বসন্তের শেষ বিকালের মৃদু হাওয়ায় অনেক কষ্টে পুরাতন ডায়েরি টা খুঁজে পেলাম । ধুলোবালি জমে একাকার হয়ে আছে । শেষ কবে স্মৃতি কথা লিখে রেখেছি মনে করতে পারছি না । কাপা কাপা হাতে আজ আবার লিখতে শুরু করলাম,
আমি অদিতি সেন । দুরন্ত কৈশোর পাড়ি দিয়ে কখোন যে এতোটা বছর পাড়ি দিলাম ,ভাবতেই পারছি না, চোখের সামনে শৈশব স্মৃতি আজও দৃশ্যমান । বাবার সরকারি চাকরির দরুন আজ এখানে তো কাল ঐখানে ,এমন ভাবে আমি বারবার স্কুল পাল্টাচ্ছিলাম ,প্রতিবার কাঁদতে কাঁদতে নতুন শহরে পাড়ি জমাতাম ।
একদিন পা রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে । এখন আর শহর ছাড়ার ভয় নেই । হোস্টেলে থাকা শুরু করলাম ,হাসি আনন্দে কাটছিল বেশ । গল্পের আড্ডায়, গানে গানে আর পড়াশোনায় কেটে যাচ্ছিল ক্লান্ত প্রহর ।
বর্ষা কাল সবে শুরু হয়েছে, সারাদিন একটানা বৃষ্টি, কাদায় একাকার সব কিছু ।
সেদিন ছিল আষাঢ়ের শুরুর দিক, বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি , একি তো বৃষ্টি তার উপর বাড়ি যাবার তাড়া ,নীলক্ষেতে গিয়েছিলাম কিছু বই কিনতে ,সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি বুঝতে দেরি হলোনা । ভিজে একাকার অবস্থা, জ্বর বাধবে নিশ্চিত । ঠিক সেই সময় হিমেল আসলো , বেচারার অবস্থা আরো করুন , একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা, সে শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত, কোথায় থেকে জানি একটা সি এন জি জোগাড় করলো , তাতেই যাবার জন্য সে ডাকতে এলো । এভাবেই প্রথম পরিচয় টা আমাদের হলো । তারপর তিনটি বসন্ত কেটে গেল । এক কথায় বলতে গেলে আমার দেখা সে অসাধারণ কোন মানব ,যার মুখে হাসি , বিরক্তি যেন তাকে কিছুতেই ছুতো না , আমার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ,তার চোখের তীব্র মায়ায় আমি যেন সুখের সাগরে ভাসছিলাম ।
হঠাৎ বাড়ি থেকে খবর এলো বাবা ভীষন অসুস্থ ,এখুনি বাড়ি যেতে হবে । বাড়ি যেয়ে জানতে পারলাম বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, লাস্ট স্টেজে আছেন ,ঢাকায় আনা হলো ,কেমো চলছিল । বাবা উঠে পড়ে লাগলেন আমার বিবাহের জন্য ,আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না ,ওনারা কোন এক ছেলের ছবি হাতে ধরিয়ে দিলেন , একেই বিয়ে করতে হবে বললেন । আম্মু কে বারান্দায় নিয়ে হিমেল এর কথা বললাম ,আম্মু মানতে নারাজ । হিমেল এ আর কেমন চাকরি করে, যাকে দেখা হয়েছে ,এমন ছেলে পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার ।
হিমেল কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলাম । বাবার অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছিল, দেশের বাহিরে নেবার চেষ্টা করেও থেমে যেতে হলো ।এক সন্ধ্যায় আব্বু মাথায় হাত দিয়ে বললেন , অদিতি মা আমার , তোর কাছে এটাই আমার শেষ চাওয়া ,তোকে আমি সুখী দেখতে চাই ।
