যশোরের রাজাকারেরা
রাজাকার মেহের জল্লাদ এখন দাওয়াখানা খুলেছে
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার প্রায় সবাই মেহের জল্লাদকে প্রায় এক নামে চেনে। একাত্তরে এই মেহের জল্লাদ যশোর এম এম কলেজের ভিপি মুক্তিযোদ্ধা আসাম, জেলা কৃষক সমিতির সেক্রেটারি শান্তি, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মানিক, লন্ডনে উচ্চশিক্ষাগ্রহণকারী প্রগতিশীল যুবক তোজো, আকরামসহ বহু মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। চামড়া ছিলে লবণ দিয়ে, রাজপথে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার বিষয়ে এ রাজাকারের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় পাতন গ্রামের রাজাকার মেহেরুল ইসলাম ‘মেহের জল্লাদ’ নামে সে সময় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আতঙ্ক ও ত্রাস হিসাবে গ্রামে গ্রামে কান্নার রোল সৃষ্টি করে। এই নর ঘাতকের কোনো বিচার হয়নি। সে বহাল তবিয়্যতে এখন দাওয়াখানা খুলে চিকিৎসার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
মেহের জল্লাদ সম্পর্কে মনিরামপুরের নানা পেশার লোকের সঙ্গে কথা বললে জানা যায় এই নরপিশাচ মেহের জল্লাদ একাত্তরে যারপরনাই নির্যাতন করতো মানুষদের। সে ক্লাশ নাইন পাশ। কবিরাজ ইয়াকুব আলীর ছেলে মেহের আলী। একাত্তরের শুরুতেই সে রাজাকার কমান্ডার হয়ে একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’ গঠন করে। তাহেরপুরের গৌরদাস বাবুর বাড়ি দখল করে মেহের সেখানে বালাখানা বানিয়ে প্রতিরাতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নারীদের এনে ধর্ষণ করতো। তারপর ধর্ষিতা নারীদের হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিতো। মানুষ খুন করা ছিলো মেহেরের নেশা। এই নরঘাতক মেহের এখন মনিরামপুরের দোলখোলা মোড়ে জনতা দাওয়াখানা খুলে চিকিৎসার নামে প্রতারণার ব্যবসা করছে।
অসংখ্য মানুষের ঘাতক আফসার জল্লাদ
এখন চায়ের দোকান চালায়
এই বকলম আফসার জল্লাদকে এখন দশগ্রামের মানুষ চেনে। স্বযঘোষিত ‘মেজর’ নামের এই রাজাকারের বাড়ি যশোর সদর থানার নরেন্দ্রপুর গ্রামে। সে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল হককে খুন করেছে। রূপদিয়া এলাকার বধ্যভূমি তার হাতেই সৃষ্টি। এখন আফসার জল্লাদ গ্রামে চায়ের দোকান খুলেছে। চা বানিয়ে বিক্রি করে। এক সময় কৃষিকাজ করতো এই জল্লাদ। ১৯৭১ সালে লুৎফ মৌলভী ও আবদুল খালেক নামের দুই মৌলবাদীর প্ররোচনাতে সে রাজাকার হয়।
তারপর সাতদিনের প্রশিক্ষণ শেষে এই রাজাকার কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে রুপদিয়া, কচুয়া, নরেন্দ্রপুর, চাউলিযা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার সম্বন্ধে খবর নিয়ে জানা যায়- তার স্ত্রী তিনজন। রুপদিয়া বাজারে ১৯৭১ সালে রোস্তম ডাক্তারের বাড়ির ক্যাম্পে রাজাকাররা বাঙালিদের উপর যে নির্যাতন করতো তার মূল নায়ক ছিলো এই আফসার রাজাকার।
আমজাদ কায়েম আলীরা যশোরে
হত্যা করেছে অনেক মানুষ
যশোরের বাঘাপাড়া থানার প্রেমচারায় আমজাদ মোল্লা, কায়েম আলী গোষ্ঠীসমেত রাজাকারে নাম লিখিয়ে একাত্তরে এলাকায় যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে তা বলাই বাহুল্য। আমজাদ-কায়েম আলী গং চানপুরের মুক্তিযোদ্ধা নওশেরের বৃদ্ধ মা-বাবাকে উলঙ্গ করে গুণি করে হত্যা করে। সাত মুক্তিযোদ্ধাকে চামড়া ছিলে হত্যা করে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো এই অমানুষ রাজাকার। পুত্র খোকনকে হত্যা করে লাশ ভেলায় ভাসিয়ে দিলে প্রিয় সন্তানের শোকে সেই লাশ আনতে গেলে বাবা আব্দুল মালেককেও হাত-পা বেঁধে পানিতে ছুড়ে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই ঘৃণ্য রাজাকারেরা নিজেদের বাড়িতেই তৈরি করেছিলো টর্চার সেল। সেলের কমান্ডার ছিলো এই শুয়োরের জ্ঞাতী আমজাদ হোসেন মোল্লা। আর কায়েম আলীর দুইভাই নওশের, ইদ্রিস, চাচাতো ভাই সবুর বিশ্বাস, চাচা দলিল উদ্দীন, মোজাহার বিশ্বাস, জামাই আহমদ আলী, ভাইয়ের ছেলে মতিয়ার, দাউদ গফুর সোবহান- এদের নিয়ে এক বিরাট রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠে। এদের অত্যাচার নির্যাতনের কোনো শেষ ছিলো না। তারা স্থানীয় বন্দবিলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম ও প্রগতিশীল ছাত্র সাখাওয়াতকে তাদের বাড়ির ভেতরে ঘুমের মধ্যে হত্যা করে। গাইদঘাটার মুক্তিযোদ্ধা সুরুত আলী, চাঁদপুরের আয়নাল, মুক্তারসহ ফরিদপুরের সাত মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে বিভূতি রায়ের বাড়িতে চামড়া ছিলে কুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। এই রাজাকারদের মধ্যে কাযেম আলী মারা গেছে অনেক আগেই। আর রাজাকার আমজাদের পেশা দালালী।
