somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃক্ষপুরাণ

৩০ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাপড়ি রহমান/

পাখির ডানার সিক্ত সবুজ গাছের ছায়া, গভীর ছায়া, একলা মেঘে কুড়োই

পরীবানু তখনো হাঁটু সমান অথচ সে একেবারে ছায়াতরু হয়ে গেল! তার অজস্র ডাল-পাতার নিচে কুতকুতের ঘর কাটতে কাটতে পরীবানু প্রায়ই আপন মনে বলতো-

‘দাদীজানে কইছে আমি আর তুমি হইলাম হমানে-হমান। এইডা এহন আর কে বুঝবো কও? তুমি আমারে ছাড়াইয়া গেলা-আমি তো আমি-ঘরের চালাডারেও পাছে ফেলাইয়া দিয়া কেমতে জানি ম্যাঘের ভিতরে হান্দাইয়া গেলা!’

পরীবানুর তখন এমনই মনে হতো। সে আসলে উদ্দিশ করতে পারতো না ওই মেঘের সঙ্গে ছায়াতরুর ফারাক আসলে কতোটা! ২০-২০ ফুট লম্বা গাছটা সকলের চোখে ধুলা দিয়ে মেঘের ভেতর ঢুকে পড়েছে!

নিজ বয়সী একটা গাছের এমন বাড়-বাড়ন্ত নিয়ে পরীবানুর বিস্ময় কিছুতেই কাটতে চাইতো না। গাছটার নিচে দাঁড়ালেই তার মনে হতো

‘আমিতো এহনো এদ্দুরাই রইলাম আর হেয় কিনা এমুনই ডাঙ্গর হইয়া গেল!’

সত্যিই তাই। মাটির ঘরের খুপড়ি জানলার ধার ঘেষে কাঁঠাল-চারাটি ধাই-ধাই করে উপরে উঠে গেল। উপরে উঠে গেল তো গেল-মেঘ কুঁড়ে একেবারে আসমান ছুঁয়ে ফেললো।

পরীবানু একটু বুঝদার হওয়ার পর থেকেই দাদীজানকে কতবার যে বলতে শুনেছে-

‘যেইদিন তুই মায়ের প্যাড থিক্কা বারাইয়া আইলি-হেইদিন বিহান বেলায় এমুন তুফান দিল! হেই তুফান ক্ষান্ত দিল দুইফর কালে। তহনো আসমান এক্করে মেঘেই ভাসা। এট্টু এট্টু গুড়গুড়ি বিষ্টি দিতাছিল খালি। হেয় বিষ্টি মাতায় কইরা তর দাদাজান খুন্তা দিয়া মাটির চাঙ্গর আলগা করলো। হের পরে বিচিডা গাইড়া থুইলো।’

এই গল্প পরীবানু এতবার শুনেছে যে বিচি গাড়ার দৃশ্যটিও সে হবহু বলে দিতে পারে।

বিহান বিহানই তুফান দেওনের পরও এক্করে গাদলা করা দিন আছিল হেইডা। ম্যাঘে আন্ধার তামাম দুনিয়া। তুফানের আলামত নিয়া বিরিক্ষের পাতা-ডাইল তহনো পাক খাইয়া দুমড়াইয়া মুচড়াইয়া আছে। দাদাজানে সবই নিজ চক্ষে দেখলো। হের পরে বিচিডা মাটির তলায় গাইড়া থুইলো। আর কইলো এই কাঁডাল হইব জব্বর মিডা।এইডা যুদি বাঁচে-হেয় আর আমার নাতনীর বয়স অইব হমানে-হমান।

গাছটা ৫-৭ দিনেই অঙ্কুরিত হলো। তারপর দিব্যি বড় হতে লাগলো। পরীবানু আর কাঁঠাল গাছের বয়স ৪০ দিন পার না হতেই দাদাজান হঠাৎ মারা গেল। একেবারে তরতাজা মানুডা কিভাবে যে অমন করে মরলো! দাদীজানের সবই ঠিকঠাক মনে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-

‘তর-কাঁডালের আর বুইডার মরণের কাল এক্করে হমানে-হমান।’

পরীবানুর চক্ষে বিচি বোনার দৃশ্য ভাসলেও দাদাজানের মৃত্যু দৃশ্যটা ভাসে না। অনেকবার চেষ্টা করেও সে দৃশ্যটা ভাসাতে পারে নাই। আর ধুর দাদাজান আসলে কতোটা বুড়া হয়েছিল? দাদীজান যতোটা বলে ততোটা না। তবে এই কাঁঠাল গাছের বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে ওঠার রহস্য পরীবানু উদ্ধার করতে পারে না। সে যখন উদলা গায়ে, হাফপ্যান্টের চারপাশে কয়েকটা মাটির চারা গুঁজে কুতকুত দম দিয়েছে-তখনই গাছটা সোমত্ত জোয়ান। লালচে-সবুজ-কমলা পাতার রাশ ডাল-পালাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে পাঁচ-দশটা কাঁঠাল ওই ডাল-পাতারই ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঝুলে পড়েছে। পরীবানু দেখেছে প্রথম পাকা কাঁঠালের কোয়া দাদীজান যত্ন করে তুলে রেখেছে মুসাফিরের জন্য। কাঁঠালের বাকল ফাঁক করে রোয়া বের করতে করতে একটা-দুইটা চেখে দেখেছে। নতুবা দুই-চারটা চাপিলা বৈতাসহ ফোকলা গালে চালান করে দিয়ে বলেছে-

‘পরথম ফল মুসাফিরগো দিয়া-থুয়া খাওন ভালা।’

টপ করে আরো একটা রোয়া মুখে পুরে বলেছে-

‘এমুন মিডা-মাগো! মরার বুইড়া চাখতে পারলো না!’

