শিশুর জন্য সবচেয়ে বড়ো উপহারটি হলো তার ভাষা। জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে সে শিখে নেয় তার ভাষা। এ ভাষা তাকে মনের ভাব বিনিময়সহ সকল কাজেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তোলে। বাঙলাই হলো সেই ভাষা, যা বুকের রক্তে অর্জিত হয়েছে, ঠাঁই করে নিয়েছে হৃদতন্ত্রে, যেনো বুকের মধ্যে প্রবহমান তিতাস নদী। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল একটি দিন কিংবা দিবসের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি জাতির রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে যেমন অনিবার্য বিষয় তেমনি ভাষা আন্দোলনের সামগ্রিকতাকে ধারণ করে নির্মিত সেই জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনেরও তীর্থবিন্দু। তাই আজ প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পর বাঙলাভাষার বিস্তার কিংবা মর্যাদা প্রশ্নে আমরা কতোদূর এগিয়েছি, এটা আলোচনার বিষয়। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক নিবিড়তায় আচ্ছন্ন হয়, যখন তার মাধ্যম হয়ে উঠে মাতৃভাষা। কিন্তু এ পথে আমরা কতোদূর হেঁটেছি? বর্তমানের শিশুরা কী মাতৃভাষার সেই অনন্যতায় ঋদ্ধ হয়? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সময়কাল ১৯৫২। একুশে ফেব্রুয়ারি। আমেনা ফেরদৌসি ছিলেন বাঙলার এক গ্রাম্য গৃহবধূ। তার ছেলে ১৯৫০ সালে ভর্তি হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। তারপর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় সে। আমেনা ফেরদৌসি রাজনীতির কিছুই বোঝেন না, কিন্তু শেষবার ছেলে যখন মাকে বুঝিয়ে বলেছিলো, ‘মায়ের ভাষার আন্দোলন’- তখন তিনিও যেনো সে আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠেন। ছেলেকে অনুপ্রাণিত করেন ভাষার জন্য লড়াই করতে।
বায়ান্ন আমাদের ইতিহাসে উত্তরাকাশের নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে একটি অধ্যায়। এ সময় বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছিলো মায়ের ভাষার জন্য সে কীভাবে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে পারে। আজ সময় গড়িয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। এরই মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু আমরা নিজেরা আমাদের মায়ের ভাষাকে কতোটুকু মূল্যায়ন করতে শিখেছি? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো এমন এক ধারার ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়, যার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কিংবা তাল মেলানো কোনোটাই খুব একটা সহজ নয়। তাছাড়া প্রতিনিয়ত আমাদের সামগ্রিকতায় আমাদের ভাষার এক অচেনা রূপ চোখে পড়ছে। এ যেনো আমাদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দিযেছে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে এখনো খুব একটা সোচ্চার নই আমরা। এ কথা বলাই যায় যে, মায়ের ভাষার মান রক্ষায় সেদিন যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিলো বীর বাঙলিরা, যে অনুপ্রেরণায় ভেঙেছিলো ১৪৪ ধারা আজ তা আবারও জেগে উঠবে। কারণ মায়ের ভাষাই যে আমাদের সকল শুভ কাজের সূচনা, অনন্ত পথযাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।
সম্পর্ক: মা ও মাতৃভাষা
মায়ের ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিলে নেমেছিলো বাঙলার সন্তানেরা, আর সেই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ, শহিদ হন রফিক, সালাম, বরকত ও আরো অনেকে। এরপর আন্দোলন আরো তীব্র হয়, একে একে দানা বাঁধতে থাকে স্বাধীকারের স্বপ্নœ| সেদিন মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিযেছিলো বাঙালি জাতি। তারপরও এ ভাষা নিয়ে নানা রকম ছল-চাতুরি করেছে পাকিস্তানি সরকার। অবশেষে মুক্ত বাঙলায় ১৯৭২ এর সংবিধানে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা করা হয় বাঙলা। এই হলো বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এর অনেক আগে থেকেই বাঙালির প্রাণের গভীরে স্পন্দিত হয়ে আসছিলো এ ভাষা। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত স্বপ্ন বারবার চোখ মেলেছিলো এ ভাষার অনন্য দৃশ্যপটে। সে অর্থে বাঙলাভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক আগে থেকেই, যেনো প্রাচীণ পুরাণের ইতিকথা। নৃবিজ্ঞানের ভাষাতে, একটি জাতি তার সার্বিক সত্তাকে খুঁজে পায় তার নিজের ভাষার মাঝে। মায়ের ভাষাতেই তার পরিপূর্ণ প্রকাশ। সে অর্থে বাঙালি জাতির এ অনন্য-সাধারণ ইতিহাস আর গভীরে প্রোথিত মূল্যবোধের প্রকাশ মূলত তার ভাষার সৌন্দর্যবোধকে ঘিরেই আবর্তিত। অন্যদিকে মনস্তাত্তিকগণের বক্তব্য, শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ নির্ধারিত হয় তার মায়ের ভাষার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার উপর। যে শিশু মায়ের ভাষার যতো কাছাকাছি থাকবে, তার সঙ্গে ভাষার আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ততো বেশি ক্রিয়াশীল হবে। আর যেহেতু এ ভাষাই তার আত্মজ, তাই অবচেতনেই এ ভাষায় শিশু হয়ে উঠে দক্ষ। তাই মায়ের ভাষার সঙ্গেই শিশুর প্রথম প্রেম, তাকে নিয়ে শব্দ শব্দ খেলার আনন্দ। কিন্তু এ আনন্দ এখন সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষক রেবেকা হাসানের সঙ্গে। তিনি বললেন, উচ্চশিক্ষার মাধ্যমটি ইংরেজি, তাই অনেক বাবা মা চান তাদের সন্তান ছেলেবেলা থেকেই ভাষাটি শিখে বড়ো হোক। তাছাড়া বাঙলা যেহেতু মায়ের ভাষা, এ ভাষা তো শিশু এমনিতেই শিখে ফেলে। তাই এখন বাবা মায়েরা ইংরেজি ভাষার দিকে ঝুঁকছেন। এ কথাগুলোর সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত হবেন এ অর্থে যে, পরিস্থিতি বাবা মাকে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবাচ্ছে।
ভাষাশিক্ষা: মেনে নেয়া আর মনে নেয়া
ভাষাশিক্ষা যে কোনো বিচারেই একটি অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন কাজ। বর্তমান সময়ের কথা বাদ দিলেও, বিভিন্ন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে নিজেকে পরিপূর্ণ করে তোলার একটি প্রয়াস পাওয়া যায়। সে অর্থে বিশেষ ভাষার প্রতি অনুরক্ততা থাকা কিংবা কোনো বিশেষ ভাষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে থাকা যেতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিষয়টি কীভাবে হতে পারে? “আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, পরে বিদেশি ভাষার পত্তন”- নিজের মায়ের ভাষার যে সৌন্দর্যবোধ তাতে মুগ্ধ হবার বিষয়টি আগে। কারণ নিজের সংস্কৃতির যে আলো, যে আলোয় শিশু তার জগতটাকে দেখে স্বপ্নালোকিতো কাঠের দোলনাতে, যে ভাষায় আমি আমার মাকে সম্বোধনে অভ্যস্ত- নিশ্চয়ই সে ভাষার সঙ্গে আমার ওতপ্রতো সম্পৃক্ততার দোলায় আলোড়িত হবে আমার ভেতরের জগত, এটাই স্বাভাবিক। যখন মায়ের ভাষার সবটুকুতে চোখ পড়বে, তখন সত্যি বলতে তা চোখের দেখা হবে না, হবে মনের দেখা। আর মনের চোখ একবার খুলে গেলে, তাতে ভালোমন্দের পার্থক্য বোঝা যায়। তখন আমাদের শিশুরাই বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনকে রোধ করতে পারবে। মাতৃভাষা যখন আলোকিত করে, তখন মনের মহলকে আলোকিত; আর বিদেশি ভাষার রোদ চোখের বারান্দায় রৌদ্রস্নান করায়। মায়ের ভাষা মনে ধরে, বিদেশী ভাষাকে মেনে নিতে হয় সারাক্ষণ।
শিক্ষাব্যবস্থা: মায়ের দরদ নাকি মাসীর দরদ
আজকাল অনেকেই উচ্চশিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে বলছেন, বাঙলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করাতো সম্ভব নয়। বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেনো এ কথায় সুর তুলছেন আরো জোরে। তাদের জন্য পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বসুর একটি কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছি ‘যে বলে বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়, সে হয় বাঙলা জানেনা, নতুবা বিজ্ঞান জানেনা’। আসলে হয়েছে ও তাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন বাঙলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছেনা, এ না হবার পেছনে যে কারণ তা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ছিলো না। এটা এ জন্য নয় যে তখন সময়টা ছিলো পেছনে, এর কারণ হলো আমরা এখন মায়ের চেয়ে মাসীকেই বেশি দরদ দিয়ে যাচ্ছি। মাসীকেও সম্মান দিতে হয়; কিন্তু আগে তো মায়ের সম্মানকে পরিপূর্ণ করতে হবে। এ বিষয়কে সরকারকেও উদ্যোগ নিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে বাঙলা পড়ানোর আবশ্যিকতা থাকতে হবে, বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতিকে মূল্যায়ন ও তা ধারণ করার চেতনায় জাগ্রত হতে হবে। আমি খুব ভালো করেই জানি, বিষয়গুলো চাপিয়ে দেবার নয়, তারপরও সত্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছিতো আমরা, তাই এবার অর্ধচন্দ্র দিয়ে আবার সত্যের রাস্তায় তুলে না দিলে তো আর চলে না। আর এ বিষয়ে মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মায়ের কোলই হলো শিশুর প্রথম পাঠশালা।
