somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোষা

৩০ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাপড়ি রহমান/

আমাদের বাড়িতে অন্ধকার নামতো সূর্য ডোবার ঢের আগে। ছোট-বড়-মাঝারি নানাজাতের গাছপালায় ঘেরা বলে রোদের মুখ দেখা যেতে কি যেত না। মাকড়সার জালের মতো ছড়ানো আলো ইষৎ ঝিলিক মেরেই দ্রুত লুকিয়ে পড়তো ওই ঘিঞ্জি পাতা-লতার আড়ালে। ফলে প্রতিদিনই সন্ধ্যা নামার আগে-ভাগেই বাড়িটা ঝুপ করে কোনো গভীর কুয়ার ভেতর ঢুকে পড়তো। আর এই রকম হঠাৎ নামা অন্ধকারে আমাদেরও গা ছমছম করে উঠতো। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই রাত হয়ে যাওয়া, আর এতে আমরা অভ্যস্তই বলা চলে-তবুও ভয় আমাদের জোঁকের মতো কামড়ে থাকতো। এই ভয় তাড়ানোর কোনো উপায়ও আমাদের জানা ছিল না। বাড়ির দক্ষিণ দিকে একেবারে পাতায় পাতাময় গাবগাছ-দিবা নাই - নিশি নাই বিশাল ছাতার মতো নিজেকে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাস, ঝড় এমনকি ঘুর্ণিঝড়েও কখনো একটা পলকা ডালও তার ভেঙ্গে পড়ে নাই। ওই সবল গাছের দিকে আমরা মনের ভুলেও তাকাতাম না। আমরা জানতাম ওই গাবগাছই হলো ভূত-পেত্নীদের আখড়া। গাবগাছ পেলেই নাকি তেনারা নিরাপদে সংসার যাপন করেন। দক্ষিণ দিকে তেনাদের রাজত্ব-পশ্চিম দিকটা যে আমাদের তাওতো নয়। এইদিকে আছে একটা বড়সড় আষাইঢ়্যা আমের গাছ। উনিও হাত-পা মেলে এতটাই আয়েশ করে আছেন যে, উনার ড্রামের মতো মোটাসোটা ডালগুলো নেমে এসেছে ঠিক ঘরের চালের উপর পর্যন্ত। ফলে অন্ধকার হয়ে এলে পশ্চিমে তাকানোর সাহসও আমাদের ছিল না। দক্ষিণ-পশ্চিমকে নিষিদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করে পূবের ফর্সা ফর্সা দিকটাতে আমরা বিচরণ করতে চাইতাম। কিন্তু এটাও আমাদের জন্য সহজ ছিল না। এই পূবদিক অতোটা অন্ধকার না হলেও মস্ত একটা ন্যাংগুইল্যা গাছ একেবারে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শুয়ে আছে। আর এই পানি হলো আমাদের প্রাচীন পুকুরের পানি। গণ্ডা তিনেক আণ্ডা-বাচ্চাকে অকালে ডুবিয়ে মারার ইতিহাস নিয়ে এই পুকুর জল অথই করে দিব্যি বেচেবর্তে আছে! এই পুরানা পুকুর এখনো এতটাই গভীর যে, উইন্যার দিনেও থই পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। বলা চলে আমাদের চারদিকেই গা ছমছম করা পরিবেশ। এই রকম দিনে-রাতে ভয় ভয় ধরা বাড়িতে হঠাৎ দুইজন ছুতার এলো। এবং কয়খানা কাঁঠালের চওড়া তক্তা নিয়ে কাজেও লেগে গেল। ছুতার দেখে আমরা অবাক হলাম। দাদাজান কি নতুন কোনো পালঙ্ক বানাবে নাকি? কিন্তু আমাদের চক্ষের সামনে তক্তা রানদা করে তারা কিনা পালঙ্ক না-বানিয়ে নৌকার আদল দিল! ছোটমোট একটা কোষা নাওয়ের আদল! বাড়ির সামনের খ্যাংড়াকাঠির মতো শুয়ে থাকা খাল, সারা বৎসর জলহীন-খটখটে! কিন্তু বর্ষা এলেই এমন ভরভরন্ত হয় যে, ওই খ্যাংড়াকাঠি চেহারাটা ভাবাই যায় না। প্রতি বর্ষায় জল এমন বাড়ন্ত হয় যে উঠানের কোণা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

