somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দীপুমণি এখন কী করবেন? ------------------সিরাজুর রহমান

২০ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাগদাদের খলিফা হারুনর রশিদ তার সভাকবি আবু নূয়াসের সাথে বাজি ধরেছিলেন। আবু নূয়াস বলছিলেন হাসি অন্তর থেকে আসে, জোর করে সত্যিকারের হাসি কাউকে হাসানো যায় না। হারুনর রশিদ বললেন, মানুষকে হাসানোর আরো বহু উপায় আছে।
রাতের আঁধারে দু’জনে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ক্রীতদাস বস্তিতে হৃদয় উজাড় করা হাসি শুনে তারা থমকে দাঁড়ালেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ক্রীতদাস তাতারী তার প্রেয়সী বাঁদী রোকাস্সার সান্নিধ্যে অমন জগৎজয়ী হাসি হাসছিল। হারুনর রশিদ তাতারীকেই বেছে নিলেন নিরীক্ষার পাত্র হিসেবে।

রোকাসসাকে সরিয়ে নেয়া হলো বস্তি থেকে। প্রিয়তমার বিরহে তাতারীর হৃদয়ের হাসি শুকিয়ে গেল। প্রথমে প্রচুর বিত্ত-সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে, পরে নির্যাতন করে তাকে হাসানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু তাতারী আর হাসে না। বিরাট একটা ট্র্যাজেডি ঘটে গেল তার জীবনে। ষাটের দশকে বরেণ্য ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান কিছু দিনের জন্য লন্ডনে এসেছিলেন। বিবিসিতে আমার কর্মজীবনের তখন গোড়ার অধ্যায়। শওকত ভাই তাতারী আর রোকাস্সার করুণ কাহিনী অবলম্বনে আমার জন্য নাটক লিখেছিলেন, ‘ক্রীতদাসের হাসি’ নামে। এ নামে এবং একই কাহিনীভিত্তিক তার পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছিল।

বাংলাদেশে এ ধরনেরই একটা নিরীক্ষা চলছে এবং তার পরিণতিও ট্র্যাজিক হতে বাধ্য। একটা বদ্ধমূল আবেশ (অবসেশন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পেয়ে বসেছে। তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসতে এবং শ্রদ্ধা দেখাতে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে বাধ্য করবেন।
শেখ হাসিনার এই অবসেশনের সাথে আমি পরিচিত। তিনি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার পরপরই লন্ডনে এসেছিলেন। আমি বিশ্ব মিডিয়ার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেবো ভেবেছিলাম, যেমন ১৯৬৯ সালে তার পিতাকে আমি লন্ডনে কর্মরত ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশীয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথমেই আমি বিবিসির বার্তা কক্ষে তার সম্মানে একটা পার্টির আয়োজন করি। একপর্যায়ে আমার সহকর্মী জন রেনার ও আমি নেত্রীকে স্টুডিওতে নিয়ে যাই। জন ইংরেজিতে আর আমি বাংলায় তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সেদিন।

ইংরেজি সাক্ষাৎকারের শুরুতেই জন রেনার শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করেন দলের নেত্রী হয়ে তার কেমন লাগছে। তিনি বললেন, মোটেই ভালো লাগছে না তার, আসলে তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন না। বিস্মিত জন তখন জানতে চাইলেন তাহলে তিনি কেন দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। শেখ হাসিনা বললেন, তিনি রাজনীতিতে নেমেছেন প্রতিশোধ নিতে। ওরা তার বাবাকে মেরেছে, মাকে মেরেছে, ভাইদের মেরেছে, তিনি তার প্রতিশোধ নেবেন বলেই দলের নেত্রী হয়েছেন। ইশারায় জনের সম্মতি নিলাম, তারপর স্টুডিও ম্যানেজারকে বললাম রেকর্ডিং থামাতে। বাংলায় শেখ হাসিনাকে বললাম, তিনি এ ধরনের কথা বললে বাংলাদেশের মানুষ কি তা গ্রহণ করবে। তারপর ও প্রসঙ্গ বাদ দিয়েই আমরা আওয়ামী লীগের নতুন নেত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমার ভালো কথা কিংবা পরামর্শও শেখ হাসিনার ভালো লাগেনি।