পরীবানু চমকে উঠেছে। বুড়ি কাঁঠাল খাচ্ছে ভাল কথা-কিন্তু এত বছর ধরে কিভাবে ওই স্মৃতি আঁকড়ে আছে! বুড়িতো প্রতি বছর কাঁঠালের মরশুম এলেই এমন বলে! পরীবানুর ধান্দা লাগে-অনেক বছর আগে মরে যাওয়া একটা মানুষ কিভাবে জীবন্ত মানুষকে এমন করে তাড়িয়ে ফেরে!

বছর বছরই গাছের ডাল বেড়েছে। ডালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাতা বেড়েছে। পাতার সঙ্গে ফল। পরীবানুও যে এক্কেবারে বাড়েনি তাও নয়। পরীবানুও বেড়েছে। কতোটা বেড়েছে তা কেউ আন্দাজ করতে না পারলেও দাদীজান ঠিকই আন্দাজ করতে পারে। পরীবানু বুড়ির মতিগতি বুঝে না! বুড়ি কি চক্ষে তখনো অতটাই দেখতে পায়-নইলে কি করে বলে-

‘ওই পরীবানু- ঢাইক্যা-ঢুইক্যা চলিস বুইন। এই জগতে মন্দ চক্ষের অভাব নাই-কা।’

পরীবানু থমকেছে! টিউবলের পাশে টিনের ঘেরের ভিতর গোসল করতে গিয়ে থমকেছে! উদলা শরীরে সাবান মাখতে মাখতে থমকেছে। থমকে দৃষ্টি পরিষ্কার করে তাকিয়েছে-

‘আশ্চয্যি-বুক দুইটা দিনকে দিন এমুন বেঢপ হইয়া উঠতাছে ক্যান? এমুন বড় হইতে থাকলে তো কয়দিন পরই কাঁডালের লাহান ঝুইল্যা পড়বো।’

পরীবানুর এই আশঙ্কা সত্য হওয়ার আগেই রফিকের বউ নাজমা তাকে দুইখানা চশমা এনে দিয়েছে। পরীবানুর স্তন দুইটা শক্ত করে বেঁধে রাখার চশমা! বুক দুইটা টান-টান উঁচু করে রাখার চশমা। নাজমা ভাবী এতসব কিভাবে জানে-বুঝে? আর নাজমাভাবীর চক্ষেই বা এইসব কিভাবে পড়ে? বুক দুইটাতে চশমা আটকিয়ে ইশকুলে যাওয়া-আসার পথে পরীবানু খেয়াল করেছে-জগতে মন্দ চক্ষুর অভাব নাই! কিন্তু পরীবানু কি করবে? এতটুকু একটা ওড়না দিয়ে কিভাবে ঢেকেঢুকে চলবে? আর তার বুক দুইটা তো সত্যি সত্যি কাঁঠাল নয় যে-পোক্ত হলেই কাঁচি দিয়ে ঘেচাৎ করে কেটে ফেলবে! পরীবানু বুঝে উঠতে পারে না কি করে সে এই ফল দুইটাকে সামলাবে। পরীবানুর এই ভাবনা দাদীজানেরও কম কিছু নাই। দাদীজান এক পদের মানু বটে-নিজের জন্য কোনো ভাবনা নাই-যতো ভাবনা নাতনীর জন্যই!

বুড়িতো সারাক্ষণই উদলা গায়ে হনহনিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বুক ঢেকে রাখার বালাই নাই। ওই দুইটা শুকনা ঝিঙার মতো লম্বা হয়ে তার নাভির ওপর দোল খায়। দাদীজানের ভ্রুক্ষেপ নাই। অথচ পরীবানু লজ্জা পায়-বুড়ির হায়া-শরম সব গেল কুনহানে? বাপজান বা লায়েক হওয়া ভাইদের সামনেও বুড়ি ওইভাবেই চলাচল করে! বুড়ি যেন এই বিষয়ে নির্বিকার! পরীবানু ভেবে-চিন্তে বের করেছে-মানু বুইড়া হইয়া গেলে মাইয়া আর পোলার কুনু ভেদ থাহে না! ফলে দাদীজানের ওই ঝুলন্ত ঝিঙা নিয়ে কারো কোনো মাথার বিষ নাই। দাদীজানের তো নাই-ই।

