযরত আলী তাদের বংশগত পরিচয়ের জন্য তাদেরকে আরও ভাল ভাবে ব্যবহারের পরামর্শ দিল।হযরত আলীর পরামর্শ অনুযায়ী তাদের মুল্য নির্ধারণ করা হল এবং তাদের একজনকে ইমাম হুসেন, আরেকজনকে মুহাম্মদ বিন আবু বকর এবং তৃতীয় জন কে আব্দুল্লাহ বিন উমরের কাছে হস্তান্তর করা হল। যে মেয়েটা ইমাম হুসেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল তার নাম শেহের বানু ( তার আসল নাম জাহান শাহ- শিয়া দলীল হিসাবে, উমর তার নাম দিয়েছিল শেহের বানু)। এই সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে তা হলঃ “Abu Abullah! You will have a son from her womb who will be the best in the world.” Hence Ali Ibne Hussain was born, who was the best Arab because he was Hashmi and the best Ajami because he was Iranian." (Kitab us Shaafi – Vol. I)
এই ইমাম হুসেইন এবং শেহেরবানু হচ্ছে তথাকথিত ইমাম মেহেদীর পূর্ব পুরুষ। কিন্তু শিয়াদের বানানো এই গল্প পড়ে এটা বানানো একটা গল্প কারনঃ
১। কোরআন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের কে হয় দয়া করে অথবা বিনিময়ের মাধ্যমে ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় কোন অপশন নাই (৪৭:৪)। হযরত উমর এবং হযরত আলী অবশ্যয় এটা জানতেন। যার ফলে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া বা কারো কাছে বিক্রি করে দেবার প্রশ্নই আসে না।
২। যখন হযরত সাদ মাদিয়ান দখল করেন, ততক্ষণে মাদিয়ান খালি হয়ে গেছে এবং সম্রাট ইয়াজদগার্ড তার পরিবার সহ পালিয়েছেন। এই জন্য ঐসময়ে তার মেয়েদেরকে বন্দী করার কোন প্রশ্ন আসেনা। তার মেয়েদেরকে একমাত্র তখনই বন্দী করার প্রশ্ন আসে যখন তাকে গুপ্তহত্যা করা হয়, কিন্তু সেই সময়টা হচ্ছে ৩০ হিজরি, যা হযরত উসমানের শাসনকাল, হযরত উমরের নয়।
৩। হযরত ইমাম হুসেইনের জন্ম ৫ হিজরি এবং মাদিয়ান দখল হয় ১৬ হিজরি, এর অর্থ হযরত ইমাম হুসেইনের ১১ বছরের সময়। এই ১১ বছরে উনি বিয়ে করেছেন এই কথাটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। (হলেও হতে পারে, তবে আমিই ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করিনা)
৪। সম্রাট ইয়াজদগার্ড সিংহাসন আরোহণ করেন ১৩ হিজরিতে (প্রায় একই সময়ে হযরত উমর দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে নিযুক্ত হন) যখন তার বয়স ছিল ১৮। মাদিয়ান দখল হয় ১৬ হিজরিতে, যখন তার বয়স ২১। এখন এই ২১ বছর বয়সে কিভাবে তার তিনটা বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকে তা কোনভাবেই বোধগম্য না।
উপরোক্ত কারনে আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারন আছে যে এই শেহের বানুর (যার অস্থিত্ব সন্দেহজনক) সাথে হযরত ইমাম হুসেইনের বিবাহের গল্প বানানো (এই গল্প বানানোর পিছনে একটা বিশাল ষড়যন্ত্র মুলক উদ্দেশ্য আছে, যা এখানে আমার লিখার বিষয় না )।