আমার প্রায়ই মনে হয়, শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী থাকছেন অথবা বিরোধী দলের নেত্রী, তার রাজনীতি সব সময় আবর্তিত হচ্ছে তার প্রতিশোধ বাসনাকে ঘিরে। সব সময়ই তিনি বাংলাদেশের মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির সম্মিলিত কর্মপ্রয়াস, কিন্তু শেখ হাসিনার প্রতিটি কাজে জাতীয় ঐক্য বিধ্বস্ত হয়েছে, যারা সত্যিকারভাবে স্বাধীনতাকে ভালোবাসে দেশের মাটি, দেশের স্বাধীনতা, দেশের সার্বভৌমত্ব তাদের কাছে পূতপবিত্র। শেখ হাসিনা দম্ভোক্তি করেন যে তিনি দেশের এক নম্বর দেশপ্রেমিক। কিন্তু উপরিউক্ত সংজ্ঞার একটিতেও তিনি উত্তীর্ণ হবেন না।

ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। সে দেশের সাথে আমরা অবশ্যই সুসম্পর্ক চাইব। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে অন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সাথেও আমাদের সুসম্পর্ক প্রয়োজন। ভারতের সাথে সুসম্পর্কের বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অন্য কোনো শক্তির, বিশেষ করে এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের সাথে অসদ্ভাব সৃষ্টি করা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হবে। ভারতের সাথে একপ্রস্খ গোপন চুক্তি, ভারতকে করিডোর রেল সড়ক বন্দর ইত্যাদি সার্বভৌমত্বের প্রতীকগুলো দান করে দেয়ার উদ্যোগ বরং প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের স্বার্থ শেখ হাসিনার প্রধান বিবেচনা নয়। আরো প্রমাণের প্রয়োজন হলে ফারাক্কা চুক্তির প্রসঙ্গই বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি চুক্তি করেছেন, কিন্তু ভারত সে চুক্তি অনুযায়ী পানি দেয়নি বাংলাদেশকে। তার পিতা সংবিধান সংশোধন করে ভারতকে বেরুবাড়ী ছিটমহল দিয়েছিলেন, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ভারত এখনো তিনবিঘা ছিটমহলটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেনি। তার ওপরও সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম আকরিক পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন আরো প্রায় তিন শ’ একর জমি ভারতের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ বলে খবর পেয়েছি। টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সর্বনাশ ডেকে আনবে, কিন্তু সে ব্যাপারে শেখ হাসিনা ও তার সরকার নীরব। এ সরকার ভারতকে একের পর এক সব কিছু দিচ্ছে, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই আদায় করতে পারছে না। ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা তো লিখেছে ভারত কী চাইবে স্খির করার আগেই বাংলাদেশ সেটা দিয়ে দিচ্ছে।

দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ
দেশের ভেতরে পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্খার দলীয়করণ করে বর্তমানের তো বটেই ভবিষ্যতেরও সর্বনাশের ভিত্তি পাকা করে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই, নিরপেক্ষ বিচার বলেও কিছু নেই। এ অবস্খাকে একটি জাতি ও একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তার সাংবিধানিক অবস্খান যা-ই হোক কাজের দিক থেকে শেখ হাসিনা সব সময়ই বিরোধী দলের নেত্রী­ এক দিকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ, তার বিপরীতে শেখ হাসিনা ও তার সরকার।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মূল উদ্দেশ্য তার নিহত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবাসতে আর শ্রদ্ধা করতে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে বাধ্য করবেন­ যেমন করে শিশু ভাত খেতে অস্বীকার করলেও অবিবেচক মা জোর করে তাকে খেতে বাধ্য করেন। সে শিশু যেমন জবরদস্তি খাওয়ানো ভাত বমি করে ফেলে দেয়, জবরদস্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা গেলানোর চেষ্টায় যে জাতির সে রকম গা-বমি ভাব সৃষ্টি হতে পারে প্রধানমন্ত্রী সেটা বুঝতে চান না। এ কলাম আমি লিখতে বসেছি ১৫ আগস্ট তারিখে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বার্ষিকী উপলক্ষে আজ জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ১৯৭৫ সালের এ তারিখে তার হত্যায় খুব বেশি লোক অশ্রুপাত করেননি, যারা করেছিলেন আমি ও আমার স্ত্রী তাদের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তাতে মনে হয় বাংলাদেশী জাতির জন্য শোক দিবস পালনেরই বরং এখন বেশি প্রয়োজন।

