কালের কন্ঠ পত্রিকায় আজ প্রধানমন্ত্রীর একটা সাক্ষাৎকার [?] ছাপা হইছে। ইহা একান্ত সাক্ষাৎকার। ত্যাগ আর ভোগের মধ্যকার প্রভেদখানা ইহা থেকে বুঝিয়া লন। প্রধানমন্ত্রী সুন্দর করে তা ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কথা হইল, ইহা কি করে একান্ত সাক্ষাৎকার হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কেউ কোন প্রশ্ন করে নাই, প্রধানমন্ত্রী উপদেশ আর স্মৃতিচারণমূলক কথা বলে গেছেন। ড্যাপ নিয়া কেলেংকারীতে থাকা বসুন্ধরা আর কত খেল দেখাইবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিদস্যুদের মোসাহেবীতে বেভুল হইবেন না।
একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সবাইকে বলি ত্যাগের রাজনীতি করুন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে চলমান ভোগবিলাসনির্ভর রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতিকদের ত্যাগের রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, চাকচিক্য দিয়ে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না; দেশ ও জনগণের জন্য কিছু করা যায় না। এর মাধ্যমে চোখ ধাঁধানো যায়, কিন্তু এতে মানুষের কোনো উপকার হয় না।
গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে 'সেই হাসমত আলীর জমির দলিল রমিজাকে হস্তান্তর' অনুষ্ঠানের পর কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। এ সময় তিনি দেশে সেনাসমর্থিত শাসনামল, বঙ্গবন্ধুর হত্যা-পরবর্তী অস্থির প্রেক্ষাপটে তাঁর দেশে ফিরে রাজনীতির হাল ধরাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক হায়দার আলী। সঙ্গে ছিলেন ফারুক মেহেদী।
একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতি দুই ধরনের_একটি ভোগের রাজনীতি আর অন্যটি হলো ত্যাগের রাজনীতি। ভোগের রাজনীতির উদ্দেশ্যই হচ্ছে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া, পদ-পদবি নেওয়া, সামাজিক স্ট্যাটাস নেওয়া। এটা হলো এক ধরনের রাজনীতি। কিন্তু যে রাজনীতি আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, শিখে এসেছি, যে আদর্শ ধারণ করেছি, সেটা হলো ত্যাগের রাজনীতি। এর অর্থ হলো, মানুষের জন্য কাজ করা। নিজের ভোগের জন্য সে রাজনীতি নয়। শেখ হাসিনা বলেন, 'আমি জনগণের জন্য কতটুকু করতে পারলাম, তাদের জন্য কতটুকু করেছি, তাদের কতটুকু দিতে পেরেছি, তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কী ব্যবস্থা করতে পেরেছি, সেটাই হচ্ছে আসল রাজনীতি। আসলে রাজনৈতিক বোধ একেকটা মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের মন-মানসিকতার ব্যাপার। আমার যেটা বক্তব্য তা হলো, রাজনীতি মানে মানুষের জন্য কিছু করা।'
রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনো কখনো সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে যখনই দেশে মিলিটারি ডিক্টেটররা শাসন করেছে, তাদের শাসনে কোনো মৌলিকত্ব ছিল না। ক্ষমতা দখল করে তারা চাকচিক্য দিয়ে নিজেদের দৈন্যটাকে ঢাকতে চেষ্টা করল আর কিছু মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত (করাপ্ট) করল। চাকচিক্য, জৌলুশ ও ভোগবিলাসী জীবন সামনে নিয়ে এসে তারা মানুষকে আকর্ষণ করল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকল। এমন রাজনীতিই তারা করে গেছে। কিন্তু সত্যিকার রাজনীতি যাকে বোঝায়, আমরা সেটা শিখেছি, জানি, বুঝি এবং আমরা সেটা করেছি।
রাজনীতির মধ্যে জনগণকে সেবা করার মনোভাব থাকতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণের পরবর্তী ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বলেন, '১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করার পর যখন জনগণের জন্য কাজ করলাম, এ দেশের জনগণ তখন বুঝতে লাগল তারা এর আগের সরকারগুলোর সময় কেমন শোষণের মধ্যে ছিল। আসলে সরকার মানে হলো জনগণের সেবক। আমি এ কথাটি বারবারই বলে থাকি। আগের সরকারগুলোর কাছ থেকে জনগণ দেখেছে যে সরকার মানে বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা। সরকার মানে ভোগবিলাস, ফুর্তি, চাকচিক্য, স্যুট-বুট_এই সব। তাদের কাছে প্রধান বিষয়ই ছিল দামি শাড়ি, চকচকে গয়না ইত্যাদি। এটাই তারা শিখেছে, দেখেছে। কিন্তু সরকার মানে যে জনগণের সেবা করা, তাদের প্রতি কর্তব্য করা_আমাদের সরকারের এটাই মূলমন্ত্র। সবাইকে বলেছি, আমরা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করি, করব। আমরা সেটা করে প্রমাণ করেছি যে জনগণের জন্য কাজ করা যায়। মানুষ আমাদের সময়ই প্রথম উপলব্ধি করেছে যে তারা অন্তত সরকারকে কাছে পাচ্ছে। তাদের সমস্যার সামাধানে তাদের পাশে পাচ্ছে।'
শেখ হাসিনা জনবান্ধব সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি প্রত্যাশা করে বলেন, 'আমার নেতা-কর্মী ও দেশের সবার কাছে একটাই চাওয়া_তারা যেন ভোগের নয়, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে রাজনীতি করে, যেখানে মানুষের জন্য কিছু করে দেওয়া যায়। এটাই রাজনীতিবিদের আদর্শ হওয়া উচিত।'
