পাপড়ি রহমান/
চাউলের দাম বাড়ল ধাই ধাই করে। শনের চালায় আগুন লাগলে পলকে যেমন আসমানে উঠে যায়- চাউলের দাম ঠিক সেইভাবে নাগালের বাইরে চলে গেল! ২৫ টাকা, ৩৫ টাকা করে যখন ৪০ টাকাও ছাড়িয়ে গেল-আকালু তখন নিজের পেটটাকেই দেখছে। পেট আর পিঠ চিমসে থাকা গতরে আলাদা করে পেট দেখারই বা কি আছে? পিঠ দেখারই বা কি আছে? আকালু তবু দেখল। মন দিয়ে দেখল- চামড়া একেবারে ঝুলঝুলা হয়ে পেটের ভিতরে ঢুকে গেছে। ফলে ওই চামড়ার নিচে নাড়িভূড়ি আছে কি নেই ঠাহর করা যায় না! পেটটা অতি ভেতরে ঢুকে খাদ বানিয়ে দেয়ার ফলে পাঁজরের হাড়ের এক্কেবারে হা-করা দশা। যা খেঁজুর গাছের ছেঁটে ফেলা ডালের মতো পীড়াদায়কভাবে দৃশ্যমান। আকালুর অবশ্য ওইসব হাড়-গোড়ের দিকে নজর নাই। আকালু ভেবে দেখেছে ওই কাটা ডাইলের মতো হাড়-গোড় মাইনষের তেমন কোনো কাজে লাগে না। আসল কাজে লাগে হইলো মাইনষের প্যাট। এই প্যাট হইলো গিয়া বস্তার মতো। ফাইসা যাওনের ভয় নাই। ছিঁড়া যাওনের ভয় নাই। এই যে ঝুলঝুলা চামড়ার বস্তা- এরই মইদ্যে থাকে মাইনষের জেবন। এই বস্তার ভিতর কিছু না দিলে বাঁচন অসম্ভব। ঝুলঝুলা চামড়ার বস্তাখানাও বাপু একেবারে রাক্ষুসীর হায়ের মতো। এই হায়ের ভিতর যা ঠেলবা সব-ই সাবাড় হয়া যাবে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বা কিছুই আস্ত থাকবে না। এই বস্তার ভেতরে হান্ধানো মাত্রই হাপিস হয়া যাবে। তা চাউলের দাম ৪০ টাকা হওয়া মাত্রই আকালু ঘন-ঘন নিজের পেটের দিকে তাকিয়েছে এবং ওই তাকানো পর্যন্ত। কোনো কুল কিনারা সে পায় নাই। আকালু উদ্দিশ করতে পারে নাই খিদা লাগলে না খেয়ে পেটের জ্বলুনি থামানোর উপায় কি? নিজের পেটে সে যতবার দৃষ্টি ফেলেছে গনজেরা বেগমের পেটে ফেলেছে তার চেয়েও বেশি। বেশি মানে ঢের গুণ বেশি! অবশ্য এর কারণও আছে গনজেরার পেট আকালুর পেটের মতো পিঠের সঙ্গে সেঁটে বসে নাই। উল্টা গনজোরার পেট ফুলে উঠে ছোটমোট কাঁঠালের আকৃতি পেয়েছে। আকালু জানে না ওই কাঁঠাল-সদৃশ পেটের ভাও-ভুও কি! তবুও নিজের পেটের চেয়ে গনজেরার পেটের জন্যই আকালু বেশি চিন্তিত হয়েছে। যদিও গনজেরার এই কাঁঠাল-পেট নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও দুই-কি তিনবার তার পেট এরকম ফুলে উঠেছিল। কিন্তু ওই ফুলে ওঠাই সার-তা কোনো অর্থ হয়ে ওঠে নাই। গনজেরার পেটের কোনো পুতলা বেঁচে থাকে নাই। এইসব হইলো গত চাইর-পাঁচ বৎসরের ঘটনা। কিন্তু এইবার গনজেরার পেট কাঁঠাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা বিষয় আকালু কে ধান্ধায় ফেলে দিয়েছে-গনজেরার পেট যত ফুলে উঠেছে চাউলের দামও যেন সমান তালে বেড়েছে!
