মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ ভারী কিছু দিয়ে মাথায় ক্রমশ আঘাত করছে । আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না । এইতো কিছু দিন আগেও ভালো ছিলাম ,হঠাৎ করে আমি রাহাত কে দেখতে শুরু করলাম । মৃত্যু মানুষ কখনও ফিরে আসে এমনটাও কি হয় , ভাবনার বাহিরে ছিল ।
রাহাতের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় শ্রাবনের শুরুর দিকে । আমার আর তার বাড়ি পাশাপাশি পাড়ায় ছিল । বিকাল হলে কোচিং যাবার পথে, রোজ তাকে পাড়ার মুদির দোকান টায় দেখা যেতো । সেদিন ছিল তার চোখে সানগ্লাস, হাতে সিগারেট, এলোমেলো চুল । হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল । হঠাৎ সানগ্লাস সরিয়ে তার চোখের বাঁকা দৃষ্টি ,আজও ভুলতে পারিনি , কি ভয়ানক সেই দৃষ্টি । পাড়ার সবাই তার ভয়ে অস্থির, তার অশৃঙ্খল চলাফেরা, ভার্সিটিতে অনিয়মিত হওয়া , সব মিলে সে সবার অপছন্দের তালিকায় নাম রাখে । দুই পাড়ার মাঝে মারামারি, কোন অনুষ্ঠান ভেস্তে দেয়া সব কিছুতেই তার ছিল বড্ড বাড়াবাড়ি ।
শ্রাবনের ঘন বর্ষন ধারার মতো তার মাঝে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে । তাকে দেখলেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতো । একদিন বুঝতে পেরে সানগ্লাস আর কিছুতেই চোখ থেকে নামাতো না । তার সিগারেটের তীব্র গন্ধে আমার নাকে কাপড় ধরে রাখা, আস্তে আস্তে সিগারেট ফেলে দেয়া , সব কিছু যেন হঠাৎ এ হচ্ছিল । তার ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা, সানগ্লাসের আড়ালে অপেক্ষমান চাহনি, সব যেন আমারি জন্য । পাড়ায় তার মারামারি কমে গেল । কিন্তু তার বিপরীত পক্ষের লোকেরা তাকে ছাড়লো না, সুযোগ পেয়ে একদিন মাথা ফাটিয়ে দিলো । সে কি রক্তাক্ত কান্ড । হাসপাতালে ভর্তি হলো, কিছুতেই আর ভালো হলো না । তাকে শহরে নিয়ে গেল । পাড়া ছেড়ে তারা বহু দূরে চলে গেল । হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম রাহাত মারা গেছে । সেদিন কেন জানি আমার চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বইছিল । কিশোরী মনে অল্পতেই বাড়াবাড়ি ভেবে তাকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম । বেশ কিছু দিন আমি আর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলাম না । তার কথা ভাবলেই বুকের ভিতরটা হাহাকার করতো ।
এভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গেল । আমি ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পা রাখলাম । মফস্বল ছেড়ে শহরে পাড়ি জমালাম । বন্ধু বান্ধবীর আড্ডায় গল্পের ফাঁকে, ধোঁয়া ওড়ানো চায়ে জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেলাম । রাত হলে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতাম । সময় ভালো কাটছিল ।
কয়েক মাসের মাথায় আমি রাহাত কে দেখতে পেলাম , অবিকল সেই হাসি, সেই ভয়ংকর চাহনি । একদিন সন্ধ্যায় ছাদের কোনে হেলান দিয়ে চা খাচ্ছিলাম , ঝড়ের গতিতে আমার সামনে দিয়ে কাকে যেন যেতে দেখলাম , শার্ট এর ডিজাইন আর রং খুব পরিচিত লাগলো । দূর থেকে ভয়ানক সেই হাসি কানে বাজলো । আমি কান চেপে ধরলাম, শব্দ যেন আরো বেড়েই চলছে । এইতো সেদিন বাজারে গেলাম সবজি বিক্রেতা আমার দিকে ঠিক সেই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে হলো রাহাত যেন বসে আছে । এভাবে অনেক জায়গায় অনেক বার তার অস্তিত্ব আমি অনুভব করতে লাগলাম । দিন দশেক এর মাঝেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, কিছুই খেতে পারছিলাম না, সবসময় মনে হতো রাহাত আমার আশেপাশে আছে । টানা কয়েকদিন না ঘুমিয়ে ছিলাম । চোখের পাতা বন্ধ করলেই তাকে দেখতে পেতাম । রাতের পর রাত আমি জেগে বসে থাকি । আমার অবস্থা করুন হতে লাগলো ।
চোখ মেলে দেখতে পেলাম আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি । আমার পাশে রাহাত বসে আছে । তাকে দেখে আবার অজ্ঞান হলাম । ঘন্টা খানিক পর চোখ মেলে তাকে আর দেখতে পেলাম না ।
বাড়ির লোকের কাছে জানতে পারলাম সে সত্যি বেঁচে আছে । সেই যাত্রায় সে বেঁচে যায় ,আবার আক্রমনের ভয়ে পাড়ায় ওই গুজব রটানো হয় । আমার খবর সে রোজ রাখতো । যখন জানতে পেলো শহরে এসেছি, তখনি প্রথম দেখা করতে এসেছিল, তার ভদ্র চেহারা, কোমল চাহনি, গোছানো সাজসজ্জা, কিছুতেই আমাকে বুঝাতে পারেনি সে যে রাহাত ছিল । তার পরিনামে তার আগের রূপ ফুটিয়ে একদিন আমার সামনে এলো ,তারপর থেকেই আমার হ্যালুসিনেশন শুরু হলো । সব জায়গায় আমি তাকে দেখতে পেতাম ।
হারানো মানুষ ফিরে আসবে সে যেন ভাবনার বাহিরে ছিল । ধুলোকনায় জমে থাকা ভালো লাগা আবার যেন উঁকি দিল । কতোদিন মেঘলা ডাক শুনা হয়নি । এতো মমতায় কেউ হয়তো এই নামে আমায় আজও ডাকেনি । শ্রাবনের ঘন বর্ষন ধারা যেন আমার সুখ হয়ে নামলো ।