দাদাজানের হঠাৎ কেন কোষা নাও বানানোর মতি হলো আমাদের মাথায় এলো না। তবে অনুমান করলাম বাদলার সময় ওই জলময় খাল পারাপারের জন্যই এই ব্যবস্থা। দাদাজানের এমন বড়দিলের পরিচয় পেয়ে আমরা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলাম। যাক বাবা গাড়ি-ঘোড়া না হোক একটা সত্যি সত্যি কোষা তো দেখতে পাচ্ছি! আমাদের গাড়ি নাই, ঘোড়া নাই-এমনকি একটা আস্তাবলও নাই। থাকার প্রশ্নও আসে না। গাড়িতে চড়ার আনন্দ কি তা আমরা এখনো জানি না। আমাদের গাড়ি বলতে এখনো সুপারির খোল। গাড়িতে চড়া বলতেও সুপারির খোলে। আর হা করে করে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকা। এছাড়া উপায়েই বা কি- সুপারি গাছগুলো তো আসমান মুখীই। ফলে ওই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা চোখ ঝাপসা করে ফেলি- কখন জোর হাওয়া দিবে? হাওয়ার তোড়ে খোল সমেত একটা প্রায় আধ শুকনা ডাল খসে পড়বে মাটিতে। ওই খসে পড়া খোল নিয়ে আমাদের কাড়াকাড়ির অন্ত নাই। আমি, চন্দন, মিশু, সাথী-দিপু হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেই-কার আগে কে চড়বে ওই খোলের গাড়িতে। এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটিসহ মারপিটও আমরা কম করি না। এইদিকে উপদ্রবের মতো বড়দাদীজান না হয় ছোটদাদীজান জুটে যায়। ওই খোল টেনে নিয়ে তারা রান্নাঘরে চুলার ভেতর গুঁজে দেয়। বড় বা ছোটদাদীজানকে আমরা বাধা দিতে পারি না। তবে ওই সুপারির খোল পুড়তে দেখলে আমাদের মন পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়।

আমরা ভেবে পাই না বুড়া-আধবুড়া মানুষেরা কেন এইসব ছাতামাতা নিয়ে টানাটানি করে! এই সুপারির খোল আমাদের কাছে কতোটা আরাধ্য তারা কি তা জানে না? এই খোলের উপর জুত হয়ে বসলেই দিব্যি গাড়ি চড়া যায়। চন্দন না হয় মিশু একজন টেনে নিলেই হলো। আর কেউ পাতাসহ ডান্ডি চেপে ধরে বসে থাকি। ডান্ডি চেপে ধরে ধরে হাতের তালুতে রক্ত জমে যায়। তবুও আমরা ডান্ডি ছাড়ি না। ছাড়লেই বিপদ। গাড়ি তখন খালি খোলসহ ছুটতে থাকবে আর আমরা মাটিতে। এই আনন্দের বাহনে চড়ে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। অবশ্য এই খোল-গাড়িতে আরো একটা মজার বিষয় ঘটে-গাড়ি চলার সঙ্গে সঙ্গে উঠানের ধুলা সমান হয়ে মসৃণ-সুন্দর রাস্তা বানিয়ে দেয়। কিন্তু বানানো রাস্তা ধরে আমরা আর ফিরে আসতে পারি না। ফিরতে শুরু করলেই ধুলা সরে ফের তা অমসৃণ হয়ে ওঠে। চন্দন-মিশু বা দিপু পালা করে খোলের গাড়িতে চড়লে আমরা নতুন নতুন রাস্তা বানাতে থাকি। উঠান জুড়ে ওইসব রাস্তা দেখে আমাদের আহলাদের সীমা থাকে না।