আকালুর বালক বয়সের কথা মনে পড়ে-মাছ ধরার সময় দুই-একটা ট্যাপট্যাপি মাছ পেলে কি উল্লসিতই না তারা হতো। ওই ট্যাপট্যাপির লেজ ধরে মাথাটা উল্টা করে ঝুলালেই হাওয়া ঢুকে পেটটা ফাটো-ফাটো হয়ে ফুলে উঠতো-গনজেরার পেটের ফুলে উঠাটাও এখন তেমন। আকালু অবশ্য এইরকম ভেবে সামান্য ভয়ও খেয়েছে।
মথুরাপুরে কোনদিনই পুকুর-ডোবার কমতি ছিল না। আর আকালুরও ছিল প্রচণ্ড মাছ-মারার নেশা। প্যালাজাল, ঝাঁকিজাল, খুয়াজাল ঝাপ্পুর-ঝপ্পুর জলে নামালেই মাছ সে পেতই। পুটি-ট্যাংরা, মলা-চাপিলার সঙ্গে শ্যাওলা-পঁচা রঙের ট্যাপট্যাপি মাছও উঠতো চাইর-পাঁচখান। কৈবর্ত্য পাড়ার দস্যি বালকেরা ট্যাপট্যাপিকে বলতো পটকামাছ। পটকা হোক-আর ট্যাপট্যাপিই হোক-একজন একেকটা মাছের লেজ ধরে ঝুলাতো আর সমস্বরে শোলোক বলতো-
ট্যাপট্যাপি ঝিঙ্গার বিচি
ট্যাপট্যাপি ঝিঙ্গার বিচি...
শোলোক বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওই মাছের পেট ফুলে ঢোল হয়ে উঠতো। এক আশ্চয্যি কারবার! কেন এমন হতো সে রহস্য আজো অজানা। তবে ট্যাপট্যাপির পেট ফুলে ওঠা মাত্রই আকালু বাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে মারতো এক লাত্থি। ফট্টাস করে মাছের পেট যেত ফেটে। ওই ফট্টাশ শব্দের সঙ্গে বালকদের আনন্দ একাকার হয়ে যেত। কেন এই রকম নৃশংস ঘটনায় তারা আনন্দিত হতো সে রহস্য আজো রহস্যই হয়ে আছে। তবে চাউলের দাম বাড়া আর গনজেরার পেট ফুলে ওঠা সমান তালে চললে আকালুর কোনোদিন ওইরকম ইচ্ছা হয় নাই তা নিশ্চিত বলা যায় না। হলেও আকালু নিজেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে-
‘এইডা কিমুন ঘটনা-গনজেরার প্যাট আর ট্যাপট্যাপির প্যাট কি হমান হইলো নিহি?’
আকালু কখনো অন্যমনে ভেবেছে-
‘গনজেরা বেগমের একডা ল্যাজ থাকলে জব্বর হইতো। ওই ল্যাজ ধইরা দুই দিহে দুলাইয়া দেহন যাইতো হের পেডডা আর কত্তখানি ফুইল্যা ওড়ে।’
গনজেরা বেগমের সঙ্গে ভাত খেতে বসে আকালুর এই ইচ্ছা আরো তীব্র হয়েছে-
‘ই-মাগো গনজেরা বেগম এতডি কইরা ভাত খায়! এতডি! আর হের পেডডা এত্ত ফুইল্যা ওডে!’