সুতরাং যদি এই গল্প বানানো হয় তবে ইমাম মেহেদীর অস্তিত্বও বানানো কারন এই দুইজনই (ইমাম হুসেইন এবং শেহেরবানু) হচ্ছে ইমাম মেহেদীর বংশ তালিকার প্রথমদিকেই (হযরত আলীর পরে) তাদের স্থান, যাকে বলে গোঁড়ায় গলদ।
ইমাম মেহেদী এবং শিয়া গ্রন্থঃ
এইখানে আমরা যে কথাগুলি বর্ণনা করব তার সবকিছুই আহসানুল মাকাল (যা শিয়াদের খুবই উচ্চ সম্মানিত গ্রন্থ ) থেকে নেওয়া। এই গ্রন্থের কথাগুলি পড়ার সময় দয়া করে নিজের মাথাটাকে একটু ব্যবহার করবেন। একটা বিষয় আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমি এখানে কাউকে, বা কোন দল কে ছোট করার উদ্দেশ্যে এই কথা গুলি বর্ণনা করছিনা। আমি শুধু এই বর্ণনার সাথে ইমাম মেহেদীর যোগসূত্র গুলি দেখাবার চেষ্টা করব। তার পরেও যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে আঘাত পান, তবে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এই নাটকীয় ঘটনা ঘটে ৮৭৩ সালে (নবম শতাব্দী), নবীর মৃত্যুর ২৪১ বছর পরে, এবং হযরত আলীর ২১২ বছর পরে।
১। আমি লেডি মালেকা- রোম সম্রাট কাইজারের পুত্রের কন্যা। আমার মায়ের নাম শামুন (Shamoun)- যে ঈসার বংশধর। কিছু সময় আগে নবী মুহাম্মদ আমার প্রপিতামহ ঈসার সাথে দেখা করেছিল এবং আমাকে (মালেকা) তার ছেলে হাসান আকসারির ( মৃত ৮৭৪ সাল) সাথে বিবাহ দিতে অনুরুধ করেন। (এই হাসান আকসারি হচ্ছে শিয়াদের “আসনা আসিরিয়া” বা ১২ ইমাম দলের ১১তম ইমাম )। ঈসা রাজী হন। নবী মুহাম্মদ বিবাহের অনুষ্ঠানের খুতবা পড়েন (নবীর মৃত্যুর ২৪১ বছর পরে)। নবীর কন্যা ফাতেমা (মৃত ৬৩২ সালে) একদিন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং আমাকে তার পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করলেন। এর পর এমন কোন রাত পার হয়নি যে রাতে আমরা আমাদের ভালবাসার মধু পান করিনি।
২। আমি লেডি মালেকা,আমাকে নার্গিস ও বলা হয়। আমি রোম সম্রাটের কন্যা। কিছুদিন আগে আলী (মুহাম্মদের জামাতা) আমার কাছে এসেছিল (হযরত আলীর মৃত্যুর ২১২ বছর পর) । সে আমাকে বলেছিল “নার্গিস তোমার জন্য পুত্র সন্তানের সুখবর যে পূর্ব এবং পশ্চিমের রাজা হবে। এইখবর আগুনের মত সবদিকে ছড়িয়ে পড়ল যে হাসান হাসান আকসারির স্ত্রী এই সময়ের নেতার (ইমাম মেহেদী) মা হতে যাচ্ছেন।
৩।একদিন হাসান আকসারি বলল যে আজকে মেহদীর জন্ম হবে। ঐ পরিবারের একজন স্ত্রীলোক বলল নার্গিসের গর্ভ ধারনের কোন নিদর্শন/ চিহ্ন নাই। তখন আলী এসে বলল “আমরা সাধুরা এবং নবীরা মায়েদের উরুতে (thigh) জন্ম গ্রহণ করি, সেইজন্য আমরা নিষ্কলুষ” ইমাম হাসান ও (মৃত ৬৭০ সাল) আসলেন । যারা ঐসময় উপস্থিত ছিলেন তারা নার্গিসের মধ্যে একটি জমকাল দীপ্তি দেখতে পেলেন। হাসান যুগের নেতার (Master of Times) জন্ম