তা পরীবানু কি করবে? পরীবানুর সংকোচ হয়। ইশকুলে যাওয়া-আসার সময় যতোটা সম্ভব সে নিজেকে ঢেকেটুকেই যেতে চায়। কিন্তু ভাঁজ দিয়ে পড়া সাদা দোপাট্টা পরীবানুর কতোটাই বা কি ঢাকতে পারে? তিন চারজনে মিলে দল বেধে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটলে কিছুটা নির্ভয় থাকা যায়। ইশকুলের মোড়ের কাছে বটতলাটা মোটেই ভালো ঠেকে না পরীবানুর। এই জায়গাটা পেরুবার সময় অকারণেই বুক টিপটিপ করে। এই বট তলায় সারাক্ষণই চ্যাংড়া বয়সীরা জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকে। ধুমসে বিড়ি সিগারেট ফোঁকে আর কুতকুত করে মাইয়া-ছাওয়াল দেখে। পরীবানু দলবেধে হেঁটে যাওয়ার সময় জোরে সিটি দেয়। কখনো বা দুই-চারটা অশ্লীল বাক্যও ছুঁড়ে দেয়। ফলে এই জায়গাটা পেরোবার সময় পরীবানুর অকারণেই পায়ের ভিতর পা জড়িয়ে যায়। চোখ-মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে মাথা হেট করে সোজা ইশকুলের পথে হাঁটা দেয়। শুধু পরীবানু নয়-তার সহপাঠীরাও বুকের ভিতর টিপটিপ বাড়িয়েই বটতলাটা পার হয়। অবশ্য ওই সিটিবাজদের দুই একজনের সঙ্গে মরিয়ম বা রুমানার যে ভাবসাব হয় নাই এমনও নয়। মরিয়ম বা রুমানা প্রায়ই ইশকুলের পথে রওয়ানা দিয়েও মাঝপথে গায়েব হয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে। ফের ইশকুল ছুটির পর পরীবানুদের দলে মিশে বাড়ির পথ ধরে। পরীবানুর কাছে এমন ধোঁকাবাজি ভাল লাগে না। সে ভেবে পায় না ওইসব সিটিবাজানো, নোংরা মন্তব্য করা ছেলেদের সঙ্গে মেয়েগুলা ভাব-সাব করে কিভাবে? পরীবানু মনে মনে রেগে যায় আর ভাবে একদিন জিজ্ঞাসা করবে-

‘ওই মরিয়ম ওই বখাইট্টা খাইচ্চরা ছ্যামড়ার লগে তুই বাত-চিত করস কেমতে রে?’

কিন্তু ক্লাসের পড়ার চাপে মরিয়মকে আর জিজ্ঞাসা করা হয় না। পড়া ছাড়াও পরীবানুকে ঘরের কাম-কাজও কম-বেশি করতে হয়। নাজমা বেগম একা একা সামাল দিতে পারে না। মা মোমেনা বেগমের পাঁচ-সাতখানা গরু-গাভী-বলদ-বকরীর তালে পড়েই ব্যারাচ্যারা অবস্থা। এইগুলানকে ঘাস-ভুষি-নাড়া-মাড়ের যোগাড় দেয়া। গোলস করানো-দুধ দোয়ানো-মশা তাড়ানো-সবই সে এক হাতে সামলায়। বড় ভাই রফিকমিয়া ক্ষেত বর্গা করে। শফিকমিয়া ভাইয়ের সঙ্গে হাত-বাত লাগায়। আর ছোটভাই ইমানআলি একটু হাওয়া-বাতাসেই চলতে চায়। ইশকুলের নয় ক্লাসের পর আর কোনো ক্লাস সে ডিঙাতে পারে নাই। সারাদিন ঘরে বসে আয়না-চিরুনী হাতে নিয়ে চুপিচুপি টেরি কাটে। ইমানআলির চুলের সৌষ্ঠবের কথা ফুলতলীর বেবাকেই জানে। শুধু শীতের মরশুম এলে তাকে আর ঘরে পাওয়া যায় না। সে তখন ‘কমলাসুন্দরী অপেরা’ অথবা ‘গুনাইবিবি’ পালার সঙ্গে এই গাঁও সেই গাঁও করে বেড়ায়। ছোট-মোট দুই একটা পাট করে মনে মনে হিরো বনে যায়। আর যাত্রার মরশুম শেষ হলে রুখু-উখু চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ফের ইমানআলি ঘরবন্দি। তার হাতে আয়না-চিরুনী। এই নিয়ে বাপজানের কাছে মাইর-ধইর সে কম খায় নাই। রফিকমিয়া-শফিকমিয়াও বিচার সালিস কম বসায় নাই। কিন্তু ইমানআলির মুখে রা নাই। যেন সে জন্মবোবা। চড়-থাপ্পড়, বিচার-সালিসের সাধ্য কি ইমান আলির মুখে বোল ফোটায়?

বড়বোন জরিবানু কালে-ভদ্রে আমতলীতে আসে। অবশ্য বাপের বাড়িতে আসার ফুরসতও তার হয় না। নিজের ঘর-গেরস্থালীর পাক্কা গিন্নী সে। হাল-বলদ-ধান-চাইল ফেলে বাপের বাড়ি ঘন ঘন নাইওর করা তার হয়ে ওঠে না। পরীবানুও অবশ্য মনে মনে চায়-জরিবানু না আসুক। আমতলীতে এসেই সে পরীবানুর ইশকুল পড়া, শরীর-গতর, বিয়ে-শাদী নিয়ে পড়ে। ভরা মজলিশে দাদীজান বা মা মোমেনা খাতুনকে ধরে বসে-

‘পরীরে পাকনা বানাইয়া কি বিছন করবা নিহি? বিয়া-থা দিতাছো না কেরে? পড়াইবার লাগছো-বারিস্টার বানাইযা কি ওরে চাঙ্গে উডাইয়া থুইবা?’