লন্ডনের সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট পত্রিকা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের চতুর্থ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘বাপের নামে’। জোর করে প্রধানমন্ত্রীর পিতাকে ভালোবাসানোর চেষ্টা আলোচ্য প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘শেখ হাসিনার আক্রমণ এবং তাকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার করা’ বিস্ময়কর ছিল। তার দু’টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে প্রবন্ধে: বিশ্বজোড়া ড. ইউনূসের সুনাম শেখ হাসিনার পিতার সুনামকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল; আর ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন যেটা শেখ হাসিনা নিজে পেতে চেয়েছিলেন।

প্রবন্ধের বক্তব্য এই যে, পুনর্লিখিত সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এ সংবিধানের বেশির ভাগ পরিবর্তন করা যাবে না বলে বিধান রাখা হয়েছে। কেউ এ সংবিধানের সমালোচনা করলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা করা যাবে। এ সংবিধান সম্পর্কে অভিযোগ করার দায়ে বেগম জিয়াকে ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, নতুন সংবিধানের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদ্ধতি বাতিল করা। ‘সুপ্রিম কোর্ট সামাজিক অশান্তির উসকানি এড়ানোর উদ্দেশ্যে আরো দু’টি সাধারণ নির্বাচন এ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিরোধী দলে থাকাকালীন শেখ হাসিনা এ পদ্ধতির জন্য জেদ ধরেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলের ফলে ২০১৩ সালে ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া সম্বন্ধে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’

নির্বাচন বয়কট ঘটানোর প্ররোচনা
ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘দু:খের বিষয়, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক আচরণ থেকে মনে হয় তিনি বিরোধীদের দলন করে নির্বাচন বয়কট ঘটানোর প্ররোচনা দিতে এবং সে লক্ষ্যে জ্বালাতনকারী সমালোচকদের নিস্তব্ধ করে দিতে চান।’

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সর্বসম্মতিক্রমে (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়া) একটা সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও তিনবার সে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। সে প্রক্রিয়া তার জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং সে জন্য কেউ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনেনি। তার পিতার যে অধিকার ছিল অন্য নাগরিকদের সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করাকে গণতন্ত্র বলে না।

সংবিধান মানুষের জন্য। মানুষের চাহিদা ও চিন্তাধারা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত ও বিকশিত হচ্ছে। সে অনুযায়ী সময় সময় সংবিধান সংশোধন কিংবা পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। ব্রিটেনে কোনো লিখিত সংবিধান নেই, প্রয়োজন বিবেচনা করে সাংবিধানিক রীতি-পদ্ধতিগুলো অজস্রবার পরিবর্তিত হয়েছে। এ দেশে যে গণতন্ত্র সফল হয়েছে তার কারণ এই পরিবর্তনযোগ্যতা। বাংলাদেশের নতুন লিখিত সংবিধান যে পরিবর্তন ও সংশোধনের পথ বন্ধ করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে তাতেই প্রমাণ হয় যে সেটা একটা জাতির প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী নয় এবং সে কারণে এ সংবিধান গ্রহণে আপত্তি অন্যায্য নয়। বস্তুত সাধারণ বুদ্ধিতে বলে একটি সংবিধান ভবিষ্যতে সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন নিষিদ্ধ করার অধিকার কোনো সংসদেরই থাকা উচিত নয়।

ইকোনমিস্ট আগের সপ্তায় আরো দুটো প্রবন্ধ ছেপেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘অতীতের অপব্যবহার’। কিন্তু ‘আলিঙ্গনযোগ্য তুমি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি বিশেষ করে সরকারের অসহিষ্ণুতার বারুদে দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকেছে বলে মনে হয়। অতি সংক্ষেপে সে প্রবন্ধের সারকথা হচ্ছে ভারতের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর অপরিমেয় পরামর্শের সাহায্যে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। তারপর থেকে দুই দেশের ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়েছে। ভারত যা চায় তাই পাচ্ছে, উগ্রপন্থীদের দমন করে বাংলাদেশ ভারতের প্রীতির বিশেষ কারণ ঘটিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোরদানের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রবন্ধে। বলা হয়েছে হিমালয়ের ওপর চীনের সাথে বিবদমান সীমান্তে ভারত তার সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছে এবং সেখানে অস্ত্রশস্ত্র যাবে বাংলাদেশের ভেতরের করিডোর দিয়ে। চীন সেটাকে ভালো চোখে দেখবে না। প্রবন্ধে বাংলাদেশের বিচার পদ্ধতি সম্পর্কেও কটাক্ষ করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আসল লক্ষ্য হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করা।