তা যানবাহন বলতে ওই সুপারির খোল-ডান্ডি-পাতা। আর তা গড়গড়িয়ে ধুলার উপর টেনে নিয়ে সব ধুলাকার করে দেয়া-এছাড়া অবশ্য আরো একটা চলাও আমাদের আছে-ঘোড়ার সঙ্গে চলা! বারুণীর মেলা থেকে দাদাজান চাক্কাওয়ালা তেজি ঘোড়া কিনে আনে। চার চাক্কার ওপর বসানো মাটির ঘোড়া। দুই চাক্কার মধ্যিখানে দড়ি বেঁধে টানলেই ঘটর ঘটর কর চলতে শুরু করে। দড়ি হাতে নিয়ে আগে আগে আমরা আর পিছু পিছু মাটির নিষপ্রাণ ঘোড়া। চলতে চলতেই হয়তো দড়ি ছিঁড়ে যায় অথচ আমরা টের-ই পাই না। খানিকটা পথ যাওয়ার পর ঘোড়া চলার শব্দ না পেয়ে পেছনে তাকাই-ঘোড়া ঘোড়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে! তার কেশর নড়ে না, চক্ষুর পাতা পড়ে না-তার টগবগ নাই-অথচ লাগাম ছিঁড়ে আমরা চলে এসেছি ম্যালা দূর! তাও যাহোক সুপারির খোল আর মাটির ঘোড়া নিয়ে আমাদের চলা! ওই একঘেয়ে চলার সঙ্গী এখন কোষা! আস্ত একখানা কোষা নাও!

একদিন দাদাজানের তদারকীতে ওই ভুতের গাবগাছ থেকেই গাব পেড়ে আনা হলো। বালতি কে বালতি গাব। সেই গাব ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হলো পাক্কা দুইদিন। তারপর সেই রস মাখা হলো কোষার গতরে। আমরা কেউ-ই কোষার আশপাশ থেকে আর নড়ি না। নড়বো কি? উঠানে জমা বৃষ্টির পানিতে কলার মোচা ভাসানোর চাইতে কোষা ভাসলে যে দারুণ বিষয় হবে আমরা তা বুঝে ফেলেছি।

গাবের রসের প্রলেপ দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে দাদাজান দুই-চাইরবার গলা খাকরি দেয়। বেশ জোরে কেশে-টেশে কাশির দলা থুক করে ছুঁড়ে দেয় সামনে। আর সেই কাশি কিনা পড়ে দুই ছুঁতারের মাঝখানে! দাদাজানের সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নই। দাদাজান ফের কেশে গলা সাফ করে বলে-

‘আলকাতরা হইলে জব্বর ভালা হইতো। অবশ্যি আলকাতরার বদলে গাবের রসের পোছ দিলেও পানিতে তলাডা খাইব না হেমন।’

দাদাজানের এই সাবধান বাণী আমাদের কানে ঢুকে কি ঢুকে না। আর তখন উইন্যার সময়-খালে পানির নাম- নিশানাও নাই-অথচ আমাদের মনে হয় পানির ঢল নেমে নদী হয়ে গেছে! আর সেই নদীতে ছোট্ট কোষাটা পানসি নাও হয়ে ভেসে চলেছে। আর এই পানসির গতি একেবারে রাজহাঁসের মতো। আমরা মহাফূর্তিতে বহুবার শোনা শোলোক আওড়াতে থাকি-



পানসি নাও পানসি নাও

পান খায়া যাও

মিশুর শাউড়ির ঢোবলা গুয়া

তুইল্যা নিয়া যাও...



মিশুর পাছাটাই তো এখনো বড়সড় হয়ে উঠে নাই। কে যে তার শাশুড়ি হবে আমরা তার কিচ্ছু জানি না। তবু সেই অদেখা শাশুড়ির ভারিসারি পাছটা তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের আকুতির শেষ থাকে না। আরে ধুর! কোথায় ছইওয়ালা পানসি আর কোথায় কার শাশুড়ির পাছা! আমাদের দাদাজানের বেশি টাকা-পয়সা নাই। একটা কোষা বানাতেই তার ছ্যারাব্যারা অবস্থা। চক্ষের সামনে উল্টে রাখা কোষা, তাতে গাবের রসের পোচ দেয়া দেখেও আমরা বলতে পারি না-

‘দাদাজান-ও সুনার দাদাজান-এইডার ওপরে এইবার একটা ঘর বানাইয়া পানসি কইরা দেন। সেই ঘরের মইদ্যে আমরা খাওয়া-দাওয়া সাইরা নিন্দ পাড়বার চাই।’

