somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কলকাতার হিট মুভি মনের মানুষ নিয়া দুই বাঙ্গালী দাদার রিভিউ

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গৌতম ঘোষের মনের মানুষ : শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে
তপন রায় চৌধুরী


আজকাল সব সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টাই বিশেষ-বিশেষ বিদ্যার আয়ত্তে। আপনার ফুটবল খেলা দেখতে ভালোলাগে, ভালো কথা। ভালোলাগাটা যতক্ষণ নিজের কাছে রাখছেন, কারো কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এ বিষয়ে দুর্ভাগ্যক্রমে আপনার সাধারণ্যে মত প্রকাশের ইচ্ছে জাগায়, তবেই বিলক্ষণ বিপদ। চারদিক থেকে দশজন চেপে ধরবে-- ‘ ফুটবল সম্পর্কে তুমি কী জানো হে যে, ও বিষয়ে কপচাবার স্পর্ধা দেখাচ্ছ? এ কি ছেলের হাতের মোয়া, যা মনে আসে দু ’ কথা বাজারে ছেড়ে দিলেই হলো! তাহলে এত বিশেষজ্ঞ আছে কি করতে? ’ সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদি থান থান সাংস্কৃতিক বিষয়ের কথা ছেড়ে দিলাম। বিশ শতকের নতুন ধ্রুপদী শিল্প-সিনেমা বিষয়েও কিছু বলতে গেলে সামলে-সুমলে চারদিক তাকিয়ে মুখ খুলতে হয়।

আমি সিনেমার কীট। অনেক ছবি দেখি, তার তঙ্কÄ ¡ বা টেকনিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়েও। দেখি, কারণ ভালোলাগে। তাছাড়া বেশিরভাগ ছবিই আমার বেশ লাগে। এক থেকে দশের মধ্যে নম্বর দিতে বললে, পাঁচ-ছয় থেকে সাত-আটের মধ্যে নম্বর দেই। তাই গৌতম ঘোষ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ মনের মানুষ ’ বিষয়ে কিছু লেখার অনুরোধে কিছু না ভেবে-চিন্তেই রাজি হয়েছি। এ অবিমৃশ্যকারিতার জন্য পাঠকদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

গৌতমের সব ছবিই আমার ভালোলাগে, কোনোটা কিছু বেশি, কোনোটা কিছু কম। পূজা সংখ্যা ‘ দেশ ’ -এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখিত ‘ মনের মানুষ ’ পড়েও খুবই ভালো লেগেছিল। সুনীলের ঐতিহাসিক উপন্যাস সব সময়েই গভীর গবেষণাভিত্তিক। আর তার ওপর অত্যন্ত সুখপাঠ্য। কিঞ্চিৎ ঈর্ষার সঙ্গেই কথাটা বলছি। তাই সুনীলের লিখিত ঐতিহাসিক উপন্যাসের ভিত্তিতে গৌতম-পরিচালিত ছায়াছবি তৃপ্তিদায়ক হবে-- এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সে তৃপ্তির গভীরতা কতটা হবে, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ছবিটা শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। মনে হচ্ছিল, অনেকক্ষণ ধরে অপরূপ এক স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ যেন কেউ নিতান্ত রূঢ়ভাবে সেই স্বপ্নটা ভেঙে দিয়েছে। সব যুক্তি ভেঙে আমার চেতনাবোধ সেই স্বপ্নে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে। ক্যামেরায় তুলে নেয়া সেই অরণ্যভূমি, ঐ নদী, উদার আকাশের নিচে কত সরল-প্রকৃতি মানুষের ঈশ্বর তথা পরস্পরের ভালবাসায় নিবেদিতপ্রাণ জীবন, গানে-নাচে গভীর ঈশ্বরমুখিনতায় যার সমৃদ্ধির অন্ত পাওয়া ভার। সব মিলিয়ে প্রায় অতীন্দ্রিয় এক অভিজ্ঞতায় আড়াই ঘণ্টা সময় ডুবে ছিলাম। এ এক পরম সৌভাগ্য।

