somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বিচার: একটি পর্যালোচনা (পঞ্চম অংশ)

০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাগুরার বিনোদপুর উরুড়ায় লুটপাতের হোতা সালাম মাস্টার আজ সমাজসেবী ১, ২, ৩

মুহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর ও উরুড়া এলাকার কুখ্যাত রাজাকার ও পাকি বাহিনীর দোসর আব্দুস সালাম মাস্টার বর্তমানে সমাজসেবক, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সে ছিলো এ অঞ্চলের আতঙ্ক। একাত্তরের ভয়ঙ্কর রাজাকার সালাম মাস্টারের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে মাগুরা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলাও হয়েছিলো। পরে জামাত সরকার এসে এই মামলা ধামাচাপা দেয়। আবদুস সালামের বিরুদ্ধে তার ভাই আব্দুল মজিদের কাজের মেয়ে চামেলীকে (১৩) ধর্ষণ ও হত্যা করে পুকুরে ফেলে রাখার অভিযোগ রয়েছে। চামেলীর বাবার নাম ওসমান খান, বাড়ি রাজবাড়ি জেলায়। ঝামেলা হতে পারে এই ভয়ে এলাকার লোক সালাম মাস্টার সম্পর্কে মুখ খুলতে চায় না।

জানা গেছে- স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সালাম মাস্টার বিনোদপুরের হরিপদ সাহার বাড়ি লুট ও দখল করেছিলো। একই গ্রামের শচীন্দ্রনাথের বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে নিজের বাড়িতে উঠিয়েছিলো। স্বাধীনতার পরে চাপের মুখে সে অবশ্য এই বিষয় সম্পদ ফেরত দেয়। একাত্তরের রাজাকার সালাম মাস্টারের লুটপাটের খতিয়ান অনেক দীর্ঘ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই রাজাকার এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকদিন আগেও একটি গ্রাম্য সালিশে সে জোর গলায় বলেছে তার বিচার করার মতো অবস্থা বর্তমান সরকারের নেই।

স্থানীয় এক সূত্রে জানা গেছে সে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছে। তার বর্তমান বিষয়-সম্পত্তি প্রচুর। বিএনপি-জামাত জোটামলে সে তার স্কুল থেকে বদলি ও পদন্নোতির নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের কথা। সে জোর গলায় বলেছে- মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো লুটপাট সে করেনি এবং সে যুদ্ধাপরাধী নয় (যেমন করে নিজামী-মুজাহিদরা বলে)। ২০০০ সালে দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত তার সম্বন্ধে এক প্রতিবেদনে প্রথম যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। বিষয়টি নিয়ে কথা তুললে সে জানায়-

‘আমার তো কিছুই হয় নাই, খোঁজ নিয়া দেখেন প্রতিবেদকের কি হাল’।


রাজাকার বিজু এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ১, ৩, ৪

মাগুরায় নৃশংসতার হোতা রেজাউল করিম রিজু এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একাত্তরে মাগুরায় নারী ধর্ষণ, লুটপাট ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সবচেয়ে বড়ো হোতা রাজাকার কমান্ডর রেজাউল করিম রিজু এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬৮ তম সিন্ডিকেটে তাকে সাময়িক বহিস্কার করা হলেও সে এখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন বলে খবর পাওয়া যায়। প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার মানুষ স্কুল শিক্ষিকা লুৎফুল নাহার হেলেনার মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকান্ডের ইতিহাস আজো মানুষ ভুলেনি। সেদিন যে রাজাকারটি অট্টহাসির মধ্য দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে মানুষ, জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম- সেই রাজাকার রিজুই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বনে গেছে।

দেশ স্বাধীন হবার পর এই রাজাকার চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে নাম বদলে ধারণ করে রেজাউল করিম মামুন। এ সময় জামায়াত ইসলামের লোকজন তাকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাসায় লুকিয়ে রাখে, তখন তার নাম হয় কালা মামুন। জিয়াউর রহমান যখন ছাত্রদলকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করে, তখন এই মামুন শিবিরের নানা সমর্থক সরমেয়দের নিয়ে ছাত্রদলে প্রবেশ করে। তখন তাকে জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক নেতা আখ্যা দেয় জিয়াউর রহমান। পরে এরশাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার কাজেও সে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন চট্টগ্রামস্থ ডিজিএফআই এর কর্মকর্তা কর্নেল লস্করের সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রক্ষা করতো বলে জনশ্রুতি আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানেও তার এক কেলেঙ্কারির খবর জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ পাওয়ার জন্য সে এমএ ক্লাশে থিসিস গ্রুপ নেয়। তার থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি নেতা অধ্যাপক এনামুল হক। অভিযোগে রয়েছে, তিনি তাকে সর্বোচ্চ ৭৮ নম্বর দিয়ে প্রথম শ্রেণি পাইয়ে দেয়। এই কুখ্যাত রাজাকারই একাত্তর সালে মাগুরা কলেজের ছাত্র সংসদের মহিলা সম্পাদিকা ও ছাত্র ইউনিয়নের মাগুরা মহকুমা শাখার সহ-সভানেত্রী লুৎফুল নাহার হেলেনাকে হত্যা করে।

