ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ-নরসিংদীর রাজাকাররা
ভৈরবের অসংখ্য হত্যা লুটের হোতা
সাদেক হোসেন এখন বিএনপি নেতা
একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার সাদেক হোসেন এখন ভৈরব থানা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক। প্রভাবশালী নেতা। এই রাজাকার নরঘাতক একবার জনপ্রতিনিধিও হয়েছিলো। তার বিরুদ্ধে ভৈরব উপজেলায় মানুষ হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তার পিতা ছিলো আল-বদর প্রধান এবং তার সহোদর মিজান ছিলো অস্ত্রধারী রাজাকার। একাত্তর সালে রাজাকার সাদেক ভৈরবপুর আড়াই বেপারির বাড়ির মমতাজ মিসয়ার তিন ছেলে খুরশিদ, মালেক ও সালেক মিয়াকে মেঘনা রেলব্রীজ সংলগ্ন পাক বাহিনীর টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আড়াই বেপারির বাড়ির সুলতান মিয়ার ছেলে লোকমান, আবু মিয়ার ছেলে মুস্তো মিয়াকে। সেদিন এদেরকে গুলি করে হত্যা করার জন্য রেলব্রীজের পাশের মাঠে দাঁড় করানো হয়েছিলো। ভাগ্যক্রমে মালেক ও সালেক মিয়া সেদিন বেঁচে যায়। বাকিদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। ভৈরবপুর কাদির ব্যাপারি বাড়ির আবৃ মিয়াকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় আলীম সরকার বাড়ির আকতার মিয়া, নোয়াজ মিয়া ও আসাদ মিয়াকে। আকতার ও নেয়াজ মিয়াকে মেরে একসাথে নদীতে ভাসয়ে দেয়া হয়। তিনদিন পর নরসিংদীর রায়পুরা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিলো।
একাত্তরের এই রাজাকার সাদেক হোসেন পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তার দলবল নিয়ে আত্মসমর্পন করে। পাক বাহিনীর সাথে তারও ঠাঁই হয়েছিলো নারায়নগঞ্জ কারাগারে। ১৯৭৫ সালের পর ‘জাগো দলের’ ব্যানারে ভৈরব ফিরে আসে এই রাজাকারের দল। পরবর্তীতে এই দলটি বিলুপ্ত হয় এবং দলের সদস্যরা বিএনপি’তে যোগদান করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এই রাজাকার বিএনপি’র পরিচয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার নামে ভৈরব থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
ভৈরবের গোলাম গাউস এখন পাকি নাগরিক
একাত্তর সালে সে করেনি এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই। নিজেকে সে রাজাকার গোলাম আযমের শিষ্য দাবি করতো সব সময়। তাই হয়তো নাম ছিলো গোলাম গাউস। স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর খানেক পর সে পালিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। কুখ্যাত এই রাজাকার পাকিস্তানের পাঞ্জাবের ২১ নং কালিয়ার শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতো বলে জানা গেছে। তার বাড়ি ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের আদর্শপাড়া গ্রামে। তার পিতা ছিলো রাজাকার কমান্ডার মমতাজ পাগলা। মমতাজ পাগলার পাঁচ পুত্র সবাই ছিলো রাজাকার। গোলাম গাউসের অত্যাচারে অনেকেই সেদিন দেশছাড়া হয়েছিলো, যারা ছিলো তাদের কপালে জুটেছিলো অবর্ণনীয় কষ্ট।
ভৈরব, কুলিয়াচর, বেলাবো, আশুগঞ্জ, নারায়নপুর, বি-বাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শত শত মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে এই রাজাকারের নামে। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে এই রাজাকারকেও আটক করা হয় এবং পিওডব্লিও ধারায় (কেননা তখনও সংবিধান ছিলো না এবং ফৌজদারি আইনের একটি বিকল্প হিসেবে এই ধারটি ব্যবহৃত হতো) তাকে তেজগাঁও থানাতে আনা হয়। কুখ্যাত রাজাকার এই গাউস রাতের আঁধারে ভারতীয় জনৈক ক্যাপ্টেনের পিস্তল চুরি করে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পলাতক থাকার পর ১৯৭২ সালের দিকে চট্টগ্রামে একটি হত্যা মামলায় পুলিশ তাকে আটক করে। তাকে ময়মনসিংহ কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নিজেকে পাকিস্তানি নাগরিক দাবি করে ফৌজদারি অপরাধ এড়িয়ে সে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। পরে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা হিসেবে করাচী, লাহোর, পেশোয়ারসহ পাকিস্তানের বড়ো বড়ো শহরে গোয়েন্দার কাজ করেছে। তার কার্যাবলীতে এমকিউএম নেতৃবৃন্দের সন্দেহ হলে ১৯৯৫ বা ৯৬ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সেই দেশের পাসপোর্ট নিয়ে বাঙলাদেশে চলে আসে।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে এই কুখ্যাত রাজাকার গোলাম গাউস একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করতো বলে গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহ হয়। তাই তারা তাকে গ্রেফতার করে শহরের অভিজাত একটি হোটেলের মদের আসর থেকে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় সবুজবাগ থানায়। মামলার নম্বর ছিলো ৯(১) ২০০১, তারিখ-১২-০১-২০০১, ধারা ১৪৩/১৪৭/৪৪৮/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৬৭/৪৭০/৪৭১/৫০৬/১০৯ দঃ বিঃ।
কুলিয়াচরের নারী নির্যাতনের
হোতা মাহবুব এখন সমাজসেবক
একাত্তরের কুলিয়াচর বাজারসহ আশেপাশের নানা এলাকা লুট করে অত্র এলাকার নারীদের তুলে নিয়ে যায় এই রাজাকার, আল-বদরের পান্ডা। নিজেকে একজন সাচ্চা মুসলমান দাবি করে এই খুনি ধর্ষক সেদিন কুলিয়াচর বাজারে ঘোষণা করেছিলো পাকিস্তানের বিরোধী সব নারীই গনিমতের মাল। তাই এদের উপরে পাকিস্তানি মিলিটারির সব হক। এই কথার প্রেক্ষিতে তার নির্দেশেই সেদিন রাজাকার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেই এলাকার নারীদের উপর। রাজাকার মাহবুব সেদিন রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলো। তার অত্যাচারের কথা শুনলে এখনো মানুষ আতকে উঠে।
স্বাধীনতার পর তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরও মুক্তিযোদ্ধা আফতাব মাতব্বরকে ছুরি মেরে সে পালিয়ে যায়। দীর্ঘ দশ বছর আত্মগোপনে থেকে সে জনসম্মুখে আসে এবং বর্তমানে কুলিয়াচরের শিল্পপতি মুছা মিয়ার কোল্ড স্টোরেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে আছে।
কুখ্যাত রাজাকার হান্নান এখন ঢাকার কোটিপতি শিল্প ব্যবসায়ী
ময়মনসিংহের কুখ্যাত রাজাকার হান্নান এখন ঢাকার কোটিপতি শিল্প ব্যবসায়ী। একাত্তর সালে ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাকে হত্যা করে এই কুখ্যাত নর-খাদক। আতার পরিবার সে হত্যাকা-ের বিচার আজো পায়নি। সে এখন ময়মনসিংহ সদরের বাসিন্দা এবং ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। জাতীয় পার্টির নেতাও বটে। এ রাজাকার ১৯৯৬ সালে ত্রিশাল থেকে জনপ্রতিনিধি হবার নির্বাচনও করে, কিন্তু তার সে খায়েশ পূর্ণ হতে দেয়নি এলাকার জনগণ।
রাজাকার জব্বার এখন ময়মনসিংহের মাদ্রাসা শিক্ষক
ময়মনসিংহের আরেক কুখ্যাত রাজাকারের নাম জব্বার, যে কিনা এখন এক মাদ্রাসার কর্ণধার। একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বিসকা, বাথুয়াদি ও শালিহর এলাকার বহু মানুষকে হত্যা করে। বহু নারীর সম্ভ্রম লুট করে এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার হিন্দু নারী-পুরুষদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে। দেশ স্বাধীনের পর এ রাজাকার কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে ছিলো, কিন্তু পরে ভারতীয় মাদ্রাসার জাল সার্টিফিকেট দিয়ে কিছুদিন নেত্রোকোণার ঝারিয়া মাদ্রাসায় চাকুরি করে এ ঘাতক। এখন সে নিজ এলাকায় সৌদি অর্থে পরিচালিত ডাক্তার আব্দুল্লাহ ওমর নাসিব দাখিল মাদ্রাসার দ্ডমুন্ডের কর্তা।