জরিবানু এলেই পরীবানু একেবারে গুটিয়ে থাকে। বোনের এই বিষ কথার রহস্য সে ভালই বোঝে। জরির চেয়ে পরীবানু দেখতে সুন্দর। তার উপর জরির পেটে কালির অক্ষর একেবারে নাই। এইসব তাকে পীড়া দেয়। পরীবানু জরির সামনে পারতপক্ষে পড়তে চায় না। জরির কথায় মন খুব খারাপ হলে দাদাজানের বোনা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস টানে। তারপর বিড়বিড় করে বলে-

‘এইডা কি যে রহস্যের কতা! তুমিও বুইডা হইবার লাগছো আর আমিও সেয়ানা হইবার লাগছি।’

ফাঁক পেলেই মাটির ঘরে ঠাণ্ডা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে পরীবানু। ইমানআলির আয়নাটা মুখের সামনে তুলে ধরে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতভাবে সে নিজেকে দ্যাখে! এক চক্ষু ট্যারা করে হেসে বলে-

‘বুঝলা পরীবানু ওই বিরিক্ষি আর তুমি হইলা হমানে-হমান। হের ছায়া আছে-ফল আছে-কদর আছে। আর তুমার কিনা ঘুড়ার আণ্ডাও মূল্য নাই।’

নাজমা বেগম হঠাৎ ঘরে ঢুকে দেেেখ ফেললে বলে-

‘বিবিজানের বুঝি নিজেরে দেইখ্যা আর হাউস মিডে না। মিডায় লও-মিডায় লও। মিডায়া এট্টু কাজে-কামে আত-রত লাগাও।’

পরীবানু শরম পায়। আয়না লুকিয়ে ফেলে। তড়িঘড়ি নাজমা বেগমের সঙ্গে আনাজ-তরকারী কাটতে লেগে যায়। আনাজ-তরকারী কাটতে কাটতেই মনে মনে প্রার্থনা করে-

‘ও খুদা রাইত আহে ক্যান? রাইতেরে তুমি এই পিরথীমিতে পাডাও ক্যান?’

রাইত হইলো কুচকুইচ্যা কালা রাইত। রাইত হইলো ঘুটঘুইট্যা আন্ধার। এই রাইত খাইয়া ফেলায় মাইনষের হায়ার পর্দা। রাইত খসায়া ফেলায় মাইনষের মনের আবরু। রাইত হইলো চার পা-ওয়ালা মস্তপানা জন্তু। যে তার থাবার তলে চাপা দিয়া রাহে দিনের নিশানা। রাইতের আছে নদী সমান বিষ। বিষে বিষে সে ছয়লাব কইরা ফেলায় তামাম দুনিয়া!

পরীবানুগো মাটির একখানা মাত্তর ঘর। মাটির ঘরের উপর টিনের চালা। এই ঘরে রাইত ঢাইল্যা দেয় নদী সমান বিষ। দাদীজান এই ঘরের দেওয়াল জুইড়া আইক্যা থুইছে বিরিক্ষের ডাইল আর পাতা। আইক্যা থুইছে পক্ষীর পাখনা আর সর্পের নমুনা। ফলে ওই ডাইল আর পাতা চুঁইয়া আন্ধার ভয়ানক ঘন হইয়া ঘরের ভিতর ঢুইক্যা পড়ে। পক্ষীর গতরের ওম আর সর্পের বিষজর্জর হইয়া আন্ধার ঢুইক্যা পড়ে নাজমা বেগমের উরু সন্ধিতে। অথবা মোহিতন বেগমের কোমরের বাঁক ঘেষে ওই সর্প মস্তক নামাইয়া আশ্রয় খুঁজে! এই আন্ধারে রফিক মিয়া, শফিক মিয়া, ইমানআলির ঘুম ধরে কি ধরে না!

দাদীজান আন্ধারে ঘুমের ওমে হা কইরা শ্বাস টানে। যেন ভাঙ্গা বাঁশির সুর শোনা যায়। এই সুরে পরীবানুর ঘুম উড়াল দিয়া বসে কাঁঠাল গাছের পাতার মইদ্যে। আর ইমানআলি ঘুম-জড়ানো গলায় ‘গুনাই বিবির পালার’ বিরহের গান গেয়ে ওঠে! এইসব দেখে-শুনে পরীবানু নির্ঘুম রাত কাটায়। শফিকমিয়া নাজমাভাবীর ফিসফিসানো শুনতে শুনতে ভাবে-

‘আরেকডা ঘর না বানাইলে আর চলবো না। কিন্তু কেমতে বানামু? ট্যাকা কই?’