রেজাউল করিমের বক্তব্য

ডেটলাইন ১১ জুন, ২০০৯। আমরা মাত্রই পৌঁছালাম চট্টগ্রাম শহরে। বার বার চেষ্টা করার পর টেলিফোন ধরলো রেজাউল করিম। রাজাকার রেজাউল করিম। কিন্তু এই পরিচয় দিলে সে হয়তো সাক্ষাৎকার দিবে না- তাই আমরা ভদ্র আচরণেই সময় নিলাম। বাসায় পৌঁছে দেখা গেলো রাজকীয় ভাবসাব। বাতি, আসবাবপত্র মোজাইক করা মেঝে- কোনো কিছুরই কোনো কমতি নাই। রাজাকার রেজাউল করিমকে যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম তখন তার মেজাজ বিগড়ে গেলো। যাচ্ছে তাই বলে সে তার বক্তব্য শুরু করলো।

“একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার বয়স তখন মাত্র উনিশ। আমার এক ভগ্নিপতি তখন একটি ধর্মীয় মৌলবাদী সংঠন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত খুলনার একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি তখন ওই সংগঠনের বুদ্ধিজীবী নেতা। তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রায়ই অনেক তর্ক বিতর্ক হতো। এক পর্যায়ে আমি তার অপ্রাপ্ত বয়স্কতার কারণে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মৌলবাদী একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। উক্ত মৌলবাদী সংগঠনই আমাকে রাজাকার বানায়। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মধ্যেই রাজাকারদের হাতে আমার ঘনিষ্টতম দুইজন আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটে- এতে আমি মূষড়ে পড়ি। আমার মেজো মামা যশোহর ঝিকরগাছা বদরুদ্দীন মুসলিম হাইস্কুলের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের বড়ো ছেলে আকতার- বয়সে একই জুড়ি হিসেবে তার সঙ্গেই কেটেছে আমার আবাল্য শৈশব। রাজাকার বাহিনীর নানা কার্যকলাপ আমার বিবেককে দংশন করেছে বলে আমি রাজাকার বাহিনী পরিত্যাগ করি। আপনারা বলছেন আমি কমিউনিস্ট নেত্রী হেলেনাকে হত্যা করেছি। কিন্তু আপনারা জানেন না- এই হেলেনা ছিলো নাকশালপন্থী। তাকে আমি হত্যা করিনি, করেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। আমি হত্যা করলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হতো। কই কোনো মামলা তো হয়নি। আমি নিয়মিত মাগুরাতে যাই এবং মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, আপনারা ভাবছেন আমাকে শাঁসাবেন। কিন্তু তা হবে না। এটা মনে রাখবেন”। ৩

ঠিক অনুরূপ একটি বক্তব্য ২০০০ সালের ১১ এপ্রিল দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওই বক্তব্যটির সঙ্গে এর কয়েকটি জায়গায় অমিল আছে- যেমন, প্রকাশিত বক্তব্যে ছিলো তার বয়স এসএসসি’র সার্টিফিকেট অনুযায়ী সতেরো, কিন্তু আমাদের বলেছে উনিশ। আর মাগুরাতে যোগাযোগ করে জানা গেছে সে মাগুরাতে যায় না- বরং মাগুরার অনেক লোকই তার উপর ভংঙ্কর ক্ষুব্ধ।

(চলবে)

তথ্যসূত্র:
১। দৈনিক জনকণ্ঠের মাগুরা সংবাদদাতা সঞ্জয় রায় চৌধুরীর ডায়রি
২। দৈনিক জনকন্ঠ, ২৫-০৪-২০০০
৩। যুদ্ধাপরাধীদের মুখোমুখি (যন্ত্রস্থ) গোলাম রসূল মারুফ
৪। দৈনিক জনকন্ঠ, ১১-০৪-২০০০
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:২৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কবি দাউদ হায়দার আর নেই

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:৪৫






‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’- পংক্তিমালার কবি দাউদ হায়দার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৭৩ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শনিবার রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক... ...বাকিটুকু পড়ুন

অপার্থিব ইচ্ছেরা (তসলিমার “কারো কারো জন্য” থেকে অনুপ্রাণিত)

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৪৬


কেন যে, কেন যে হঠাৎ
কোন নাম না জানা ভোরে
কারো মুখ খুব মনে পড়ে,
মনে পরে অকারণ স্পর্শের,
কাছে বসার এক তিব্র বাসনার।

কতটা পথ, কতটা জীবন বাকি,
তারপরও,
অচেনা হাসি মনে হয় বড্ড চেনা,
অচেনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

---প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৪৫---(কন্যার প্রথম বই এর প্রচ্ছেদ আঁকা)

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৭







আব্বু আমার নতুন রং লাগবে ?


কেন ?

রং শেষ।

আর কিনে দিব না, তুমি শুধু শুধু নষ্ট করো।

আমি শুধু নষ্ট করি ..............। তাহলে এই দেখেন ? অফিস... ...বাকিটুকু পড়ুন

২৬ নিহতের বদলা নিতে ২৬ টি রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৫৪


২৬ টি নতুন রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত। কাশ্মীরে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত ২৬ নাগরিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফ্রান্স থেকে ২৬ টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত। সোমবার এই ক্রয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামে নারীর মর্যাদা (পর্ব :৪)

লিখেছেন আরোগ্য, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩

বিবাহ



বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নারীকে কখনো পশুর পালের সাথে তুলনা করা হত আবার কখনো পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করা হত। যুগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×