হওয়া দেখল, জন্মের পর থেকেই ইমাম মেহেদী কাবার দিকে সেজদাবনত অবস্থায় ছিল। নতুন জন্ম নেওয়া এই শিশু আকাশের দিকে তর্জনী উঠিয়ে রেখেছিল এবং কালেমা পাঠ করছিল। কুমারী মরিয়ম (হযরত ঈসার মাতা) হাজার হুর নিয়ে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত সবাই দেখল ইমাম মেহেদীর ইতিমধ্যে খৎনা করা আছে। সবাই সকল ইমামদের জন্য আল্লাহর কাছে আশীর্বাদ চাইল। চারদিকে আলোকজ্জল হয়ে উঠল। সাদা পাখিরা চারদিকে ভিড় করল। হযরত আলী একটি পাখিকে এই শিশুটিকে(ইমাম মেহেদী) নিয়ে যেতে বলল এবং ৪০ দিন পরে আবার নিয়ে আসতে বলল।
দয়া করে মনে রাখুন এই নাটকীয় ঘটনার সময়কাল ৮৭৩ সালে (নবম শতাব্দী), নবীর মৃত্যুর ২৪১ বছর পরে, এবং হযরত আলীর ২১২ মৃত্যুর বছর পরে।
পৌরাণিক কাহিনী এমনই মজার। কাহিনী এখানেই শেষ না, আরও আছে।
৪। চল্লিশ দিন পরে পাখিটি যখন শিশুটিকে ফিরিয়ে আনল তখন শিশুটির বয়স দুই বছর। তারপর পাখিটি শিশুটিকে আবার নিয়ে গেল এবং আবার ৪০ দিন পরে ফিরিয়ে নিয়ে আসল। এইসময়ে শিশুটি (ইমাম মেহেদী) পূর্ণ বয়স্ক হয়ে গেল। (আমরা জানিনা চল্লিশ দিনে কিভাবে একটি শিশুর বয়স দুই বছর হয়, আর ৮০ দিনের মাথায় কিভাবে একটি শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক/ পূর্ণ বয়স্ক হয়। পাখিটা তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল আমরা সেটাও জানি না)।
৫। ইমাম মেহেদী পাচ বছর বয়সে, তার বাবা হাসান আকসারির মৃত্যুর দশদিন আগে সামারা বা সামারন রাই নামক একটি গুহায় অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই সময় সে সাথে করে নিয়ে যায় সম্পূর্ণ কোরআন যা ৪০ পারা (৩০ পারা নয়) যার আয়াত সংখ্যা ১৭০০০ (৬২০০+ না)। সে আরও সাথে করে নিয়ে গেছে সমস্ত নবীদের (আদম থেকে শুরু করে মুহাম্মদ পর্যন্ত) গ্রন্থ, আলী এবং ফাতেমার বই, জাফরের বিজ্ঞান, সমস্ত নবীদের মুযেযা, মুসার লাঠি, আদমের শার্ট, সুলাইমানের আংটি ইত্যাদি।
৬। সে কেয়ামতের আগে ঐ গুহা থেক বের হবে। বের হওয়ার পর সে আবুবকর, উমর, এবং উসমান কে কবর থেকে জীবিত করে বের করবে এবং তাদের কে হাজার বার শাস্তি দিয়ে মারবে এবং আবার জীবিত করবে। সে নবীর স্ত্রী আয়েশাকে ( নবীর স্ত্রীদেরকে কোরআনে “বিশ্বাসীদের মা” বলা হয়েছে) জিবীত করবে এবং ব্যভিচারের জন্য শাস্তি প্রদান করবে (হাব্লুল্লাহ, নং ৬)
৭। প্রথমে তার হাতে বায়াত গ্রহণ করবে নবী মুহাম্মদ। (বাশির দারাজাত)
৮। মেহেদী মানুষকে কবর থেকে জীবিত করবে এবং ইচ্ছা অনুযায়ী স্বর্গে বা নরকে প্রেরন করবে। (মিরাতুল আনোয়ার)
৯। ইমাম মেহেদী তার সাথে আসল কোরআন নিয়ে আসবে ইয়াজুজ মাজুজ দের সাথে লড়াই করবে
১০। সে সাথে করে নতুন বই এবং নতুন বিশ্বাস নিয়ে আসবে