বাপজান ঘুমের ভিতর থেকে নাকি জেগেই হঠাৎ গলা-খাকারি দেয়। ঘরের ঘুমন্ত মানুষদের শুনিয়েই হয়তো বলে-

‘পরীবানুর বিয়ার আগেই একখানা ঘর তুলন লাগবো। কিন্তু ট্যাহা পামু কই জরির মা? ঘর তুলতেও ম্যালা ট্যাহা লাগে।’

পরদিন ভোরবেলায় পরীবানু লাল চক্ষু নিয়ে ইশকুলে যায়!

পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো?

পাতা, আমি পাতা কুড়োই!

আমতলী অবৈতনিক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের রাস্তাটা কি দিনকে দিন দীর্ঘ হয়ে উঠছে? নেভি ব্লু কামিজের উপর সাদা দোপাাট্টা ভাঁজ মিলিয়ে পড়তে পড়তে পরীবানুর এমনই মনে হয়। বটগাছের অজস্র ঝুরি ছোবল মেরে মাটি ফুঁড়ে ওঠা আলোকেও যেন সরিয়ে দিয়েছে। ফলে পাতাগুলো হয়ে উঠেছে কালচে সবুজ। নিচে জমে থাকা অন্ধকার আরো গাঢ় করে তোলা ছাড়া ওই পাতাদের আর কাজই বা কি? এই প্রায়ান্ধকার গাছের তলা দিয়ে যাতায়াতের সময় পরীবানুর বুকের ঢিপঢিপানি আজকাল আরো বাড়ে। এর অবশ্য কারণও আছে। চেয়ারম্যান রাজবআলির ছোট ছাওয়াল ছোটন পরিবানুকে দেখলেই বেসুরো গলায় গেয়ে ওঠে-

ভালবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে...

পরীবানু শুনেও না শোনার ভান করে। আসলে সে এইসব পাত্তা না দিয়ে নিজের পথে যেতে চায়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। মরিয়মের কাছ থেকে ছোটনের প্রেমের প্রস্তাব শোনার পর-পরই পরীবানুর সহজ যাতায়াত টলে উঠেছে। রাজবআলি চেয়ারম্যানের ছাওয়াল ছোটন তারে পাইতে চায়! শুনেই পরীবানু ভয়ে শিউরে উঠেছে-ওই বেডার বউডা না মাইর-ধইর সইতে না পাইড়া পলাইয়া গেল না! আর ছোটনমিয়াও মানু খুব সুবিধার না। মরিয়মের কাছ থেকে প্রস্তাবটা শোনার পর থেকেই পরীবানু দুই-একবার চোরা চোখে ছোটনকে দেখেছে। টকটকে লাল গেঞ্জি পরা। চুলের ছাঁট ঘাড়ের এতটাই উপরে যে তাকে গলা ছিলা মোরগের মতো দেখায়। ছোটনের ওইসব ভাব-ভঙ্গি দেখে পরীবানুর পেটের নাড়িভূড়ি ঠেলে বমি আসতে চায়।

দীর্ঘক্ষণ পেটে কোনো খাবার পড়ে নাই বলেই হয়তো সে বমি করতে পারে না! কিন্তু বমির গমকের ঠেলায় তার দুই চক্ষু জলে ভরে ওঠে। পরীবানুর কাছে সব কেমন আবছা আবছা ঠেকে। ইশকুলে থেকে বাড়ি ফিরেও সে বিষয়টা কাউকেই বলতে পারে না। বরং নতুন একটা বিষয় তার ভাবনা বাড়িয়ে দেয়-শফিকমিয়া নাকি কাঁঠাল গাছটা বেঁচে দেয়ার কথা বলেছে! গাছ বেচার টাকায় নতুন একটা ঘর উঠবে। ১৬-১৭ বছর ধরে বাড়ন্ত গাছটার দাম নেহায়েত কম হবে না। তবে ওই টাকায় সত্যি সত্যি ঘর তোলা যাবে কি না কে জানে? ঘর তোলা যাক বা না যাক গাছটা কাটা পড়বেই। কারণ ওই গাছ থাকলে নতুন ঘরের ডোয়া উঠানো যাবে না। শফিকমিয়া সঙ্গে নাকি রফিকমিয়াও একমত। একটা ঘরে এত্তগুলান মানু গাদাগাদি করে থাকা! এইসব শোনার পর থেকেই দাদীজান মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে-

‘আ-লো- এইডা অইলো বুইড়ার আতের শ্যাষ চিন। এইডা বেচনের কথা কেমনে ওডে। বেচন দূরে থাউক-কাডনের কথাই বা কেমনে ওড়ে?’

দাদীজানের মরাকান্নায় কেউ কান দিচ্ছে না। এদিকে ছোটনমিয়ার যন্ত্রণা নিয়ে বাড়ি ফিরে পরীবানু পড়েছে গাছ-কাটা-বেচা-ঘর-দোরের ভিতর! দাদীজানের মরাকান্না দেখে পরীবানুর মনটাও দুলে ওঠে-

‘গাছটা কাইটে ফেলালে দুয়ারের আর ছায়া থাইকব না। ছায়াছাড়া দুয়ার কেমন দেহাইব?’