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বারবারই পোশাকি রাজনীতির সমালোচনায় ফিরে যান। তিনি বলেন, চাকচিক্য দিয়ে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না এবং দেশ ও জনগণের জন্য কিছু করা যায় না। হ্যাঁ, চোখ ধাঁধানো যায়, সাময়িকভাবে হয়তো একটু চার্ম দেওয়া যায়_এতটুকুই। কিন্তু এতে মানুষের কোনো উপকার হয় না।
চলমান রাজনীতিকে এসবের প্রভাবমুক্ত রাখতে সাধারণ নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের নেতা-কর্মীদের সব সময়ই একটা কথা বলি যে আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই চলতে চাই। কাজেই সবার রাজনীতি হতে হবে জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ ও কর্তৃত্ববোধ। মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ থাকতে হবে। জনগণের ভালোবাসা নিয়ে, জনগণের জন্য কাজ করে, তাদের কী দিতে পারলাম_এই চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। কী পেলাম আর কী পেলাম না, সেটা বড় কথা নয়। ওই জৌলুস, ভোগ_এগুলো মানুষকে কী দেয়? কতটুকু দেয়? এসবে সত্যিই কোনো আনন্দ নেই, প্রশান্তি নেই।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনকে পুঁজি করেই দেশে ফিরে আসার স্মৃতিচারণা করে ফিরে যান বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে, সেই ১৯৮১ সালে, যে সময় তাঁর শিকড় বলতে ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। সে কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখেমুখে ভেসে উঠছিল বাবা-ভাই-স্বজন হারানোর বেদনা ও করুণ আকুতি। তিনি বলেন, '১৯৮১ সালে আমি যখন দেশে ফিরে আসি, তখন আমার কী ভরসা ছিল? কী ছিল আমার শক্তি? তখন আমার সত্যিকার প্রাণের জোর ছিল এখানকার সাধারণ মানুষ। আজকে যে হাসমত আলী নিয়ে এত তোলপাড়, এত কথা, সেই অসংখ্য হাসমত আলীর ভালোবাসাই ছিল আমার একমাত্র ভরসা, আমার ভিত। এখনো যে আমি রাজনীতি করে যাচ্ছি, নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে চলতে পারছি, আমাকে কিন্তু সেই শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছে ওপরে আল্লাহ আর নিচে এই হাসমত আলীদের মতো অগণিত মানুষের ভালোবাসা। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, বড় জোর এবং আমি এখনো কিন্তু ওই দিকেই তাকিয়ে আছি।' তিনি বলেন, 'আমার একটি কথা মনে হয় বারবার। তা হলো_দেশের মানুষ কেন গরিব, দরিদ্র থাকবে? কেন অবহেলিত থাকবে? কেন শোষিত-বঞ্চিত হবে? আমার বাবা তো এই শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই রাজনীতি করে গেছেন। আমিও সেই রাজনীতিই ধারণ করেছি মনেপ্রাণে। কাজেই আমার বুকের ভেতরও সেই আদর্শ।'
এ সময় প্রধানমন্ত্রী নিজের স্বজন হারানোর কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগ-ভারাক্রান্ত হন। তাঁর দুই চোখ জলে ছলছল করে ওঠে। নিজেকে খানিকটা সংবরণ করে বলেন, 'আমি আসলে মা-বাবা, ভাই-বোন_সব হারিয়ে বাংলাদেশে এলাম; মানুষ একটা শোক সইতে পারে না, আর কত বড় শোকের পাথর বুকে নিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে_এটা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এটা শুধু আমিই জানি। তার পরও আমি ফিরে এসেছি শুধু এই দেশের মানুষের জন্য, যে মানুষের জন্য আমার বাবা সারাটা জীবন কষ্ট করে গেছেন এবং জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। শেষ পর্যন্ত গোটা পরিবারসহ নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে গেলেন। এই শোকের মধ্যেও এগিয়ে নিতে হয়েছে বাবার ইচ্ছা ও আদর্শকে। কাজেই আমার বাবা যে সাধারণ মানুষগুলোকে এত ভালোবাসতেন, সেই ভালোবাসার ছোঁয়া তো আমি কিছু পাচ্ছি। এই যে হাসমত আলীদের মতো যাঁরা এত বড় একটা ভালোবাসার নিদর্শন দিয়ে গেছেন, এটা তো আমাদের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা ও শক্তি।' এ সময় তিনি তাঁর নামে জমি কিনে দেওয়া হাসমত আলীর বিরল ভারোবাসার উদাহরণ টেনে বলেন, 'আজকে যে আমি জমিটা ওনার (হাসমত আলীর বিধবা স্ত্রী রমিজার) হাতে রেজিস্ট্রি করে দিতে পারলাম, আমার আজকে যে কী ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে, আমি তাঁর যে ভালোবাসাটা পেলাম, তা তাঁদের কাছেই জমা রাখলাম। এর দামটুকু তাঁকে দিলাম না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী-ছেলে যেন ওই জমিতে থেকে নিজের জীবনটা সুন্দরভাবে সাজাতে পারে, আমি এইটুকুই করতে চাইলাম। তা করতে পারার জন্যই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, বড় শান্তি।'
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিরল ভালোবাসার তথ্য উদ্ঘাটনের কৃতিত্বের বিষয় তুলে ধরে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে বলেন, 'অনেকেই সাংবাদিকতা করে, তবে এই যে সত্য ঘটনাটা তুলে ধরা হলো, এর মাধ্যমেই আমি জানতে পারলাম। না হলে আমার জানার সুযোগ হতো না। এটা একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ জন্য আমি প্রতিবেদক হায়দার আলীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই এবং এ ধরনের মহৎ সাংবাদিকতার জন্য তাঁকে দোয়া করি।'
কালের কন্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১২:৫৪