আমাদের এই ভক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে কিংবা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে। নাট্যমঞ্চে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অজিত পাঁজার অভিনয় আজো হয়তো অনেকের মনে আছে। কিন্তু গৌতম ঘোষের এই সৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয় কিছু দেখিনি। এই ছায়াছবিতে গৌতমের বক্তব্য এক নয় একাধিক। সাম্প্রদায়িকতা, ছুঁৎমার্গী, সঙ্কীর্ণমনা ধর্ম-আচরণের কেন্দ্রে যে মানুষের অযোগ্য বিশ্বাস ও চেতনা তার গভীর নিন্দা, মানুষে মানুষে ভালবাসায়, ঈশ্বরপ্রেমে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মহ্ৎ উত্তরণের পথ এ ছবির অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু। কাঙাল হরিনাথ আর মীর মর্শারফের আবির্ভাব (লালনের সঙ্গে তাদের এই সাক্ষাৎকার ঐতিহাসিক সত্যভিত্তিক কিনা জানি না) অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিচতলার মানুষের অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত দেয়।

সংস্কারমুক্ত দৈহিক প্রেমের কথাও ছবিতে আছে। অভিনয় অতি উচ্চাঙ্গের, বিশেষ করে বাংলাদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। কিন্তু সব ছাড়িয়ে একটি সুরই ছবি শেষ হওয়ার পর দর্শকদের মনে অনুরণিত হয়, মানবজীবনে ঈশ্বরপ্রেমের গভীর ও অন্তহীন সম্ভাবনা। বিশ্বপ্রকৃতির বিরাটত্ব আমরা কল্পনা করতে পারি না। মানুষের অভিজ্ঞতায় জীবিত প্রাণীর সুখ-দুঃখের প্রতি সে প্রকৃতি সম্পূর্ণ উদাসীন। আমাদের মতো অবিশ্বাসীদের ধারণা যে, সেই অসহ্য সত্য, মৃত্যুর মহাভয় থেকে নিষ্কৃতি পেতে জায়গা নিয়েছে করুণাময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকল্পনা। দীন-দুনিয়ার মালিক, আল-রহিম, আল-রহমান। এর ওপরে মানুষের কল্পনা যেতে পারেনি।

এই কল্পনার মহিমা অবিশ্বাসীর জীবনও সঙ্গীতময় করে তোলে। লালনরূপী অভিনেতা প্রসেনজিতের চোখের ঐ শান্ত উদার ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন দৃষ্টি মানবজীবনে সংসারোত্তর অন্য সম্ভাবনা প্রাণবন্ত করে তোলে। ছবিটি শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে। স্থান নেয় নানক, কবীর, দাদূর দোহার পাশে। গৌতম দীর্ঘজীবী হোন, ওঁর সৃষ্টি আমাদের জীবন আরো সমৃদ্ধ করুক। 

সুত্র: দেশ

[মুভিতে মনে হচ্ছিল যৌবন বয়সে লালনের কাজ ছিল কমলীর বিশেষ চাহিদা পূরণে ভাগ-ভাটোয়ারা করা। আর তপন দাদা বলছেন সংস্কারমুক্ত দৈহিক প্রেমের কথাও ছবিতে আছে]
..........................................................................

মাইল ফলক হতে হতেও হল না

তবু যা পাওয়া গেল তা চুমুক দিয়ে খাওয়ার পর আলোড়িত থাকার মতো। লিখছেন সমরেশ মজুমদার

মনের মানুষ
প্রসেনজিৎ, পাওলি, শুভ্রা, প্রিয়াংশু, চম্পা, চঞ্চল

মাস দুয়েক আগে আমি যখন ঢাকায়, তখন এক বিকেলে অধ্যাপক আনিসুজ্জমানের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টার ছবি দেখে যখন বেরিয়ে এসেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, “আমি স্নাত।” আমি কিছু বলিনি, কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

দু’মাস পরে, শেষ নভেম্বরের সকালে দ্বিতীয় বার ছবিটি দেখলাম। শুধু ছবি বললে কম বলা হবে। আমি এক মহাজীবন প্রত্যক্ষ করলাম। বাংলা ভাষায় যাবতীয় বিশেষণগুলো মিইয়ে যাচ্ছে। তাই এইটুকুই বলা ভাল, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-তপন সিংহের পরে এখন আমি স্বচ্ছন্দে গৌতম ঘোষের নাম উচ্চারণ করতে পারি।

ঊনবিংশ শতকের বাংলাকে রেনেসাঁসের বাংলা বলা হয়। আমাদের গর্বিত, শিক্ষিত এবং মানুষ করতে পুরো ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের নামের সঙ্গে লালন ফকিরের নাম সচরাচর উচ্চারিত হয় না। বোধহয় তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষা আমাদের মনকে আড়ষ্ট করে রাখছিল। কিন্তু এই একটি মানুষ বাংলার গ্রামে গ্রামে যে আলোড়ন তৈরি করেন, তার খবর পেতে আমাদের দেরি হয়ে গিয়েছিল।

‘মনের মানুষ’-এর প্রথম দৃশ্যটাতে নদীর ও পারে দিগন্তরেখায় সূর্যাস্ত দেখা যায়। ভেসে যাচ্ছে একটি কলাগাছের ভেলা। সুতির মশারির নীচে একটি মৃতদেহ শোয়ানো। অস্পষ্ট মৃতদেহ নিয়ে যখন ভেলা পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যায়, তখন ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। ক্যামেরা জলের লেভেলে। এই মৃতদেহ কার প্রতীক?