আদিবাসী ভাষা; আদিবাসী মা
আমাদের ভাষার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র ছিলো সেই ৪৭ পরবর্তী সময় থেকে, তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই ছিলো ইতিহাসের এক চিরন্তন আলো। কিন্তু আজ এতো বছর পর আমরা কী সেই একই ধরণের বৈষম্যের মুখোমখি করছি না আদিবাসী বাঙালিদের? তাদের নিজস্ব যে ভাষা, সে ভাষা এখন হারানো বাতাসে বাজে। সেই মায়েদের শিশুরা আজ আর মায়ের ভাষায় মাকে ডাকতে পারেনা। ফলে ভাষার সম্মান আর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিজয়ী জাতি কী আজ আবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে না? আমাদের আদিবাসী ভাষাগুলো আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। সাঁওতালি, মারমা, ককবরকসহ অনেক ভাষাই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এ ভাষা রক্ষার লড়াইয়ে চাই নতুন ভাষা আন্দোলন।
অস্থির দৃশ্যপট
বর্তমান সময়ে বিরাজ করছে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার, যা আমাদের ভাষার পথে সৃষ্টি করেছে নানা নৈরাজ্য। এ নৈরাজ্যের কারণে ধ্বংস হচ্ছে আমাদের শিশুদের সুপ্ত মনের সাংস্কৃতিক ভাবনাগুলো। বর্তমানে গণমাধ্যম জুড়ে ভাষার যে দীনতা প্রকাশ পাচ্ছে, ভাষাকে বিকৃত করে যেভাবে চারপাশকে নষ্ট করে তুলছে ভুঁইফোড় নির্মাতা, গীতিকার ও অন্যান্যরা- তাতে প্রকাশ্য প্রতিবাদ প্রয়োজন। আর এ প্রতিবাদের সূচনা করতে পারেন মায়েরাই। মায়েদের হাত ধরেই এ অস্থির সময়ের বিকৃত উল্লাসকে আমরা পায়ে মাড়িয়ে যেতে পারবো। শিশুর সংস্কৃতির ভূমিকা যেহেতু মায়ের কণ্ঠস্বর, তাই মায়ের ভাষাতেই মা শেখাবেন এর প্রতিবাদে উচ্চারিত শব্দাবলী।
মা, আমি বাঙলায় কথা বলবোই
বাঙলা আমার জীবনানন্দ, বাঙলা প্রাণের সুর- প্রতুলের এ গান তো আমরা আমাদের মায়ের কণ্ঠেই শুনেছি, ধারণ করেছি। বর্তমানে মাতৃভাষার সত্য আলো থেকে আমাদের যে বিমুখতা তার সমাধান একমাত্র মায়েরাই দিতে পারেন। কারণ মা-ই হলেন সন্তানের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু, মা-ই সন্তানের আত্মজ প্রতিবিম্ব। তাই মায়েদের সাংস্কৃতিক বোধের নিরন্তন আলোয় আলোকিত হবো আমরা, মায়ের ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক যেভাবে আত্মদান করেছেন, তেমনি আত্মদানে আমরাও হবো ইতিহাস।
লেখাটি শুরু করেছিলাম মা আমেনা ফেরদৌসির কথা দিয়ে, যিনি সন্তানের মাঝে সঞ্চার করেছিলেন মায়ের ভাষার মান রক্ষার দৃপ্ত শপথের ভাস্বরতা।| আজো সেই মায়েদের ত্যাগেই আমরা এগিয়ে চলছি সামনের দিকে। প্রতিদিনের ভিড় ঠেলে যে মা তাঁর ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে আসেন একুশের বইমেলাতে, সুদূর কোনো নিভৃত পল্লীর যে মা তাঁর সন্তানকে পাঠিয়েছেন বাঙলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য- আজ সেই মায়েদের জন্য রইলো প্রাণের নৈবেদ্য।‘মা’- ছোট্ট এ শব্দটির ভেতরেই চির প্রবহমান সকল উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অনুপ্রাস। এ মায়েদের আশীর্বাদেই আমরা জয় করেছি ৫২, ৬৯ আর ৭১ সহ সকল সময়ের শুভবোধকে। লেখাটি শেষ করবো অমর সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের মায়ের কথাটি বলে। তাঁর দুর্বার আর দৃঢ়চেতা মূর্তি পৃথিবীর সমস্ত দেশের মায়েদেরই প্রতিমূর্তি। আমরা আমাদের প্রাণের বাঙলা ভাষাকে মাথার তাজ করে রাখতে চাই- প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিদিনের ভালোবাসায়। মায়ের একটু ভাবনায় আমাদের এ ইচ্ছেতে সঞ্চারিত হয় অযুত অনুপ্রেরণা। বাঙলার শাশ্বত মায়েদের কাছে আমরা সন্তানেরা এতোটুকু প্রত্যাশা তো করতেই পারি।
(লেখাটি 20 ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের ‘মহিলা অঙ্গন’ পাতায় প্রকাশিত হযেছে।)