খালেক মোড়লের নাম শুনলে
আঁতকে উঠেন যশোরের মানুষ
যশোরের চারটি থানার রাজাকার কমান্ডার আবদুল খালেক মোড়লের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বহু নিরীহ মানুষ হত্যার। তার বাড়ি যশোরের সদর উপজেলার কচুয়া গ্রামে। সে কচুয়া ও তার আশেপাশের গ্রামে এক সময় চুরি করে বেড়াতো। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সে যশোরের রূপদিয়া বাজারের পাকি সেনাদের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে বেড়াতো। লুট করার অভিযোগও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন লোকের বাড়ি। সে কারণে কচুয়া গ্রামের সবাই তাকে ‘কেলো চোর’ বলেই জানে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তার সম্বন্ধ ভালো হওয়ায় তাকে যশোর সদর, বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও মনিরামপুরের রাজাকার কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। নতুন দায়িত্ব পেয়েই ‘কেলো চোর খালেক’ কচুয়া মেঠোপাড়ার হাদিস, হাটবিলার ইজ্জত আলী, ঘাটকুল কচুয়ার যুবক সন্যাল মিস্ত্রী, ভগবতিতলার জলিল, বসুন্দিয়ার মাহফুজসহ শত শত
মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
যশোরের সেই মেজো হুজুরের কুকীর্তি
একাত্তরের পর যে কয়টি রাজাকার ধর্মের লেবাস ধারণ করে এখন হুজুর বনে গেছে তাদের মধ্যে নওয়াপাড়ার মেজো হুজুর অন্যতম। তার নির্দেশেই সেদিন হত্যা করা হয়েছিলো অগণিত মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ নিরস্ত্র বাঙালিদের। খাজা সাঈদ শাহ মেজো হুজুর যশোরের নওয়াপাড়ার পীর হিসেবে খ্যাত। সে ‘টিআই প্যারেডে’ মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করে হত্যা করতো। একাত্তরের শুরুতে সে স্থানীয় অপরাধীদের নিয়ে একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’ গড়ে তুলে। অভয়নগর থানা এলাকায় সে মানুষ হত্যার জন্য ২২ জল্লাদ রিক্রুট করে। এই জল্লাদরাই হুজুরের নির্দেশে মানুষ হত্যা করে। নওয়াপাড়ার পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের কাছে ছিলো মেজো হুজুরের টর্চার সেল। এখন সেখানে স্থানীয় বিএনপি’র অফিস। মানুষ হত্যায় পাকিস্তানি বাহিনী তাকে একটি উইলি জীপ উপহার দেয়। এ জীপে ঘুরে একাত্তরে সে পুরো অভয়নগরের মাটি কাঁপিয়েছে।
সে ১৯৭০ সালে নেজামী ইসলামীর ব্যানারে দাঁড়িয়ে বই মার্কায় নির্বাচন করে পরাজিত হয়। স্বাধীনতার পর সে পীর বাড়ির খাসমহলে আত্মগোপন করে থাকে। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর আবার লাইম লাইটে আসে এই জঘন্য রাজাকার। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ফের খাসমহলে প্রবেশ করে এই রাজাকার। এরপর থেকে আর কেউ তার চেহারা দেখেনি।
বিজয়ের তিন মাস আগেও শপথ নেয়
যশোর পিস কমিটি
১৯৭১ সালে জাতি যখন স্বাধীনতার জন্য মরণপণ যুদ্ধে নামে তখন পাকিস্তানিদের মদদে এগিয়ে এসেছিলো এদেশেরই কিছু কুসন্তান। এরা পাকিস্তানিদের চেয়েও পাকিস্তানি ছিলো। এরা প্রথমে গঠন করেছিলো শান্তি কমিটি। পরে পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে তৈরি হয়েছিলো রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ বিভিন্ন প্যারা-মিলিটারি দল। এদের নৃশংসতা এখনো জাতির স্মৃতিতে বিভীষিকা হয়ে আছে। এই পিস কমিটিসহ বিভিন্ন পাকিস্তানি সহযোগী বাহিনী পরিচালনার জন্য এক বাঙালি উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশেষ দফতর। স্বাধীনতার পর সে দফতর থেকেই উদ্ধার করা হয় শান্তি কমিটি, রাজাকারসহ পাকিস্তানি মিলিটারির বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের তালিকা।
যশোর পিস কমিটি
একাত্তরের যশোর পিস কমিটির তালিকা পাওয়া গেছে। ২৫ সদস্যের দালালদের এ কমিটির তালিকাটি কমিটির চেয়ারম্যান মোঃ কামরুদ্দিন বিএ দ্বারা স্বাক্ষরিত ছিলো। প্রাপ্ত কয়েকটি দলিলের মধ্যে একটি হচ্ছে শহর কমিটি গঠনের। এতে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের তিন মাস আগেও যশোরে ফপিস কমিটির সদস্যরা ‘দুষ্কৃতীকারী’ প্রতিরোধের শপথ নেয়। তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের খুশি করতে এ তৎপরতা চলতে থাকে। বৈঠকের পর বৈঠক, কমিটির পর কমিটি গঠনের তোড়জোড় চলছিলো যশোর শহরে।
(চলবে)