চাউলের দাম বাড়ার আগে আকালু কিন্তু এভাবে ভাবে নাই। কিন্তু গনজেরার ফোলা পেট দেখে ইদানীং এমন ভাবনা হয়। আকালু দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিজেকে গালমন্দ করে। কিন্তু ভাবনাটা ঘুরে-ফিরেই মনে আসে-
‘ইশ-শি রে গনজেরা বেগমের যুদি একখানা ল্যাজ থাকতো।
ল্যাজ থাকলেই কি সে গনজেরা বেগমকে ল্যাজ ধরে ঘুরাতে পারতো? এমুন লাশভারি মানুষটারে ল্যাজ ধইরা ঘুরানো কি চাট্টিখানি কথা! আকালু তাও ভাবে-না হয় গনজেরা বেগমরে ল্যাজ ধইরা ঘুরাইলো আর তার পেডডাও ট্যাপট্যাপির মতো ফুইল্যা উডলো। ফুইল্যা উডলেই বাম পায়ের গোড়ালি দিয়া মারমু একটা যাতা? না-এখানে এসে আকালুর অস্বস্তি হয়-গনজেরা বেগম না হয় গোড়ালির লাত্থি একখানা খাইল-তারপরে কি হেয় বাঁইচ্যা থাকবো? কিংবা হের পেডের ছাওয়ালডা? এমন ভাবনায় কাজ হয় না। বরং গনজেরার ভাত বেশি খাওয়া নিয়ে বিরক্তি দিন কে দিন বেড়ে চলে-
‘ই-মা-রে কেমতে খায় এত্তগুলান ভাত? মাছ-গোশতের সালুন অইলেও না হয় কতা আছিল! হুদা মরিচ ডলা দিয়া এতডি ভাত কেমতে খায় মানু?’
অবশ্য আকালু অন্যকিছু যে ভাবে না তেমনও নয়। বরঞ্চ এমন ভেবেও সে বেদিশ হয়-
‘বউডার পেড ভরানো ভাতের বন্দোবস্ত করাই এমন কঠিন হয়া গেল! হের উপুর পেডের ওই কাঁডালের পোডলাডা? হের খাওন যুগার করাই নাগে। আর হেগো ভাবাভাবির মইদ্যে নিজের পেডডারেও কাট্যা ফেল্যা দেওন যাবো না?’
নিজের ভাবনা বাদ দেবে এমুন মানুষ আকালু না। তবে গনজেরা আর প্যাটের ছাওয়ালডার ভাবনা তাকে উদভ্রান্ত করে! পথে-ঘাটে, চলতে-ফিরতে অথবা টেলিভিশনের পর্দায় কি আকালু দেখে নাই-
‘পোয়াতি বেডিনগরে দুই ডাবল খাওনের ব্যবস্তা করণ নাগে।’
এতসব জেনেই বা আকালু কি করতে পারে? মঙ্গা সামলানোর কোনো উপায় তার জানা নাই। মথুরাপুর থেকে মঙ্গার তাড়া খেয়েই সে ঢাকা শহরে পা রেখেছে। এই শহরে যখন সে আসে তখন থাকার মধ্যে ছিল পেট। নিজের পেট আর গনজেরার ফুলে ওঠা পেট! এই দুই পেট নিয়া ধান্ধাবাজগো শহরে আকালু কিছু কি করতে পারলো? পারলো না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল-চাউলের দাম তড়াক করে দিল লাফ আর গনজেরা বেগমের পেটখানাও ট্যাপট্যাপি মাছের মতো ফুলে ওঠলো! এক্কেবারে ফাটো ফাটো হয়ে ফুলে ওঠা।
সস্তা খুঁজতে খুঁজতে বেড়িবাঁধের কিনার ঘেষে একখানা ডেরা আকালু পেলেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। মহাজনের রিকশা খেপ মারার জন্য নিলেও সুবিধা নাই। মহাজনের জমা ৬০-৭০ ট্যাকা তাকে প্যাডেল মেরেই তুলতে হয়। তারপর বাদ-বাকি খরচাও দুই পায়েই যোগাড় করতে হয়। মহাজনই যদি ৬০-৭০ ট্যাকা খায় তাইলে গনজেরা বেগম খায় কি?