দাদাজানকে কিচ্ছু বলার সাহস আমাদের হয় না। আসলে আমরা তো ভালো মতো বুঝিই না কোষা আর পানসির তফাৎ কি? ডিঙি আর ছিপ নাওয়ে পার্থক্য কি? আমরা আসলে কিচ্ছু বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি আমরা চলতে চাই। চলাও ঠিক না ঘুরতে চাই। লাটিমের মতো চক্কর মারতে চাই। ঘোড়ার মতো, গাড়ির মতো, নাওয়ের মতো চলন্ত কিছুর মধ্যে আমরা চড়তে চাই। চড়ে নিজেদের পেটে হাত-পা ঢুকিয়ে বসে থাকতে চাই। অর্থাৎ চলাটাই আমাদের কাছে আনন্দের। তা সুপারির খোলের উপর বসে হোক অথবা নাওয়ের ভিতর থেকে হোক।

বাদলার মরশুম আসার আগে-ভাগেই কোষা নাওয়ের কাজ শেষ হয়ে গেল। দাদাজানের মাথা হিটকুলি বুদ্ধিতে ভরা। দাদাজান নাওয়ের গলুই দিল টিনের টুকরা দিয়ে। এটা এক দেখবার মতো জিনিস হলো বটে। গাবের কালসিটে প্রলেপ কাঁঠাল কাঠের হলুদ রঙ গায়েব করে এক অচেনা রঙ ধরালো। টিনের রূপালি গলুইয়ে রোদ্দুর পড়লেই এক বাহারি দৃশ্য দেখতে পাই আমরা। আমাদের কাছে এই কোষাকেই রূপার নাও মনে হয়। আমাদের আর পায় কে? আমরা একেকজন যেন সত্যি সত্যিই বাদশা-বেগম বনে গেছি! আর নতুন রাজ্য দখলের লোভে খোলা তরবারি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শত্রু সামনে পড়লে তাকে কচুকাটা করতেও আমাদের দ্বিধা হবে না। কিন্তু এই টগবগ করে ফুটন্ত খুশি আমরা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না। আমাদের কোষা খালে ভাসে না। এদিকে বর্ষার পানি উঠান পেরিয়ে পৈঠা ছুঁয়ে ফেলেছে। দাদাজান নানা উছিলা বের করে। শুক্কুরবার বাদ জুম্মা ঠিক করে তো তার বাতাসা কেনার পয়সার টান পড়ে যায়। ফের শুক্কুরবার ঘুরে আসে-দাদাজানের বাতাসার পয়সা যোগাড় হয় না। আমরা অস্থির-বিস্থির করি। দাদাজানকে কাকুতি-মিনতি করে বলি-

‘দাদাজান বাতাসা খাওন নাগব না। আমরা বাতাসা খাইতে চাই না। আমরা খালি কোষাডায় চড়তে চাই। কোষায় চইড়া খাল আর বিলের মইদ্যে ঘুরতে চাই।’

দাদাজান আজব কিসিমের বটে। আমাদের কথা একেবার পাত্তা দেয় না। এদিকে খালের উপর একবাঁশের পুলটা নড়বড় করে। আমরা ভয়ে তাতে উঠতেই পারি না। এখনো ভালোমতো কেউ সাঁতরাতে পারি না। এক বাঁশের পুলের উপর পা দিলেই গা শিরশির করে। পা ফসকে পড়ে যাবার ভয়ে আমরা নিচে পর্যন্ত তাকাই না।