পরীবানু দুই-একবার পাতা-ডাইলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে খোলা আসমান দেখার চেষ্টা করেছে-সফলকাম হয় নাই। বিষয়টা তার একেবারে মনপুত হয় নাই-গাছডা না থাকলে বাড়িটা ন্যাড়া হইয়া যাইব! শুধু এইটা না অন্য আরো কি যেন পরীবানুকে অস্থির করে তোলে! কি সেটা? জন্মাবধি সে এই গাছটাকে দেখছে বলে খুব চেনা মায়া-মমতা! নাকি দাদীজানের মুখ থেকে শোনা গল্পের মতো গাছটাও তার আপন হয়ে গেছে! পরীবানু যেন ধপ করে কোনো অন্ধকার গুহার ভেতর পড়ে যায়। যে গুহায় কোনো আলো নাই। হাওয়া নাই। থই নাই। পরীবানু তবু শূন্যে ভর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। উড়তে উড়তে সত্যিকার ঘুমের ভিতর ঢুকে পড়ে। ফের সে স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্নে ওই গুহাবন্দীই হয়ে পড়ে।

পরদিন ভোর ভোর উঠেই পরীবানু দেখে-কাঁঠালগাছ ভর-ভরতি করে কাকের মেলা বসেছে! এত্তগুলান কাওয়া এত্ত ভোরে আইলো কইথন? কাওয়ার বিরামহীন কা-কা পরীবানুর মনে কু ডাক দেয়। উঠানে পা দিয়েই পরীবানুর গায়ের লোম জারিয়ে ওঠে-কাঁচা-পাকা কাঁঠাল পাতায় উঠান ভরতি হয়ে আছে! এত্তগুলান পাতা পড়লো কখন? মরার কাওয়াগুলানের কা-কা হুইনাই কি পাতা ঝরবার লাগছে নাহি? নাকি পরীবানুর চক্ষের ভুল? বুকের ভিতরের ঢিপঢিপানিটা বেড়ে যেয়ে ভয়ানক কু ডাক ছাড়ে। এইরকম পাতার ঠেকি তো পরীবানু কুনু সুমুয়ই দেহে নাই। মা-গো কি যে অইব? কাটনের কথা হুইন্যা কি গাছডা কাইন্দা জারে-জার হইবার লাগছে? কাওয়ার দঙ্গল ফের ভয়ানক জোরে ডেকে উঠলে পরীবানুর চিন্তা কু-কু-কুয়ের ভিতর ঢুকে পড়ে। পরীবানুকে ওইরকম আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাজমাভাবী অবাক হয়। শলার ঝাঁড়ু দিয়ে পাতা জড়ো করতে করতে ননদকে ডাক দেয়-

‘কয়ডা পাতা থুপ বানায়া ইশকুলে যাও। বকরী-বাছুরের পেড ভরবো নে। হুকনা পাতা নাইকা-কমলা-সবজা পাতায় উডান ছয়লাব হইয়া গেছে-আশ্চয্যি কারবার!’

নাজমাভাবীর কথা পরীবানুর কানে ঢোকে কিনা বুঝা যায় না। হয়তো সে আপন মনেই বলে-

‘আইজকা জলদি ইশকুলে যাওন লাগবো। ছারে কইলো ফরমফিলাপ নাহি আইজকাই হইব।’

ইশকুলের কথা বলতেই ফের বুকের ভিতর ঢিপটিপানি শুরু হয়। মরিয়ম বেগমরে সে কাইল জবাব দিয়া দিছে-ওই রহম বখাইট্টা সিটিবাজরে মইরা গেলেও হ্যাঁ কইবো না।

কাওয়ার দঙ্গলের ডাকে পরীবানুর মন ফের কু ডাকে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁচা-আধপাকা পাতার রাশ-পরীবানু কি কেঁদে ফেলবে?

সত্যিই তো আরেকডা ঘর কত্তো দরকার। সাপের মতো বিড়া পাকাইয়া আর কতদিন কিলবিল করা যায়? ছানা-পোনা বিয়ানের খায়েশ হইলে কুত্তা-বিলাইও আড়াল-আবডাল খুঁজে।

আমতলী অবৈতনিক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েল ছুটির ঘণ্টা আজ তাড়াতাড়িই বাজে! আর ঠিক ভর দুপুরে কাওয়ার দঙ্গল বটের ডাইলে বইসা ঝিম পাড়ে। ফলে ছায়া আরো ঘন হয়ে নামে। ওই ঘন-সবুজ-ছায়াপথে ক্লান্ত বালিকার দল বাড়ির পথ ধরে। এই সময়ে ক্ষেতে-খামারেও মানুষ-জন কম। দুপুর মাথায় করে ঘর থেকে বাইরে বেরুবার মানুষও কম। ফলে রজবআলি চেয়ারম্যানের ছোট ছাওয়ালের শিকার ধরতে তেমন সমস্যা হয় না। ছর্‌রা বিদ্ধ কয়েকটা পঙ্খী উড়াল দিলেও বালিহাঁসটা মুখ থুবডে পড়ে। বোকা-সোকা বালিহাঁস! ছোটনমিয়ার ছুঁড়ে মারা নিশানা অব্যর্থ। পলাতক পঙ্খীদের দুই-একটা পালক তখনো ওই বটের ছায়ায় ওড়াউড়ি করে। হাওয়া অল্প বলে খুব বেশিদূর তারা উড়তে পারে না। শুধু হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় বোকা বালিহাঁসটা চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে দ্যাখে-বটের সব পাতা ঝরে ঝরে গাছটা একেবারে ন্যাড়া হয়ে গেছে!