মারাত্মক ঘনিষ্ঠতা ও মৃত্যু চুম্বন
বাংলাদেশের বিগত ছয়-সাত বছরের ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞানও আছে ইকোনমিস্টের বক্তব্যগুলোর কোনোটিতে তারা সামান্যতমও বিস্মিত হবেন না। ২০০৫ সাল থেকে ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ঘন ঘন সুধা সদনে গেছেন। তার উত্তরসূরি পিনাক চক্রবর্তী একই ধারা বজায় রেখেছিলেন। সেসব স্বাভাবিক কূটনৈতিক আচার-আচরণের মধ্যে পড়ে না। তারা কি ঘোড়ার ঘাস কাটতে সুধা সদনে যেতেন? ২০০৬ সালের লগি-লাঠি-বৈঠা দিয়ে দেশ অচল করে দেয়ার সময় ভারতের অঢেল অর্থ এবং র-এর লাখ লাখ বেতনভুক এজেন্ট বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সে সময় পিটিয়ে যে আটজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি তার বিচার হওয়া উচিত বলে সুয়োমোটো অভিমত দেননি। অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে শেখ হাসিনা নিজ মুখে তার ‘আন্দোলনের ফসল’ বলেছেন। সে সরকারের পেছনের সত্যিকারের পাওয়ার হাউস জেনারেল মইন ইউ আহমেদের ভারত সফরও অস্বাভাবিক এবং বিস্ময়কর ছিল। মইন ইউ যেভাবে ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে গোপন বৈঠক করেছেন এক দেশের সেনাপ্রধানের অন্য দেশে গিয়ে সে ধরনের আচরণ কূটনৈতিক শালীনতার সম্পূর্ণ বিরোধী।

এসবের ফল ছিল বিগত সাধারণ নির্বাচন। সে নির্বাচনের পটভূমি বিশ্লেষণ করা যাক। লোক দেখানো ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা পরিত্যাগ করে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকার ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা গ্রহণ করে। তার লক্ষ্য ছিল খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া এবং বিএনপিকে ধ্বংস করা। সরকার বেগম জিয়াকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানোর সব আয়োজন সমাপ্ত করে ফেলেছিল। সে চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর এবং তারপর বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ষড়যন্ত্র হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা যেভাবে সংলাপ প্রক্রিয়া থেকে বিএনপিকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তখনো তার প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় বিপুলসংখ্যক বিএনপির তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, গোয়েন্দা সংস্খা বিএনপিকে ভোট না দিতে ভোটদাতাদের এবং ভোট কেন্দ্রে না যেতে বিএনপির অ্যাজেন্টদের ভয় দেখিয়েছিল বলে তখনো অভিযোগ শোনা গিয়েছিল। সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পেয়েছিল, তাতে তাদের প্রায় এক শ’ আসন পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ দলকে মাত্র গুটিকয় আসন দেয়া হয়। তখনো কেউ কেউ বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও দেশজোড়া একটা মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী যেন অঙ্ক কষে বিএনপিকে কয়েকটা আসন দেয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় মোট ভোটার সংখ্যার চেয়েও বেশি ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। তাই ইকোনমিস্ট কোনটা অন্যায় বলেছে?

ভারতের সাথে অতিমাত্রিক ঘনিষ্ঠতা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক মনে হয়নি, এমন লোক বাংলাদেশে ক’জন আছে? গত বছরের জানুয়ারি মাসে দিল্লি গিয়ে শেখ হাসিনা ক’টা চুক্তি করে এসেছেন তার সঠিক সংখ্যাও বাংলাদেশের মানুষ জানে না। কোনো চুক্তিরই বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের সংসদ তাদের সংবিধানে বিধান করেছে যে বিদেশের (ভারতের) সাথে কোনো চুক্তির বিবরণ প্রকাশ করা যাবে না। এই গোপনীয়তার কারণ কী? আমরা এখন ক্রমে ক্রমে যা জানতে পারছি তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। করিডোর আর ট্রানজিট মিলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে ১৫টি পথ দেয়া হচ্ছে বলে গত সপ্তাহে জানতে পেরেছি।