অথচ উইন্যার সময় এই খালের ভিতর আমরা বউ-ছি, গোল্লাছুট খেলি। কুম্ভির কুম্ভির খেলি। কিন্তু বর্ষা এলে খালের ওই পাড়েও কেউ যেতে পারি না! বিষয়টা আমাদের কাছে দারুণ রহস্যময় লাগে। খালের ওই পাড়ের বকুল গাছটা কালচে সবুজ পাতায় ভরে থাকে। আর গাছের তলাটা ফুল পড়ে একেবারে সাদা হয়ে থাকে। আমাদের মন ছুটে যায় বকুল ফুলের গন্ধে। কিন্তু এক বাঁশের পুল পেরোবার সাহস সঞ্চয় করতে পারি না। এই জলবন্দি অবস্থায় আমাদের দম ফাঁপড় করে। আমরা দল বেঁধে উল্টানো কোষার উপর বসে থাকি। একেক জন হাতে বাঁশের কঞ্চি নিয়ে বৈঠার মতো বাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের কোষা একচুলও আগায় না। মরা ঢ়োড়া সাপের মতো নিস্তেজ পড়ে থাকে। চন্দন বা মিশুর হাফপ্যান্টের ফাঁক দিয়ে দেখা পড়ে থাকা নুনুর মতো লাগে কোষাটাকে। নড়েও না। চড়েও না। আমরা রাগ করে কোষা থেকে নেমে পড়ি। হাতের কঞ্চিবৈঠা দিয়ে বিষকাঁটালির ঝোপের উপর বাড়ি মেরে চলি। শালার এই গাছের জান বেজায় শক্ত। বর্ষার পানিতে ডুবে গেলেও এই গাছ মরে না। কঞ্চির বাড়ি মেরে বিষকাঁটালির ঝোপ উজাড় করেও আমাদের ক্ষোভ মেটে না। শালার দাদাজান। বুইড়া কুনহানকার। আমরা আফনের বাতাসা খাইতে চাই না। খালি কোষাডারে জলদি জলদি খালে ভাসায়া দেন। দাদাজান কিভাবে যেন আমাদের মনের কথা বুঝতে পারে! পরের শুক্কুরবার বাদ জুম্মা মিলাদ দিয়ে ঠোঙা ভরে গুঁড়ের বাতাসা নিয়ে আসে। বাতাসার গন্ধে বাতাস ম ম করে। আমাদের দুই হাত ভরে ওই বাতাসা গুঁজে দেয়। মিশু-চন্দন-সাথী-দিপু কেউ বাদ যায় না। অন্য পাড়ার দুই চারজনের হাতেও ওই বাতাসা পৌঁছায়। আমরা বাতাসা চাটতে চাটতে ফের কোষা ভাসানোর স্বপ্ন দেখি। সত্যি সত্যিই ওইদিন বিকালে দাদাজান কোষাটা খালে ভাসায়। বৈঠা টানে। কখনো লগি মারে। আমাদের বলে-

‘এতজন একলগে চড়ন যাইব না। ছোট্ট নাও ডুইব্যা গেলে বিপদ হইব।’

আমরা মন খারাপ করে তার কথা শুনি। দুই হাত দিয়ে গোপনে চক্ষের পানি মুছি। তারপর দাদাজানের কথা মতো তিন-চারজন কোষায় উঠে পড়ি। দাদাজান বৈঠা টানলে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি ওঠে। আমরা কোষার কিনারে বসে পানিতে হাত ডুবালে দদাজান ধমকে ওঠে-

‘নাওয়ের বগলে বগলে হাপ চলে। আত উঠায়া রাখো।’

আমরা ভেজা হাত কাপড়ে মুছে গুম হয়ে বসে থাকি। দাদাজান খাল পেরিয়ে বিলে কোষা নামায়-শাপলা তুলে দেয়। ঢ্যাপ তুলে দেয়। ডুব দিয়ে কয়েকটা শালুকও তুলে দেয়। আমরা ঢ্যাপ ভেঙে দেখি লাল সরিষার মতা মিহিদানায় ভরা। দাদাজান হঠাৎ বলে ওঠে-

‘লাল ঢ্যাপ খাইও না-ওইডায় হাপে বিষ ঢালে।’

দাদাজানের নিষেধ আমরা তোয়াক্কা করি না। ঢ্যাপের লাল লাল দানা আমাদের লোভাতুর করে তোলে। আমরা ওই লাল ঢ্যাপই খেয়ে ফেলি। শাপলা ফুলের বুক চিরে হলদে মখমলের মতো রেণু খেতে খেতে ফের উবু হয়ে হাত ডুবিয়ে দেই পানিতে। সন্ধ্যা ঘনায়মান বলে দাদাজান হয়তো দেখে না। অথবা ইচ্ছা করেই না দেখার ভান করি নাকি বয়সের কারণেই দেখে না-আমরা বুঝতে পারি না। দুই পাক কোষা ঘুরিয়েই দাদাজান বলে-

‘এইবার লও বাড়িতে যাইগা। আন্ধার নাইমা গেছে গা।’

‘দাদাজান আর এট্টু ঘুরানি দেন। দিলেই যামুগা। আর চড়মু না।’