পাতাকুড়োনীর মেয়ে তুমি কি কুড়োচ্ছো?

মানুষ, আমি মানুষ কুড়োই!

পরীবানু ওই রাতে নিখোঁজ ছিল। পরের দিন ইমানআলি তাকে বটগাছের তলায় পড়ে থাকতে দেখে। হয়তো কোনো যাত্রাপালা দেখা শেষ করে ভোর-ভোর সে বাড়ি ফিরছিল। পরীবানুর জ্ঞান ছিল না। সাদা সালোয়ারে চাপ-চাপ রক্ত দেখে ইমানআলি প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে ওঠে। ওই নিস্তরঙ্গ ভোর ইমানআলির চিৎকারে জেগে ওঠে। সদ্য গান থামানো পাখিরা ভয় পেয়ে উড়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তখন রফিকমিয়া, শফিকমিয়া, ইমানআলি বোনকে বাঁচাতে তৎপর হয়। আমতলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারের কথা শুনে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। পরীবানুর অবস্থা সঙ্কটজনক। মরণ-বাঁচন বলা মুশকিল। দাদীজান হাউমাউ করে কাঁদে। দুই হাত দিয়ে ভাঁজপড়া কপালে চাপড় মেরে বলে-

‘কুন মরারশুকা আমার এত্তবড় সব্বোনাশ করলো রে! হের মাতায় ঠা-ডা পড়বো।’

দাদীজানের সঙ্গে মা মোমেনা খাতুনও কাঁদে। কিন্তু কান্নার সময় তার বেশি নাই-গরু-বাছুর-বলদ-ছাগলের তালে দৌড়াতে হয়। একটা গাভী আর বকরী দুই-একদিনেই বিয়োবে। ফলে সঙ্কট মোমেনা খাতুনেরই-পরীবানুকে দেখবে নাকি গরু-বকরী সামলাবে?

জরিবানুও সংবাদ শুনে এসেছে। তার রাগ সবচেয়ে চড়া। গলা তুলে বলে-

‘কইলাম বিয়া দেও বিয়া দেও-না বারিস্টার বানাইবেন হেরা-এহন বোঝো ঠ্যালা। গেরামে ঢি ঢি পইড়া গেছে গা।’

জরিবানু আঁচলে চক্ষু মুছলেও মুখের চাপা আনন্দ মুছতে পারে না।

জরিবানুর কথা সত্য। কোনো ঘটনা জানতে বা বুঝতে আর কারো বাকি নাই। ওইদিন পরীবানুকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা মরিয়ম-রোমানা-আয়শা খাতুনের সামনেই ঘটেছিল। কিন্তু ওরা কি করবে? পরীবানুকে ফেলে ওরা পালিয়েছে। রফিকমিয়া আর শফিকমিয়ার মাথায় রক্ত টগবগিয়ে ফোটে। ইমানআলি পাকাবাঁশের লাঠি নিয়ে হম্বি-তম্বি করে-

‘খানকির পুলারে পাইয়া লই-মাইরা ফেলামু এক্করে।’

আমতলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার রিপোর্ট দিতে গড়িমসি করে শেষমেশ ইমানআলির লাঠির ভয়ে রিপোর্ট দিলে কেস হয় থানায়। রফিকমিয়া, শফিকমিয়া আসামীদের ফাঁসী চায়। এই চাওয়া নিয়ে উকিলের সঙ্গে আলাপ চলাকালে ফিসফিস শোনা যায়!

উকিল নিচু স্বরে বলে-

‘কেস-মেস কইরা ফায়দা কি? বুইনের ইজ্জত কি আর ফিরত পাইবেন?’

উকিল ফের বলে-

‘চেয়ারম্যানের লগে কতা হইছে। হেয় ক্ষতিপূরণ দিবার চায়। আপনেরা মামলা খারিজ কইরা ফেলান।’

রফিকমিয়া-শফিকমিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। শফিকমিয়ার চোখ চকচক করে-একটা নয়া ঘর! ঘর তুলতে পারলে নিজের বিয়াডাও সারন যায়। রফিকমিয়া ভাবে-সাপের মতো বিড়া পাকিয়ে আর কতকাল! নাজমা বেগম আইজকাল বেজায় সমস্যা করতাছে। একটা ঘরে এত্তগুলান মানু? কুত্তা-বিলাইয়ের জেবনও এর চাইতে ভালো।

ইমানআলি কথা বলে না। গুনগুন করে ‘ভেলুয়া সুন্দরীর’ সুর ভাজে।

জরিবানু শুনে বলে-

‘কেস মেসে কি হইব আর? পরীবানু কি পয়লা জীবন ফিরতি পাইব? ট্যাকা নিয়া কেস উডাইয়া নেও।’

নাজমা বেগম মৃদু স্বরে বলে-

‘ঘটনা যা ঘটবার ঘইট্যা গেছে গা। পরীবানুর ইজ্জত কি আর ফিরা পাওন যাইব?’

