১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো একটি অনন্য গ্রন্থ, যার নাম ছিলো “অ্যা ট্রেন অব পাউডার”। বইটির লেখক রেবেকা ওয়েস্ট (এটা তার ছদ্মনাম, আসল নামটি হলো সিসিলি ইসাবেলা ফেয়ারফিল্ড)। এই ইংরেজ সাংবাদিক ও লেখক বইটিতে সাহিত্যের বাতাবরনকে কাটিয়ে মূলত তুলে ধরেছেন একটি বিচারের কথা। বইটি তিনি শেষ করেছিলেন একটি অসম্পূর্ণ উক্তি দিয়ে। “Finally this historic judgment found the shadow of ‘Humanity’ as The Honorable Court.. ..”। অনেক সমালোচনাতেই তার এ অসম্পূর্ণ উক্তিটি নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছিলো। রেবেকা সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক দর্শন বিষয়ক পত্রিকা ‘দ্যা ফিলোনিউজ’- এ প্রকাশিত জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর তৎকালীন সম্পাদক উইলিয়াম শরের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, “Judgment yet search for the shadow of ‘Humanity’; so The Honorable Court will have to face a lot of judgment, in all times, in all countries”। রেবেকার কথাটি যে কতো সত্য তা বুঝতে হলে চোখ ফেরাতে হবে বাঙলাদেশে, যেখানে স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি। ফলে “অ্যা ট্রেন অব পাউডার” গ্রন্থে ব্যবহার করা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের একটি উক্তির অসম্পূর্ণ রূপে যে বেদনা প্রগাঢ় হয়েছে, তা যেনো বাঙালির হৃদয়ের এলিজি।
সম্প্রতি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করেছে এবং সে কমিশন কাজও করছে বহুদিন ধরে। এগিয়েছেও কাজ, ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে শীর্ষ কয় যুদ্ধাপরাধীদের। বিভিন্ন সংগঠন এ কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে কমিশনকে বিভিন্ন উপাত্ত ও তথ্য দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। কিন্তু সময় যতোই গড়াচ্ছে, ভাবনা ততোই বাড়ছে; তাছাড়া জামায়াতের কীটরাও থেমে নেই- কামড় বসাচ্ছে, বিষ ছড়াচ্ছে। আমি তো এখনো ভুলতে পারি না যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম কীভাবে তার দিগন্ত টেলিভিশন রেখে, অন্য দিগন্তে পাড়ি জমালো, সারমেয় সাকা কদিন আগেও তার পরমেয় ফঁকা বুলি ছুড়ে দিচ্ছিলো- তাতে বোঝা যায় জন্তুকুলের মাঝে বেশ একটা নাড়া পড়েছে। আবার একটা আশঙ্কাও রয়ে যাচ্ছে। সরকার যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বদ্ধ পরিকর বলে নিজেদের দাবি করছেন, কিন্তু দাবির যেনো কোথায় একটা খামতি আছে। জনগণের একটা বিরাট অংশ তাদের এ ‘বদ্ধ পরিকর’ কে ‘বদ্ধ পরিকল্পনার আকর’ বলে গণ্য করতে চাইছে। অবশ্য জনগণেরও দোষ নেই; কারণ শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে দুর্বার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো, তাতে বিচার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার একটি বড়ো সুযোগ ছিলো। কিন্তু ৯৬ পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সুযোগটি নষ্ট করা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে জামায়াত ইসলামের সারমেয়রা আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রবেশ করেছিলো। পাঠক লজ্জিত হোন, আমি আপনি আমরা এই তো কিছুদিন আগেও এ সারমেয়দের নেতৃত্ব মেনেই দেশে ছিলাম।
এখন প্রশ্ন হলো, বিচারটি হবে কিনা; আর সেটা কবে, কতোদিন পরে? আর যদি বিচার শুরু হয়, তবে সেটা কোথা থেকে, কাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে সূচিত হবে- এ প্রশ্নের উত্তরগুলো জানা দরকার।
আমার এ লেখাটিতে আমি চেষ্টা করবো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি নিয়ে এবং কয়েকটি দিকের ও কয়েক প্রকারের ‘না-ছোঁয়া, না-ধরা’ যুদ্ধাপরাধীদের পরিচয় তুলে ধরতে। বিষয়টি কতোটা সাধ্যের মধ্যে তা জানিনে, তবে আয়ত্ত্বের বাইরে নয়, এইটে বুঝতে পারছি। কারণ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে করা অপরাধের অপরাধীরা এখনো বহাল তবিয়তে বসে আছে, আবার কারো কারো নামে নামকরণ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা জরুরি। আশা করছি এ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবো- এবং তুলে ধরতে পারবো মানবতা বিরোধী অপরাধে অপরাধীদের মধ্য থেকে কয়েকজনের চিত্র। শুরুটা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে। সেই পর্যন্ত পাঠকবৃন্দকে ধন্যবাদ।
(চলবে)
গোলাম রসূল মারুফ