তার ফুলে ওঠা পেটখানাই বা খায় কি? এইসব যন্ত্রণার কথা আকালু কাউরে বলতে পারে না।
ডাইলের কেজি ১১০ ট্যাকা। তেলের মইদ্যে আগুন ধরা বহুকাল। সে মহাজনের পকেট ভরাবে নাকি গনজেরা বেগমের পেট? আকালু গনজেরার পেট দূরে থাক চক্ষের দিকেও তাকাতে পারে না। আধপেটা খেয়ে খেয়ে গনজেরা বেগমও কিমুন বেদিশ হয়ে উঠেছে। পেটে ভাত না থাকলে কি হায়া-শরমও খায়া ফেলতে হবে? হতে পারে আকালু তার নিকাহর সোয়ামি-তাই বলে এমুনই নিলাজ হয়া ঘুরা ফিরা করতে হবে? পেটটা কাঁঠালের মতো উঁচা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বুক দুইটাও মারাত্মক ভর-ভরন্ত হয়ে উঠেছে। সে দুইটা ঢেকেঢুকে রাখার কোনো নাম-গন্ধ নাই। গনজেরা বেগম দুই পা দুইদিকে ছড়িয়ে ঘরের পৈঠায় এমন ভাবে বসে থাকে-আকালু সোয়ামি হয়েও লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। পেটের ভাত যোগাড়ের চিন্তা মাথায় তুলে আকালু একদিন প্রচণ্ড রেগে ওঠে-
‘গনজেরা বেগম ঢাকা শহরত আইস্যা তুমার য্যান মতিত দুষ হয়্যা গেল।’
আকালুর চড়া স্বর শুনে গনজেরা চক্ষু বড় বড় করে তাকিয়েছে। মিনসা ফির কিয়ের তাল তুলতাছে! ধরতে না পেরে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে-
‘কিবা কতা কন এমতে ধরবার পারি না মোডে।’
আকালু স্পষ্ট করে বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে।
তবু বলেছে-
‘না কই কি এই ঘর-ওই ঘরে কত বেগানা মরদ থাহে-মাইয়ানুকের কি একডু ঢাইক্যা-ঢুইক্যা চলন উচিত না?’
‘এ মাগো-মরার মিনসার দেহি বোল ফুটছে! শহরে আইস্যা কি বাবুয়ানা শিখ্যা ফেলালেন নাহি?’
শুনে আকালু ভয়ানক চিৎকার করে উঠেছে-
‘এত কতা কস ক্যান অ্যাঁ? যা কই হুনলে কি তর গতরে ফুস্কা ওডে?’
কি যে দেহে মরার মিনসা! কিয়ের মইদ্যে কি কয়্যা ফেলায়? ঢাকা শহরের বিবিসাবগো দেইখ্যা কি চক্ষে গুলমাল পাকাইয়া গেল? এহানের বিবিসাবরা কি ঢক-পদে চলে নাহি? বুক-বগল উদলা কইরা, উচা-জুতা পিন্ধা, আদপ-লেহাজ মাড়াইয়া চলে। আর আকালু কিনা গনজেরা বেগমরে আদপে চলতে কয়! গনজেরা কি দেখে নাই-ডেনাকাটা বেলাকুচ পিন্ধা কেমতে ঘুরাফিরা করে বেডিনহগল। ডেনার তলের বালের জঙ্গলও কেউ কেউ সাফা করে না! আরে গনজেরা কি হেইরহম চলে নাহি? নিজের পুরুষে তারে ঢাইক্যা চলনের কতা কয়? পেড বাজলে মাগীগো গতরে ভাঁপ-তাপ বেশি ওডে হেইডা মিনসা জানে না?
গনজেরা রাগে ফোঁস ফোঁস করে আর শাড়ির আঁচল টেনেটুনে গতর ঢাকে। এতে পেটের ঢিবিটা আরো স্পষ্ট হয়। আকালুর অস্বস্তি বাড়ে। পেটের উপর টান করা শাড়ি সামান্য নড়াচড়াতেই সরে যায়। তাতে গনজেরার ফর্সা-ফ্যাকাশে বেঢপ পেটটা স্পষ্ট দেখা যায়। আকালু সাবধান হয়-না কিছুতেই সে পেটের দিকে তাকাবে না। কিন্তু ভুলোমনেই বার বার ওই দিকে দৃষ্টি চলে যায়। আর আকালু তক্ষুণি ট্যাপট্যাপির ফুলে ওঠা পেট দেখতে পায়। ফুলা-ফ্যাকাশে-ফর্সা-ফর্সা পেট-আর পিঠটা কালচে সবুজ ধরনের। গনজেরার পিঠও কালচে সবুজ। আর অতিরিক্ত ফুলে ওঠার কারণেই হয়তো পেটটা আরো ফর্সা দেখায়। আর এইডা কিমুন আশ্চয্যি কারবার-হের পেডের জ্যান্ত কাঁডাল-হেইডাও কি খাওন পাইলে ফুইলা ওডে নাহি? আকালুর ঝট করে মনে পড়ে-চাইলের কেজি ৪০ ট্যাকা! গনজেরা বেগম এহনো বেহুশের মতো ভাত গিলে ক্যান? দিনমান ঝুমুত-ঝুমুত করে রিকশা টেনেও সে ভরপেট ভাত যোগাড় করতে পারে না!
