তবে ভালো কথা বলিতে যদি মন্দ কথা বলি, তাহা হইলে পাচঁ জনের গালাগালি দিবার বাস্তবিক অধিকার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্বোক্ত দুই শ্রেনীর সমালোচকগণ কথাটা ভালো-কি-মন্দ সেদিকে লক্ষ্যও করেন না। নাই করুন, কথাটা ভালো করিয়া বলা হইয়াছে কিনা, তাহাও দেখেন না। দেখেন কেবল লেখার মধ্যে বড়ো বড়ো সংস্কৃত কথা আছে কি পারসি ও ইংরেজি শব্দ আছে। মারামারি করেন কেবল তাহাই লইয়া। সুতরাং আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকবর্গের সেই বিষয়ে দৃষ্টি রাখিয়া চলিতে হয়। তাহাতেও গোলযোগ। দুই দল দুই দিক ধরিয়া টানাটানি করিতেছেন, তখন উভয় দলের মন রক্ষা করা অসম্ভব। অখচ যে দলের মনরক্ষা না হইবে, তিনিই কুঠার উত্তোলন করিয়া লেখকের প্রতি ধাবমান হইবেন। এ অবস্থায় লেখক বেচারা বিষম সমস্যায় পড়িয়া যায়।
এ সমস্যার কি পূরণ হয় না? এ সংকট হইতে কি পরিত্রানের উপায় নাই? বঙ্গীয় লেখককুল কি এই প্রতিকূল বাত্যায় ভগ্নপোত হইয়া অপার সমুদ্রে ভাসিবেন? তাহাঁরা কি কূলে উঠিতে পারিবেন না? সমালোচকদিগের এই বিষম রোগের কি উপশম হইবে না? উপশম নাই হউক, ইংরেজিতে বলে রোগের নির্ণয় অর্ধেক উপশম। এ রোগের কারণ নির্ণয়ের কি কিছুই চেষ্টাও হইবে না।
অনেকগুলি সুচিকিৎসকের সহিত বিশেষ পরামর্শ করিয়া আমরা ইহার কতক কারণ ঠিক করিয়াছি। ঠিক করিয়াছি বলিতে পারি না। কতক অনুভব করিয়াছি। যাহা বুদ্ধিস্থ হইয়াছে, তাহা মুক্তকন্ঠে বলিব। এস্থলে কুঠারের ভয় করিলে চলিবে না। যদি আর-কেহ অন্য হেতু- প্রদর্শন করিতে পারেন, নিরতিশয় আনন্দ সহকারে শ্রবণ করিব।
কথাটি এই যে, যাহাঁরা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারন করিয়াছেন, তাহাঁরা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই। হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন। কতকগুলো অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নতূন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন। নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কি আছে না আছে তাহাতে তাহাঁদের নজরও পড়ে নাই।
এখন তাহাঁদের বই পড়িয়া যাহাঁরা বাংলা শিখিয়াছেন, তাহাদের যথার্থ মাতৃভাষায় জ্ঞান সুদূরপরাহত হইয়াছে। অথচ ইহাঁরাই যখন লেখনী ধারণ করেন, তখন মনে করেন যে, আমার বাংলা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট। তাহাঁর বাংলা তিনি ও তাহাঁর পারিষদবর্গ বুঝিল, আর কেহ বুঝিল না। কেমন করিয়া বুঝিবে! সে তো দেশীয় ভাষা নহে। সে অনুবাদদিগের কপোলকল্পিত ভাষার উচ্ছিষ্ট মাত্র। দেশের অধিকাংশ লোকই উচ্ছিষ্ট ভোজনে জাতিপাতের ভয় করে অথচ লেখকমহাশয়েরা তাহাদিগতক কুসংস্কারাপন্ন মূর্খ বলিয়া উপহাস করেন। এই গেল এক দলের কথা।
আবার যখন অনুবাদদিগের এইরূপ দীর্ঘছন্দ সংস্কৃতের "নিবিড় ঘনঘটাচ্ছন্দের" নদ, নদী, পর্বত, কন্দরের অসম্ভব বাড়াবাড়ি হইয়া উঠিল, যখন সংস্কৃত, ইংরেজি পড়া অপেক্ষা বাংলা পড়ায় অভিধানের অধিক প্রয়োজন হইয়া পড়িল, তখন কতকগুলি লোক চটিয়া বলিলেন, এ বাংলা নয়। বলিয়া তাহাঁরা যত চলিত কথা পাইলেন, তাহাই লইয়া লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাঁদের সংখ্যা অল্প, কিন্তু ইহাঁরা সংস্কৃতের সং পর্যন্ত শুনিলে চটিয়া উঠেন। এমন-কি ইহাঁরা সংস্কৃতমূলক শব্দ ব্যবহার করিতে রাজি নন। অপভ্রংশ শব্দ, ইংরেজি শব্দ, পারসি শব্দ ও দেশীয় শব্দের দ্বারা লিখিতে পারিলে সংস্কৃত শব্দ প্রাণান্তেও ব্যবহার করেন না। এই গেল আর-এক দলের কথা। সুতরাং এই উভয় দল যে পরস্পরবিরোধী হইবেন, এবং বঙ্গীয় লেখকগণকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিবেন, আপত্তি কী?
আমরা যে পূর্বে লিখিয়াছি বাংলাভাষায় যাহাঁরা এ পর্যন্ত লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাহাঁরা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই, ইহা অতি সত্য কথা। আমরা ইতিহাস দ্বারা এইটি সমর্থন করিব।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ ভোর ৫:৪৫