পরের দৃশ্য, হাউসবোটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কেচ আঁকছেন যাঁর, তাঁর বয়স হয়েছে ঢের। বাবরি চুলে রুপো উপচে পড়ছে, বাঁ হাতে আলগোছে লাঠি ধরা। পোঁটলা থেকে একতারার অংশ উঁকি মারছে। বার্ধক্য তাঁর সর্বাঙ্গে, তবু চোখে কৌতুক। বসে আছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, “আপনার মতো সাধকের গান নিয়ে আমাদের পরিবারে চর্চা শুরু হয়েছে। এ বারে আপনার ছবি দেখলে সকলে খুব উল্লসিত হবে।

জবাবে লালন বললেন, “পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল যে.....।”

প্রচারে উল্লসিত হওয়ার কোনও বাসনা তাঁর নেই। তাই তিনি গেয়ে ওঠেন,
‘আপনার সাধন কথা
যা কহিবে যথা তথা
আপনারে আপনি তুমি হইও সাবধান।’

এই লালন ফকিরকে নিয়ে গৌতম ছবি এঁকেছেন সেলুলয়েডে। প্রতিভা, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমের মিলনে। তথাকথিত বাংলা ছবির জাত এবং গড়ন থেকে ‘মনের মানুষ’ আলাদা। গান এবং গল্প মিলেমিশে ছবিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু প্রচলিত পথ ধরেনি। বৃদ্ধ লালন যখন তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীকে স্মরণ করেন, তখন পদ্মাবতী যুবতী হয়েই তাঁর মানস চোখে ধরা দেন। লালন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন অসীম মমতায়। যেহেতু সময়ে পরিবর্তিত পদ্মাবতীকে লালন দেখেননি, তাই তাঁর চোখে অপরিবর্তিত থাকাটাই যুক্তিসম্মত। গল্প আসছে, আবার জায়গা দিচ্ছে অন্য গল্পকে। নানান জাত এবং রংয়ের ফুল দিয়ে গাঁথার পর যদি মনে হয় মালা পূর্ণতা পেল, ফুলগুলো আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে না, তখন মালাকারের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হয়।

‘অতিথি’র তারাপদ কি আরেকটু বড় হলে লালু হয়ে যেতে পারত? সেই যে মাঠঘাট আকাশে নিজেকে মেলে ধরত তারাপদ, লালুও তো তাই চেয়েছিল। নইলে সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হতে চাইবে কেন? তফাত এই শুধু লালুর বৌ ছিল পদ্মাবতী। যে লালুর প্রিয় পুনা মাছ। ‘পুনা মাছে লাফ মারিছে পুকুরে/ শনিবারের বারবেলাতে দুকুরে।’ এ কি শুধু গানের দু’টো লাইন? শনিবারের মধ্যাহ্নের আলস্যে মিলন আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত নয়?

বাংলা ছবিতে এই কিছু দিন আগেও চুম্বন প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ক্যামেরায় সরাসরি না দেখিয়ে জলে প্রতিবিম্ব ফেলে দেখানো হত। দেখে মনে হত সব কাচের মানুষ। অতি প্রয়োজনেও নায়ক-নায়িকা শরীরের চাহিদার কথা বলবে না। অবশ্য বলার অনুমতি সেন্সর বোর্ড দিলে অনেক পরিচালক পর্নো ফিল্ম বানাতে তৎপর হতেন। ‘মনের মানুষ’-এ সাহসী গৌতম এমন একটি দৃশ্য তৈরি করেছেন যা কোনও ভারতীয় পরিচালক এখনও পর্যন্ত ভাবতে পারেননি। মধ্যরাত্রে কমলী এসেছে লালনের ঘরে। লালনকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে করতে খেপে ওঠে সে, “কী হইল, তুমি কি পাথর? কামনাবাসনা নাই?”