ওইদিনই রাতে ঘুম অথবা স্বপ্নে আকালু গনজেরার ফুলে ওঠা পেটটাই দেখে। এইডা কি রোগের মত অইয়া গেল নাহি? আকালু ঘুমঘোরে অথবা স্বপ্নের ভিতর বুঝতে পারে না-
‘এইডা কি-গনজেরা বেগমের পেড নাহি ট্যাপট্যাপি মাছের পেড? দিমু নাহি বাম পায়ের গোড়ালি দিয়া জোরসে একখানা যাতা-পেডখানা ফট্টাশ কইরা ফাইট্টা যাউক।’
আকালু কি জেগে ছিল, নাকি ঘুম অথবা স্বপ্নে ছিল-না বুঝেই ধড়ফড় করে উঠে বসে। ঘুটঘুটে আন্ধারে কিচ্ছু দেখা যায় না। অথচ আকালু টের পায় নিঃশ্বাসের তালে তালে গনজেরার পেট ওঠানামা করছে। নানা বিভ্রান্তির মাঝে গনজেরা বেগম হঠাৎ কথা বলে-নাকি তার পেটটাই কথা কয়ে ওঠে!
‘বদ খোয়াব দেখছুন নাহি? নিশি রাইতে বইয়া রইছেন ক্যান?’
গনজেরার কণ্ঠে ঝগড়ার ঝাঁজ বা রাগের ছিটেফোঁটাও নাই! আকালু বুঝতে পারে না কি বলবে সে এখন। তবে গনজেরা বেগমের পেটের স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের ইতিবৃত্ত যা-ই হোক তা কোনোভাবেই বলা উচিত হবে না। আকালু কথা না বলে ফের বিছানায় শুয়ে পড়ে। খানিকপর একটা কোমল হাত পেট-পিঠ বেয়ে সরীসৃপের মতো চলাচল করলে-আকালু টের পায় ঘুম তাকে ফের স্বপ্ন না হয় দুঃস্বপ্নে বেধে ফেলছে। আকালু পাশ ফিরে শুতে শুনে শোনে-
‘কি-ই বা কই আপনেরে? ভাত খাওনেই যেহানে ঠেকনা হেইখানে গোশত-মাছ কি ভাবন যায়? তবু কই বেজায় লালচ অয়-একবেলা চাইট্টা মাছ যুদি আনেন!’
আকালু কি মরতে মরতে বেঁচে যায়? কি কইলো গনজেরা বেগম? হেয় কি দেহেনা হগ্গল জিনিসে আগুনের ততা লাইগ্যা রইছে। এমুন সমুয় মাছ খাইতে মন চায়? মন চাইলো? বেবরদ্দ গনজেরা বেগমরে নিয়া কি করবে আকালু?
০২.
আকালুর সামনে নদী শুয়ে থাকে। নিস্তরঙ্গ এক নদী। এই নদীর বুকের উপর দিয়ে যখন সে ঝুমুত-ঝুমুত করে রিক্সা টানে-তখনো তাতে কোনো ঢেউ জাগে না! মথুরাপুর ফেলে ঢাকা শহরে আসা অব্দি আকালু এই নদীটাকেই দেখে। তার মনে আর কোনো নদী নাই। বেড়িবাঁধের যে রাস্তাটা আশুলিয়া ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর গেছে-আকালুর কাছে এই রাস্তাটাই নদী মনে হয়। বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা প্রশস্ত নদী। আকালু জানে না এই নদীর জলের স্বাদ। জানে না এই নদী কতোটা গভীর। জানে না এই নদীর নাম-ই বা কি? হতে পারে এটাই হয়তো তার ফেলে আসা গভ্েভশ্বরী নদী অথবা ভেলামতি, ঢেপা বা ইচ্ছামতি নদী। তবে আকালু হররোজ এই নদীপথে রিক্সা টানতে টানতে থমকানো জল দেখে। জল ঘিরে রাখা বাঁশের বানা দেখে। বানা দিয়ে মাছ আটকে রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে মাছচাষী। এই বানা ঘেরা জলের ভিতর দুই একটা বড় মাছ, ছোটমাছ অথবা নিদেন পক্ষে পোনার ঘাঁই মারা দেখলে আকালু বিমর্ষ হয়ে পড়ে-
‘গনজেরা বেগমের মাছের সালুন দিয়া ভাত খাওনের লালচ অইছে!’