বাবা মায়ের ইচ্ছেতেই অনেক টা তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা হয়ে গেল । তার দুই দিন পর বাবা মারা গেলেন । সেদিনই আমার বর এর সাথে প্রথম দেখা হলো । বিয়ের দিন একবারও তার দিকে তাকাইনি । সাদামাটা চেহারায় মায়া খুঁজে পেলাম না, রাগি রাগি দৃষ্টি , বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো । সে এলো মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে , হাত না যেন মনে হচ্ছিল কোন এক পাথর আমায় ছুঁয়ে গেল । একে তো বাবা হারানোর কষ্ট তার উপর হিমেল কে হারিয়ে ফেলা ।
মাস তিনেক পর তাদের বাড়িতে আমাকে তুলে দেয়া হলো । সেদিন প্রথম বউ সাজে সজ্জিত হলাম ,সবাই যখোন মুগ্ধ নয়নে আমায় দেখছিল ,আমার বর তখন লোকজনের সাথে গল্পে মশগুল ,আমাকে দেখার সময় কই, বুঝে নিলাম এই লোকের সব কিছুতেই আগ্রহ কম ।
বিয়ের যখন এক বছর হতে চলল , সবাই বলছিল বউকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আয় অনেক দিন তো হলো । একদিন ডেকে বলল চলো তোমায় নিয়ে গ্রাম ঘুরে আসি । মনে মনে তাকে হাজার টা গালি দিলাম ।
তার জন্মদিনে সারাদিন খেটে যখোন আয়োজন করলাম ,আমার বর মশাই বাড়ি ফিরে অবাক তো হলেন এ না , উল্টো বিরক্ত হলেন । দায়সারা কেক কেটে ঘুম দিলেন ।
অবশেষে বর আমায় নিয়ে শহরের কাছে কোথাও বের হলেন , রোদে আমার গা ঝলসে যাবার অবস্থা সেদিকে তার দৃষ্টিপাত নেই বরং সে আরোও সরে গিয়ে রৌদ্র কে আহ্বান জানাচ্ছিল ।
শেষবার এপেন্ডিসাইটিস এর ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলাম ,বর আমার বলল প্যারাসিটামল খাও ঠিক হয়ে যাবে , সারা রাত ঘুমাতে পারিনি । সকালে সে অফিস চলে গেল, পাশের ফ্লাটের ভাবীকে ডেকে আনলাম । ওনি হাসপাতালে ভর্তি করলেন । সেই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম ।
আমার বরের এতো অবহেলা আমার ভালো লাগছিল না , আমার খুব হিমেল কে মনে পড়ে । খুব তাকে দেখতে ইচ্ছে করে , খবর নিয়ে জানতে পারি সে চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে ।
মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে ইচ্ছে হতো , বরমশাইর তাতে বারন । তার ভালোবাসা পাবার অনেক চেষ্টা করেও কাজ হলো না । ওনি আলাদা মানুষ ধরেই নিলাম ।
বিয়ের আজ ছয় বছর প্রায় । ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে ফেললাম । সাজসজ্জা ছেড়ে দিলাম । লোকজন ভালো লাগে না । একা একা থাকি সারাদিন । রাতের পর রাত জেগে থাকি আমার বর তখোন গভীর ঘুমে থাকে । চোখের নীচে কালির রেখা ফুটে উঠলো । আমার মাথায় সমস্যা আছে ভেবে একদিন ,আমার চার বছরের ছেলেটাকে শাশুড়ি নিয়ে গেলেন । আমি আরও একা হয়ে গেলাম। রোজ জমানো ঔষধের শিশিটার মুখ খোলার দিন আজ । অনেক কষ্টে পঞ্চাশ টা ঘুমের ঔষধ জমা করেছি । সব পানি দিয়ে গিলে ফেললাম । হাত এখন আরও কাপছে , লিখতে পারছিনা ।
চোখ মেলে অদিতি তার বর এর মুখ টা দেখতে পেলো , ঝাপসা লাগছে খুব । এই প্রথম তার চোখে অদিতি মায়া দেখতে পেলো, ওর হাত ধরে সে কাঁদছে । ওর খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে । ধীরে ধীরে দৃষ্টি আরও ঝাপসা হচ্ছে ।
তার কিছু মুহূর্ত পর অদিতি মৃত্যুবরন করলো ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ১:৫৩