দাদীজানই শুধু মরাকান্না কাঁদে। বুড়ি কেন যে এত্ত কাঁদে! শফিকমিয়া জোরে ধমক মারে-

‘বুড়ি এত প্যানপ্যানাইও না। এহন বিপদের সুময়। খুদারে ডাহো।’

শেষমেশ ৩০ হাজার টাকায় রফা হয়। পরীবানুর ইজ্জতের দাম ৩০ হাজার ট্যাকা!

কালা কুচকুইচ্যা রাইত আসে। ওই রাইতের আন্ধারে রজবআলি চেয়ারম্যান আসে। তার হাতে তিনটা বান্ডিল। রজবআলি চেয়ারম্যান বাপজানরে বুঝায়। বাপজান রা করে না। শফিকমিয়া এগিয়ে আসে-

‘হেয় আর কি কইবো? যা কওনের আমাগো লগে কইন।’

‘না বাজান বুঝলা না-পোলাডা এট্টু বেয়াডা কিসিম জান-ই তো।’

‘চাচা আরেকডু বাড়াইলে অইতো না?’

‘হ বাবা অইতো। ৫ হাজার নিল ওই উকিলে-কেস উডাইব। আর হালার ডাক্তার কয়-হের নাহি হাত খালি-কি করি কও-হেরেও ৫ দিতে হইলো।’

দাদীজান কি যেন বলতে চায়-কিন্তু কান্নার চাপে তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। হয়তো সে বলতে চেয়েছিল-ছোটনের লগেই না হয় পরীবানুর বিয়াটা অথবা কুত্তার বাচ্চা তোর বেজন্মা পোলাডার মুহে মুইতা দেই!

দাদীজান শুধু কেঁদে চলে।

দিন সাতেক পর ভোরবেলায় ঘ্যাচ ঘ্যাচ শব্দে পরীবানুর ঘুম ভেঙে যায়। খুপড়ি জানলায় চোখ রেখে দেখে করাতিরা কাঁঠালের ডাল কাটতে শুরু করেছে। পরীবানু এখনো ভাল করে হাঁটতে পারে না। ফলে তার আর বাইরে বেরুনো হয় না।

ঘরের সবার চোখে-মুখে উজ্জল আলো-আরেকডা নয়া ঘর হইব। গাছে চইড়া কি জেবন কাটান যায়? যত্তসব বোকাগো কিসসা। আর পরীবানুই বা এমুন বেবুইদ্দা ক্যান? সাবধান হইয়া বাইর হয় নাই? মেয়ামানুগো সাবধানে চলতে হয়। খুপড়ি জানালায় দিয়ে ফের তাকালে পরীবানু কাঁঠাল গাছটাকে মাটিতে শোয়ানো দেখে। ওইখানেই হইব নয়া ঘর। পরীবানুর ইজ্জতের মূল্যও কি কম নাহি? ৩০ হাজার ট্যাকা!

এই ১৬-১৭ বছর বয়সেও পরীবানু যা দেখতে পায় নাই তা এখন দেখে-দাদাজানের মরণের দৃশ্য। অবশ্য দেখেই বা আর ফায়দা কি? পরীবানুর কাছে দাদাজান, কেটে ফেলা কাঁঠাল গাছ আর সে নিজে কখন যেন একাকার হয়ে গেছে...

কৃতজ্ঞতা :

গল্পের পর্ববিন্যাসে ব্যবহৃত কবিতার পঙ্‌ক্তি কবি আবুল হাসানের।

রচনাকাল- ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৯
৪৫৬ বার পঠিত
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করা এবং বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

লিখেছেন জ্যাকেল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের কাজ হলো সত্য প্রকাশ, জনমতের প্রতিনিধিত্ব এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার সাজিদ কমেন্ট অফ রাখায় এখানে লিখছি (সাময়িক)

লিখেছেন মিরোরডডল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৫


সাজিদের বিদায় পোষ্ট দেখলাম, কমেন্ট সেকশন বন্ধ রাখায় ভাবলাম এখানেই লিখে যাই।

জানিনা কি বলবো, হয়তো এটাই দেখা বাকি ছিলো।
চলে যাবার কারণ জানিনা কিন্তু অনুমান করতে পারছি।
Man! you shouldn't leave.

ব্লগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে যাচ্ছেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৭


আজকাল মানুষ চেনা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তা বুঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে এই কথা আরো বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কখনো বিদায় বলতে নাই

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



ব্লগে কিছুদিন ধরে অনিয়মিত হওয়ায় কখন কি ঘটে জানি না।
কিছুক্ষণ আগে মিররডলের একটা পোস্টে জানতে পারলাম , ব্লগার আমি সাজিদ ঘোষণা দিয়ে ব্লগ ছেড়েছেন । তার সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তীব্র নিন্দা জানাই

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৭



চাঁদগাজী একজন গ্রেট ব্লগার। তার তুলনা হয় না।
সামু তার সাথে বারবার অন্যায় করেছে। একটা দিন তাকে শান্তিতে ব্লগিং করতে দেওয়া হয়নি। সামুর ইতিহাসে তাকে সবচেয়ে বেশি বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×