পাঁচ-দশ টাকার কচু বা কলমি কিনে ঘরে ফিরলে গনজেরা চুপচাপ রেধে দেয়। এই শাক-ভাত খেতে আকালুর নিজের কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব হয় নাই। কিন্তু গনজেরার মুখে মাছ খাওনের হাউশ শোনার পর কচু, কলমি বা পুুঁইয়ের ডগায় আকালু আর আগের মতো সহজ থাকতে পারে না।
একদম বিহান বিহানই এই রাস্তা নদী জেগে ওঠে না। আকালু যখন প্যাডেল মেরে বাইরে আসে তারও অনেক পরে-রোদ্দুর চড়তা হয়ে উঠলে সরব হয় চারপাশ। আকালুর পা দুইটা জমে বরফ হয়ে থাকে। রিক্সার চাক্কা আগের মতো ঘুরতে চায় না। গনজেরা বেগমের জন্য চাইট্টা মাছের ব্যবস্থা না করলে কেমুন হয়? হাজার হোক তার নিজেরই বউ। বউ তো বউ-হেয় ফির গভ্ভোতী? হায়াত-মউতের কথা বলা যায় না। কিন্তু আকালু চেষ্টার খামতি করে নাই। দুই-একবার সে মাছের বাজার ঘুরানি দিয়ে এসেছে। দাম দস্তর করেছে-কিন্তু কিনতে পারে নাই। কিভাবে কিনবে-গ্যাঁটে ট্যাকা নাই। আর শালার মহাজনও কিপটার একশেষ। একবেলা আকালুকে খেপ মারতে দেয় তো অন্যবেলা দিয়ে দেয় আরেকজনকে। জমার ট্যাকা বেশি পেলে আকালুর মতো অকম্মাকে প্যাডেল মারার সুযোগ দিবে কেডায়?
গনজেরা বেগমের মাছের লালচ মনে করেই আকালু রিক্সায় প্যাসেঞ্জার ওঠানামা করায়। কিন্তু ইদানীং চক্ষে যেন নতুন দৃশ্য ভাসে-কাক-পক্ষী রা না করা বিহান বেলায় রিক্সা যখন ঝুমুত-ঝুমুত করে চলতে শুরু করে-নদীরাস্তার দুই পাশের জলাধারে অজস্র ট্যাপট্যাপি মাছ ভেসে ওঠে। তাদের শ্যাওলা ধরা সবুজাভ পিঠ জল ছুঁয়ে থাকে। আর ফুলে ওঠা সাদা ফ্যাকাশে পেট আসমানমুখী হয়ে থাকার ফলে আরো সাদাটে দেখায়। আকালু দুই চক্ষু ডলে এই দৃশ্য মুছে ফেলতে চায়-কিন্তু পারে না। চোখ থেকে হাত সরালেই আকালু ফের একই দৃশ্য দেখে। আকালু ভয়ানক প্যাঁচের ভিতর পড়ে-সে কি সত্যি-সত্যিই ট্যাপট্যাপির ভেসে থাকা দেখে নাকি গনজেরা বেগমের ফুলে ওঠা পেট দেখে?
গনজেরা বেগমের মাছ খাওনের আশনাই বুঝি তাবৎ জলাধারে এমন করেই ভেসে উঠছে? আকালু সঠিক ধরতে পারে না।
পর পর দিন কয়েক অজস্র ট্যাপট্যাপির ভাসাভাসি দেখে আকালু অসহায় বোধ করে-
‘এইডা কিমুন ঘটনা? খাল-পুকুর-ডুবার বেবাক ট্যাপট্যাপি কি এই ঢাকা শহর আইস্যা পেড ফুলাইয়া পানিত ভাসবার নাগছে!’