এই হচ্ছে শিয়াদের ইমাম মেহেদীর কাহিনী। কোন সাধারণ মানুষ যার নুন্যতম বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা আছে,সে এই শতাব্দীতে এই সব গল্প বিশ্বাস করবে না। আমি এখানে ইমাম মেহেদী নামক তথাকথিত ব্যক্তির গল্পের উৎপত্তির ইতিহাস, শিয়াদের গ্রন্থে এই সম্পর্কে কি লেখা আছে তা বলেছি। ঐতিহাসিক গল্পের সমস্যা কোথায় তাও বলেছি। আর শিয়াদের বই থেকে যা বলেছি তার অসংগতি কি তা পাঠকই নিজে বিবেচনা করুক। এইখানে একটা কথা চাই, এই ১১তম শিয়া ইমাম হাসান আকসারি সম্পর্কে কাজী মুহাম্মদ আলী তার “শামা-ই- হাকিকত” নামক বইয়ে বলেছেনঃ
“এই বিষয়ে খুব শক্ত এবং প্রমানযোগ্য ঐতিহাসিক দলীল আছে যে ,হাসান আকসারি ( ইমাম মেহেদীর বাবা) তার ছোটবেলাতেই মৃত্যু বরন করেন। তিনি কোন সন্তান রেখে যাননি। তার মৃত্যুর পরে তার ভাই জাফর-বিন-নাকী আইন অনুসারে তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন”।
উপরের যেসব প্রমান দেওয়া হয়েছে তার পরও যারা বিশ্বাস করেন ইমাম মেহেদী নামক একজন আসবেন, তাদের প্রতি আমার কিছুই বলার নাই।
ইমাম মেহেদী এবং সূন্নী গ্রন্থঃ
এই ইমাম মেহেদী ধরনা প্রথমে তৈরী হয় শিয়াদের মাধ্যমে। এই ধারণা তৈরী করার পিছনে ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। আমার বিষয় সেইটা না। সুতরাং আমি সেদিকে যাবনা। সুন্নীরা শিয়াদের এই ধরনা পরে গ্রহণ করে এবং নিজেদের মত করে হাদিস তৈরী করে। সুন্নীদের এই সংক্রান্ত হাদিস গুলি দেখতে Click This Link –এই লিঙ্কে দেখতে পারেন।( লিঙ্ক দিলাম এই কারনে যে সবগুলি হাদিস এইখানে লেখা সম্ভব না।) সুন্নীদের এই হাদিস গুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ঃ
১। বিভিন্ন জায়গায় ইমাম মেহেদী অথবা ঐ ধরনের কোন ব্যক্তি অথবা কোন ন্যায়পরায়ণ খলিফার ভবিষ্যৎবাণী করা আছে। স্বভাবিক ভাবে যদি আমরা কোরআনের আলোকে এইসব হাদিস বিশ্লেষণ করি তবে আমরা কোরআনের আলোকে ঐ সকল হাদিসের কিন ভিত্তি নেই। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন যে অদৃশ্য, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্রই আছে। নবীর ভবিষ্যৎ বলার কোন ক্ষমতা নাই।
কোরআনের ৩:৪৪,৩:১৭৯, ৫:১০৯, ৬:৫০, ৭:১৮৮, ১০:২০, ১১:৩১, ১১:৪৯,১২:১০২, ১৮:১১০, ৩০:২, ৭২:২৬-২৮ আয়াতগুলিতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ্রই আছে এবং নবীর নিজের থেকে ভবিষ্যৎ বলার কোন ক্ষমতা নাই। কোরআনের এই সঙ্ক্রান্ত সবগুলি আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে দিলাম যাতে পাঠক নিজেই দেখে নিতে পারে। (সবগুলি আয়াত এখানে বর্ণনা করা সম্ভব না) যেমন উদাহরণ সরূপ কোরআনে বলা আছেঃ
"আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না" ? (৬:৫০)