লালন বলেন, “থাকবে না ক্যান? সব মাইনষের যেমন থাকে---!” কমলীর মুখ নীচে নামে। ক্যামেরা তখন লালনের বুকে। কমলীকে দেখা যায় না। কিন্তু তার হাসি, আবিষ্কারের হাসি উছলে ওঠে। সে মুখ তুলে বলে, “তোমার বাসনা আছে ষোলো আনা। তুমি ভাবের ঘরে চুরি কর। আমারে শান্ত করো সাঁই।”

লালন বলেন, “শরীর জাগে শরীরের নিয়মে... মন যদি না জাগে!”

আমরা কোথাও অশ্লীলতার গন্ধ পেলাম না। জানলাম বাংলা ছবি সাবালক হয়ে গেল।

এই ছবির ক্যামেরায় গৌতম ছবি তোলেননি। এঁকেছেন। সেই যে দৃশ্যটি, জোৎস্না রাতে একাকী লালন জলের ধারে বসে আছেন, জলে চাঁদের আলো চিকচিক করছে, কী মায়ায় দৃশ্যটি বুকের গভীরে চলে আসে।

সব ভালো ছবির দু’টো খটকা এখনও মনে লেগে আছে। আমরা লালনকে প্রথম এবং শেষ দৃশ্যে দেখছি অতি বৃদ্ধ অবস্থায়। চোখ-মুখ-কণ্ঠস্বরে জরা স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর গল্প শেষ হয়েছে যখন, তিনি চল্লিশে পৌঁছেছেন। ওই আমলের সময়টা কি বাদ পড়ে গেল তাঁর গানকে জায়গা দিতে? কাঙাল হরিচরণ যখন জঙ্গলের সাধনপীঠে এসে জানিয়েছিলেন অনুমতি ছাড়া জঙ্গলে থাকা যায় না, তখন লালন বলেছিলেন, “এই জঙ্গল তো খোদা বা ভগবানের তৈরি।” কাঙাল হরিচরণ তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, সায়েবের লেঠেল এ কথা শুনবে না। জমিদার ঠাকুরবাবুর কাছ থেকে অনুমতি যেন নিয়ে নেন। অথচ তার দীর্ঘকাল পরে বৃদ্ধ লালন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অনুরোধ করছেন কাঙাল হরিচরণের বলা কথা অনুযায়ী। বলছেন তিনি জানতেন না অনুমতি নিতে হয়। কেন? জঙ্গলে বাস করা লালনের পোশাকও দৃষ্টিকটু লেগেছে। অত ধবধবে সাদা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক নয়।

চিত্রনাট্য লিখেছেন গৌতম এবং তাঁকে সাহায্য করেছেন শাহজাদ ফিরদৌস। লালনের গান তো আছেই, তা ছাড়া শাহজাদ ফিরদৌসের লেখা গান ব্যবহার করেছেন গৌতম। ‘জলের ওপর পানি’ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এই খটকার কথা বাদ দিলে ছবির প্রতিটি দৃশ্যের নির্মাণে যে দক্ষতা তা এই ছবিকে সমৃদ্ধ করেছে। মনে পড়ছে রণপা নিয়ে লালন এবং তাঁর দলবলের সদ্যবিধবা যুবতীকে সতী হওয়া থেকে উদ্ধার করার দৃশ্যটি। মনে পড়ছে নদীতে দূর থেকে ভেসে আসা কাঙাল হরিচরণদের নৌকোটিকে। বাংলাদেশ এবং উত্তরবাংলার খোলা প্রকৃতিতে যেখানে যাওয়া মোটেই সুখকর নয়, সেখানে গিয়ে গৌতম অসাধ্যসাধন করেছেন। আর এই কারণে চোখ জুড়ানো পটভূমি পেয়ে গেছি আমরা।

এই ছবির প্রাণ হল গান। লালনের গানগুলো যতটা সম্ভব ঠিকঠাক সংগ্রহ করে গৌতম সাজিয়েছেন। সুর দিয়েছেন তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখনকার লেখা গানে। আর ওই সব গানের পাশে আবহসঙ্গীত শুনে লালনের কথাই মনে আসে, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে।’