রাজাকার মতিন এখনো আওয়ামী লীগের নেতা
একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার এখন আওয়ামী লীগেরও কুখ্যাত নেতা। নিজের দলেই তাকে নিয়ে নানা অসন্তোষ। দলীয় নানা কোন্দলও লেগে থাকে এই রাজাকারের জন্যই। সে একবার জনপ্রতিনিধিও হয়েছিলো। তার নাম মতিন (মইত্তা রাজাকার)। তার পিতা আবদুল গণি ছিলো আল-বদর প্রধান। তার ভাইয়েরাও ছিলো রাজাকার। একাত্তরের সতেরো নভেম্বর, সেদিন ছিলো ২৭ রমযান। ভোরবেলায় নান্দাইল উপজেলার আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া চারিআনাপাড়া গ্রামের বাড়িতে বসে কোরান শরীফ পড়ছিলেন। সেই অবস্থায় তাকে হত্যা করে এই রাজাকার মতিন। শহীদের বড়ো ছেলে গাজী আবদুর রউফ এ বিষয়ে থানায় একটি মামলা করেছিলো ১৯৭২ সালে। মামলার তারিখ ছিলো ৩(১) ৭২। একাত্তরের ১৪ নভেম্বর নান্দাইল চারিআনাপাড়া গ্রামের মায়া রাণী চৌধুরীকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে এই রাজাকর মতিন ও তার সহযোগিরা। এ বিষয়েও একটি মামলা দায়ের করা হয় যার নম্বর ছিলো ৮(৪)৭২। একাত্তরের এই কুখ্যাত রাজাকার এখন ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা সে একবার আওয়ামী লীগের লেবেলে নান্দাইল উপজেলার চেয়ারম্যানও হয়েছিলো। নান্দাইল এলাকার মানুষের ক্ষোভ আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে হত্যা করে কীভাবে এই রাজাকার আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে আছে?
নরসিংদীর ঘাতক মতিউর সিকদার এখন আল-খতিব
হাসপাতালের প্রজেক্ট ম্যানেজার
একাত্তরের নরসিংদীর স্বাধীনতাকামী ও সংখ্যালঘুদের হত্যা, নির্যাতন, লুন্ঠনে পাকিস্তানি বাহিনীর ডান হাত ছিলো রাজাকার কমান্ডার মতিউর সিকদার। তার বাড়ি নরসিংদী সদর থানার ঘোড়াদিয়া গ্রামে। পিতা সেকান্দার আলী সিকদার। তার নাম শুনলে সংখ্যালঘু মানুষ আজু আঁতকে উঠে এবং সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার সম্বন্ধে এলাকায় প্রচলিত আছে- পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এই রাজাকার মতিউর সিকদারের হাত থেকে রক্ষা পেতো না কেউ। মুক্তিযোদ্ধা- স্বাধীনতাকামী বা দেশপ্রেমিক মানুষ হত্যার জন্য সে চষে বেড়িয়েছে পুরো নরসিংদী এলাকা। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে আর ক্ষমা নেই। তার হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের কোনো ফিরিস্তি দেয়া সম্ভব নয়, তবুও অত্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জিত কুমার সাহা’র বিবরণ থেকে জানা যায় রাজাকার মতিউর সিকদারের হাতে নিহত মানুষদের কথা।
হরেন্দ্র চন্দ্র সাহা
সুরেন্দ্র রায়
হরলাল সাহা
মুরারী মোহন সাহা
ঠাকুরদাস সাহা
মনমোহন সাহা
দেবেন্দ্রচন্দ্র সাহা
রাধা গোবিন্দ সাহা (এদের সবাইকে শালীধা ব্রীজ এবং নরসিংদী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পিছনের পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়)
এই রাজাকার দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানে চলে যায়। রাজাকার গোলাম আযম যখন এই দেশে ফিরে আসে, তখন তাকেও সঙ্গে করে নিযে আসে। দেশে এসে সে জামায়াত কর্মীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। বর্তমানে ঢাকার ফুয়াদ-আল-খতিব হাসপাতালের সে প্রজেক্ট ম্যানেজার।
(চলবে)