আকালু মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, পানিতে নাইম্যা দেখমু ওই গুলান হাছা-হাছাই পেট ঢোল হওয়া মাছ নাহি চক্ষের বিভ্রম? পরেরদিন আকালু মহাজনের গ্যারেজে না গিয়ে লুঙ্গি কাছা মেরে জলে নেমে পড়ে। হাত বাড়িয়ে পেট ফোলা মাছের দঙ্গল স্পর্শ করতে গেলেই মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। আকালু দেখে বাঁশের ঘেরের ভিতর অগণন মাছ বুরবুরি কাটছে!
‘হালার মাছগুলান কি বেবাকই বানার ভিতর হান্ধাইল নাহি?’
আকালু সাবধানী হয়। মাছের মালিক দেখে ফেললে আর রক্ষা নাই। কায়দা করে বানা সরিয়ে সে ভেতরে ঢুকে পড়ে। কোথায় পেটফুলানো মাছের ভেসে থাকা! বরং নানা জাতের মাছ দুই-একবার ঘাঁই তুলেই জলের ভিতর লুকিয়ে পড়ছে! আহা! বালক বয়সে আকালু হাত দিয়ে ধরেই না কত মাছ ডাঙ্গায় তুলেছে! আজকেও যুদি দুই একখানা ধরতে পারে তাইলে গনজেরা বেগমের হাউশ মেটানো যায়!
কাদা-পানি-পলিতে গেঁথে থাকা দুই পায়ের নিচে আকালু হঠাৎ শিরশিরানি টের পায়। এই শিরশিরানি অতিচেনা। সে উত্তেজনা বোধ করে। উবু হয়ে বুক পর্যন্ত জুলে ডুবিয়ে দুই হাত দিয়ে তুলে আনে-
‘মাগো- এক্করে জ্যাতা বাইম।’
সত্যি সত্যিই তাজা বাইন! আকালুর হাতের ভিতর মোচরা মোচরি করে ছাড় পাওয়ার জন্য।
কিন্তু আকালু তাকে শক্ত করে মুঠিতে ধরে রাখে। একটা জ্যান্ত বাইন ধরে ফেলার ঘোর কাটতে না কাটতেই আকালুর পায়ের তলায় কি যেন ফের শিরশির করে!
আরেকডা মাছ!
আকালু চোখ দুটো সরু করে ফের চারপাশে তাকায়। মাছের মালিক এই সমুয়ে যুুদি...! না কোথাও কেউ নেই। কিন্তু সদ্য ধরা মাছটা সে এখন রাখবে কোথায়। যা পিছল এইডার গতর! একবার ফাঁক পেয়ে ছুটতে পারলেই জলের তলায় গর্তে হান্ধাবে। ফলে আকালু বাইনটা রাখে দুই পাটি দাঁতের মাঝখানে। ফের উবু হয়। ফের বুক ডুবিয়ে দেয় জলে। পায়ের তলা থেকে আরেকটা বাইন দুই হাত দিয়ে তুলে আনে।
এই মাছটা আরেকটু বড়। সারা গতরে শ্যাওলার প্রলেপ ধরা। এই মাছটাও ছাড়া পাওয়ার জন্য কসরত করে। কিন্তু আকালু হাতের মুঠায় শক্ত করে ধরে রাখে। আর এই অবসরে দাঁতের মাঝখানে আটকে রাখা বাইনটা মুখ গলিয়ে গলায় চলে যায়। পিঠ আর পেটের কাঁটায় আকালুর অন্ত্র ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে মাছটা আরো নিচে নামতে থাকে। হয়তো সে বেরুবার পথ খোঁজে কিংবা খোঁজেই না। আকালু তা আর বুঝতে পারে না। তবে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত আকালু চারপাশে অজস্র ট্যাপট্যাপির ফুলে ওঠা পেট দেখে। ট্যাপট্যাপির ফুলে ওঠা পেট নাকি গনজেরার ফ্যাকাশে সাদা পেট! আকালু যেন ফের নতুন ধন্দে পড়ে। তবে চোখ বুজে ফেলার আগে তার আরেকবার ইচ্ছা জাগে-ট্যাপট্যাপির পেটের মতো গনজেরার ফুলে ওঠা পেটে-বাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে জোরসে একটা...!