সুতরাং কোরআন অনুযায়ী এই ধরেনর হাদিসের কোন সত্যতা নেই। এইধরনের হাদিসকে বিশ্বাস করলে কোরআনের আয়াতকে আস্বীকার করা হয়। যারা কোরআনের আয়াত বিশ্বাস করেন তাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আর যারা কোরআনের বিপরীতে শুধু হাদিস বিশ্বাস করেন তাদের জন্যঃ
“আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ যারা বলেছেন মুহাম্মদ তার প্রভুকে দেখেছে তারা মিথ্যাবাদী কারন আল্লাহ বলেছেন “দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পেতে পারে না, অবশ্য তিনি দৃষ্টিসমূহকে পেতে পারেন…।“ (৬:১০৩) এবং যদি কেউ বলে মুহাম্মদ অদৃশ্য/ভবিস্যত দেখেছে তাহলেও সে মিথ্যাবাদী কারন আল্লাহ বলেছেন আল্লাহ ছাড়া অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে নেই” (বুখারি, ভলিউম ৯, বই ৯৩, হাদিস ৪৭৭)
২।সুন্নীদের মধ্যে এই সংক্রান্ত যত হাদিস আছে তার বেশিরভাগই “জীরাহ” (criticism) রয়েছে। মুতাওয়াত্তির হাদিসে (যে হাদিস একসাথে অনেকেই বর্ণনা করেছেন) মেহেদী নামক কারো নাম পাওয়া যায়না। শুধু বলা আছে একজন ন্যায়পরায়ণ খলিফার আগমন ঘটবে, কিন্তু ঐ ন্যায়পরায়ণ খলিফা মেহেদী কি না সেই বিষয়ে কিছু বলা নেই।
৩। এইসব হাদিস যেমন কোরআনের বিপরীত তেমনি পরস্পর বিরোধী। যেহেতু সব গুলি হাদিস নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়, আমরা “সুনানে আবু দাউদের কিতাবুল মেহেদী অধ্যায়ের কিছু হাদিস দেখব এবং এই ক্ষেত্রে কোরআনের একটি আয়াত (৪:৮২) কে আমরা মাপকাঠি (“ফোরকান”- সত্য মিথ্যা নির্ণয়কারী) হিসাবে ব্যবহার করব। আল্লাহ বলেছেনঃ
"এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত"।(৪:৮২)
১। নবী বলেছেন আমার বংশ থেকে একজনের আবির্ভাব হবে যার নাম হবে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ
২। তার নাম হবে মেহেদী ( মুহাম্মদ না)
৩। তার নাম হবে হারিস (মুহাম্মদ ও না মেহেদী ও না)
মুসলিমে বলা হয়েছে একজন “ মুসলিম কমান্ডার” বুখারীতে বলা হয়েছে একজন ইমাম। দুটা অর্থ এক ধরে নিলেও সে কি মুহাম্মদ, মেহেদী নাকি হারিস এটা বলা মুশকিল। সুতরাং আমরা ৪:৮২ অনুযায়ী এই ব্যপারে অনেক বৈপরিত্য দেখতে পাই। সুতরাং এইসব হাদিস একসাথে পড়লে বুঝা যাবে কোরআন অনুযায়ী এইগুলির কোন সত্যতা নেই,এবং আমাদের নবী কখনওই এই ধরেনর কথা বলেননি। এইসব কথা গুলি আমাদের নবীর নামে বানানো হয়েছে এবং নবীর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিয়া প্রভাব এখানে লক্ষ্যনীয়। এটা শিয়াদের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না।
Reference:
1. Al Quran
2. The Eclipse of Islam-by G.A Parvez
3. Karbala- Fact or Fiction-by Shabbir Ahmed, MD
4. Tahfimul Quran-by Moududi
5. Different hadith books (Abu Daud, Muslim, Bukhari)
6. Ahsanul Makal
7. Different website on Shia and Sunni sects
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ২:১২