করিডোরের তাৎপর্য বাংলাদেশের মানুষ সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছে কি? প্রস্তাবিত এই করিডোর দিয়ে ট্রাক ও ট্রেনযোগে অস্ত্রশস্ত্র আর সেনা যাবে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে। চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধারা কি আগেভাগে সেসব অস্ত্রশস্ত্র দখল করতে কিংবা ধ্বংস করতে বাংলাদেশের ভেতরে আসবে না? দুটো-একটা ট্রাক বিস্ফোরিত হলে ঘনবসতি বাংলাদেশের অপরিমেয় ক্ষতি হবে। সেসব ধ্বংসাত্মক কাজ বন্ধ করার অজুহাতে ভারত কি বাংলাদেশের ভেতরে সৈন্য পাঠাতে চাইবে না?

সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটার কথা ইকোনমিস্টের প্রবন্ধেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে চীনের প্রতিক্রিয়া। অরুণাচলে বিশাল এলাকা নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে বিরোধ আছে। ১৯৬২ সালে সেখানে দুই দেশের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল। বিগত কয়েক বছরে উভয় দেশই সেখানে সমরশক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। অরুণাচলে যদি যুদ্ধ আবার শুরু হয় তাহলে চীন ভারতের সরবরাহ পথ বন্ধ করে দিতে বাংলাদেশের ভেতরে আক্রমণ চালাবে না? বাংলা প্রবাদেও আছে যে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখড়ের প্রাণ যায়।’ তেমন অবস্খায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে।

উন্মাদ গালাগাল আজেবাজে কথা
আসল সত্য প্রকাশ করে দেয়ার কারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণি ইকোনমিস্টের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশের প্রতিবাদ ছাপা না হলে তিনি ইকোনমিস্টের বিরুদ্ধে ‘অন্য ব্যবস্খা’ নেবেন। ইকোনমিস্ট সে প্রতিবাদ অনলাইন সংস্করণে রেখেছে, মুদ্রিত সংস্করণে ছাপেনি। কিন্তু দীপুমণি কী ব্যবস্খা নিয়েছেন সে জন্য? ইকোনমিস্ট বিশ্বব্যাপী পঠিত এবং সম্মানিত সাময়িকী। সেটা যে শেখ হাসিনার সরকারের ভয়ে তটস্খ বাংলাদেশের কোনো পত্রিকা নয় তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গিয়েছিলেন। আসলে বাংলাদেশ সরকার যে অসহায় সেটা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রলাপধর্মী গালাগালিতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের পেছনে জঙ্গিবাদ, মাদক ও অস্ত্র বিক্রির অর্থ রয়েছে। অসহায় এবং উপায়ান্তরবিহীন বলে কেউ কেউ এ রকমেরই আজেবাজে কথা বলে।

এ দিকে এটা পরিষ্কার বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক কিছু চুক্তিতে রাজি হয়েছেন শেখ হাসিনা এবং সেসব চুক্তিতে সই করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকায় আসছেন ঈদের পরপরই। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বিলম্বে হলেও ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধী কোনো চুক্তি তিনি অনুমোদন করবেন না। অর্থাৎ তার দল ক্ষমতা পেলে সেসব চুক্তি মানতে তারা বাধ্য থাকবেন না। কিন্তু চুক্তিগুলো বলবৎ হয়ে গেলে সেগুলো নাকচ করা কত কঠিন কাজ সবাই বোঝেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করা কোনো মতেই বাংলাদেশের মানুষের উচিত হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের স্বীকৃত চুক্তিগুলো সম্পর্কে যে তাদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস আছে, তারা যে খালেদা জিয়ার সাথে সম্পূর্ণ একমত সেটা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই জানতে দিতে হবে। শুনেছি কেউ কেউ সেপ্টেম্বরের ৬ ও ৭ তারিখে হরতাল করার কথা ভাবছেন। হরতাল না হলেও ওই দুই দিন দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল করা যেতে পারে। আর দেশের সব মানুষেরই উচিত হবে ওই দুই তারিখে বাম বাহুতে কালো ব্যাজ পরে, অন্তত বাম কাঁধে কালো ফিতা পরে অশুভ চুক্তিগুলো সম্পর্কে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করা।

[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৯/০৮/১১]
Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×