আমরা দূরের একটা আধ ফুটন্ত শাপলার দিকে আঙ্গুল তুলে বলি-

‘এইডা তুইল্যাই যামুগা।’

দাদাজান দুনোমুনো করে। তারপর রাগ করে বলে-

‘ভাল্লুকের হাতে খুন্তা দেওন নাগে না। এইডা নিয়াই যাইবা গা। আন্ধারে পুকামাকড়ে ঝামেলা করবো।’

আমাদের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে, আমরা তো ভাল করেই জানি রাত হলে কেউ-ই সাপকে সাপ বলে না। বলে পুকামাকড়। রাতের বেলায় নাকি সাপের নাম নিতে নাই।

পানির উপর ভেসে থাকা শাপলাটা অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখায়। আমি হাত বাড়িয়ে তুলতে চাইলে দাদাজান বাধা দিয়ে বলে-

‘খাড়াও আমি তুইল্যা দেই।’

দাদাজানের কথা শেষ করার আগেই চন্দন পানিতে হাত ডুবায়। অস্ফুট স্বরে উহ্‌ শব্দ করে। তারপর ফুলটা তুলে আনে। দাদাজান এইবার জোরে ধমকে ওঠে-

‘মাতুব্বুরি না করলে অয়না-বজ্জাত পুলাপাইন!’

আমি, মিশু, সাথী-ভীষণ আনন্দ নিয়ে বসে থাকি। চন্দনের মুখটা ভয়ার্ত দেখায়। সামান্য উশখুশ কর সে। আমরা পাত্তা দেই না। এই প্রথম আমরা জলের উপর ভাসতে পারছি। নিজেদের হাঁসের ছানা মনে হয়। এক অর্থে এই কোষাটাই আমাদের প্রথম চলার গাড়ি। পরের দিন ভোর-ভোরই চন্দনদের ঘরে কান্নার শব্দ শুনি। আমরা চোখ কচলাতে কচলাতে দৌড়ে যাই। দাদাজানও দৌড়ায়। বিছানার উপর চন্দন চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার মুখ নীলবর্ণ দেখায়। ঠোঁটের পাশে ফেনা জমে শুকিয়ে আছে!

আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। অকারণেই বুক ঠেলে কান্না আসে-চন্দনের কি হইলো?

তারপর কতদিন কোষাটা ঘাটে পড়ে থাকে! দাদাজান ঘন ঘন চক্ষু মোছে। দেখে আমরাও চক্ষু মুছি। বৃষ্টি-ঝড়-জল কত কি যে কোষাটার উপর দিয়ে বয়ে যায়। হঠাৎ একদিন বিকাল বিকাল দেখি দাদাজান শুকনা চক্ষে কোষটা খালে ভাসায়। হাতে ফের বৈঠা ধরে। লগি মারে। আমরা চুপ করে দল বেধে দাঁড়িয়ে দেখি। কোষায় চড়ার বায়না ধরি না। পরের দিন দাদাজানই নিজ থেকে আমাদের ডাক দেয়। ডাক দিয়ে বলে-

‘সুনারা আহো-আইজ তুমাগো নাওয়ে ঘুরামু। কিন্তুক ভুলেও পানিত আত চুবাবা না।

আমাদের তক্ষুণি চন্দনকে মনে পড়ে। কিন্তু নাওয়ে চড়ার আনন্দের কথা ভেবে কিছুতেই দাদাজানকে না বলতে পারি না! আমরা ঝটপট উঠে পড়লে দাদাজান কোষা ভাসিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে বৈঠা টানে। পানির উপর ঘুরতে ঘুরতে আমরা ফের শাপলা তুলি। ঢ্যাপ তুলি। জলার্দ্র হাওয়ায় আমাদের ঘুম ধরে যায়। কিন্তু আমরা জোর করে চক্ষের পাতা খুলে রাখি। আমরা জানি এখন ঘুমিয়ে পড়লে কোষায় চড়ার মজাটা এক্কেবারে মাটি হয়ে যাবে... [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/greenpr67_1241094137_1-BAN-012[1].jpg] [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/greenpr67_1241094137_1-BAN-012[1].jpg] [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/greenpr67_1241094137_1-BAN-012[1].jpg] [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/greenpr67_1241094137_1-BAN-012[1].jpg]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×