দ্বিতীয় দৃশ্যে জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের সঙ্গে যে বৃদ্ধ জরায় জড়ানো ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন তিনি যে প্রসেনজিৎ তা বুঝতে কয়েক সেকেণ্ড সময় চলে গিয়েছিল। আমি সোজা হয়ে বসলাম। চোখের পাতায় অতিবৃদ্ধের ক্লান্তি। চাহনিতে নিরাসক্তি। গলার স্বরে সন্ধ্যার সুর, যখন বুঝলাম অভিনেতার নাম প্রসেনজিৎ তখন বিস্ময়ের দিগন্ত থাকল না। আমি জানি বহু কাল কষ্ট করে, নামের উচ্চারণেও তার নজির রেখে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পরপর কয়েকটি ছবিতে অতীতের আবর্জনা ফেলে দিয়ে অভিনেতা হিসেবে আলোকিত হচ্ছিলেন। কিন্তু লালন চরিত্রে তাঁর অভিনয় যে মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে, অন্তত বৃদ্ধ লালনের ভূমিকায় তা ছবি বিশ্বাস ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব হত না। তিনি তারকা হয়েইছিলেন, ইদানীং অভিনেতা, এখন শিল্পী। যুবক লালনের চরিত্রে তাঁর বাচনভঙ্গি বদলেছে। নিজেকে ভেঙেছেন আদ্যপ্রান্ত, দাড়ি বা জটা নিশ্চয়ই সাহায্য করেছে কিন্তু তাঁকে সাধক বলে মেনে নিতে আমার দ্বিধা হয়নি।

শুধু একটা কথা না বলে পারছি না। লালন চরিত্রে প্রসেনজিৎ বিপুল সুযোগ পেয়েছিলেন। যুবক ও বৃদ্ধ লালনের চরিত্র আলাদা করতে তিনি দু’রকম কণ্ঠ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গি যে স্বাভাবিক নয় তা কিন্তু সময়-সময় বোঝা যাচ্ছিল।

এই ধাক্কাটা না খেলে দাড়ি এবং জটার রাজসম্মেলন হয়তো লালনকে ‘সন্ন্যাসী রাজা’য় নিয়ে যেতে পারত।

বাংলাদেশের কয়েক জন শিল্পীকে নির্বাচন করার জন্য গৌতম ঘোষকে ধন্যবাদ। প্রথমেই বলি চঞ্চল চৌধুরীর কথা। কালুয়া চরিত্রে ওঁর অভিনয় দীর্ঘদিন মনে থাকবে। মনে থাকবে রাইসুল ইসলাম আসাদকে। মনেই হয়নি এঁরা অভিনয় করছেন। প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়ের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খুবই বিশ্বাসযোগ্য। ভাল কাজ করেছেন সৈয়দ হাসান ইনাম, গুলসান। আর চম্পা। বাংলাদেশের একদা নায়িকা চম্পাকে অনেক দিন পরে দেখলাম। নিজেকে ভেঙেছেন শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাঙাল হরিচরণ চরিত্রে অভিনয় অন্য মাত্রা স্পর্শ করেছে। শুভ্রা কুণ্ডুু, বিবি রাসেল অথবা রোকেয়া চমৎকার। কিন্তু নিজেকে ভাঙতে পারেননি পাওলি দাম। অত বছর আগে একেবারে গ্রাম্য চরিত্রে যে বাউল পরিবারে আশ্রিতা তার চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গি এবং চাহনিতেও কেন আধুনিকতার ছাপ পড়বে? অস্বীকার করব না, চেষ্টা ছিল। কিন্তু চেষ্টাটা বোঝা যাচ্ছিল।

ছবি শেষ হল যেখানে, সেখানে কি সত্যি শেষ হল? গগনের সঙ্গে লালনের সেই উদ্দাম নাচ,
‘মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে।’
মিলন কি সহজে হয়? এই আকাঙ্ক্ষা নিয়েলালন বেঁচে আছেন এখনও। অতিবৃদ্ধ লালন কোন শক্তিতে ওই নাচ নেচে যান? তার সন্ধানেই এই ছবিটি নির্মিত। হয়তো গানের সংখ্যা বা সংক্ষিপ্তকরণে ছবির আয়তন কমানো যেত। এই ছবির দৈর্ঘ্য যাঁদের কাছে ঈষৎ বড় মনে হবে তাঁরা ওইরকম ভাবতে পারেন।

ভাবতে পারেন এত ভাল একটা ছবি ছোটখাটো কিছু ত্রুটির জন্য ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বা ‘পথের পাঁচালী’র পাশে বসতে বসতেও সামান্য সরে গেছে। কিন্তু তাতে কী? প্রায় মাইলফলকের পর্যায়ে চলে যাওয়া ছবির মূল ভাবনা তো এখনও কানে বেজে চলেছে—
“হিঁদু-পোড়া শ্মশান আর মিঞার গোরস্থান
কাহার থেকে সে ছোট কও, কার কি অবস্থান
বল্‌ খোদা বল্‌ খোদা বল্‌...।’’

সুত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
[ইনি আবার কাঙাল হরিনাথকে লিখেছেন হরিচরণ- হা হা প গে]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:৪১
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×