ছোট থেকেই "বদনা" জিনিষটা আমাকে খুব আকর্ষন করতো।ছোটবেলার অনেকগুলি খেলার মধ্যে খুব প্রিয় একটা খেলা ছিলো,বদনায় পানি ভরে গাছের গোড়ায় পানি ঢালা।একটা বদনায় বারবার পানি ভরা ঝামেলা মনে হওয়ার মাঝে মাঝেই বাসার সবগুলি বদনায় একসাথে পানি ভরে গাছের গোড়ায় ঢালতাম।বদনা দিয়ে গাছে পানি ঢালার মধ্যে যে নির্মল আনন্দ পেতাম তা বোধকরি একমাত্র, কোন বাসার দেওয়ালে লাল রঙে বড় বড় অক্ষরে লেখা,"এখানে পশ্রাব করা নিষেধ"লাইনটির মধ্যে প্যান্টের জিপার খুলে ছ্যাড় ছ্যাড় শব্দে স্বগৌরবে তলদেশের চাপ হালকা করার আনন্দের সাথেই তুলনা করা যায়।আমার বদনা প্রীতির কারনে বাসার মানুষজনকে প্রায়ই হ্যাপা পোহাতে হতো; বিশেষ করে সকালবেলায়।
বদনা নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতিতে বিরক্ত হয়ে একদিন মা সবার সামনেই বদনা নিয়ে হালকা দুইটা গাট্টা মেরে মাথায় মাঝারী সাইজের একটা আলু গজিয়ে দিয়েছিলো।সে অপমানের প্রতিশোধ নিতে পরদিন খুব ভোরে বাসার সবগুলি বদনা চুরি করে রাস্তার পাশে ড্রেনে ফেলে দিয়ে আসলাম।সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে বাবা,মামারা প্রাত্যকৃত্য সারার জন্য কমোডে বসার পর খেয়াল করলো বদনা নামক শৌচবাটি টা টয়লেটে অনুপস্থিত।ছোটমামার অবস্থা ছিলো সবচেয়ে শোচনীয়।বদনা আছে কি না তা ভালোমতো খেয়াল না করেই অর্ধেক কর্ম সেরে ফেলেছিলো।পানি নেবার সময় বদনার দিকে হাত বাড়িয়ে যখন বদনার জায়গায় এক খাবলা বাতাস হাতের মুঠিতে আবদ্ধ করলো তখন অনুভব করলো জায়গায় বসে চীৎকার দেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নাই।ছোটমামার চীৎকার শুনে বাসায় অনিরাপদ বোধ করায় মানে মানে বাসার গেট দিয়ে বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিলাম।গেটের সামনে গিয়ে পিছনে একবার চোখ ফেরাতেই দেখি বাবা উদভ্রান্তের মতো উদ্বাহু নৃত্য করতে করতে ছুটে আসছে আমার দিকে।বাবাকে দেখে তখন খালাতো বোনের কাছে শোনা শীর্ষেন্দুর গল্পের একটা ক্যারেক্টার,'জগাই পাগলার' কথাই বারবার মনে পড়ছিলো।নিশিচন্দপুর গ্রামের উসকোখুশকো চুলের,বোশেখ মাসের কাঠফাঁটা রোদ্দুরেও তালিমারা বিদঘুটে রঙের কোট পরা, বড় বড় লাল চোখে তাকিয়ে থাকা জটাধারী জগাই পাগলার সাথে বাবার কোন অমিল খুজে পাইনি সেদিন।
অত্যাধিক বদনা প্রীতি দেখেই অথবা বদনার ঝামেলা থেকে রক্ষা পেতেই কি না কে জানে, একদিন বাবা দোকান থেকে লাল রঙের ছোট একটা খেলনা বদনা কিনে এনেছিলো আমার জন্য।বদনার শরীরে ছোটছোট অক্ষরে লেখা ছিলো,"রবিউল।ফুলবাড়িয়া ঢাকা।"তখন ভেবেছিলাম রবিউল ফুলবাড়িয়া নামের কেউ হয়তো আমার জন্য এই বদনাটা বানিয়ে দিয়েছিলো।এজন্য প্রায়সই তাকে ধন্যবাদ জানাতাম মনে মনে।নতুন বদনা পাওয়ার পর আমার আনন্দ দেখে কে!। সকাল-বিকাল পুরো দিনরাত জুড়ে বদনাই আমার ধ্যানজ্ঞ্যান হয়ে উঠলো।সকালে ঘুম থেকে উঠেই বদনায় পানি ভর্তি করে দৌড়াদৌড়ি,দুপুরে খাওয়ার সময় লাল রঙের ছোট বদনাটাকে পাশে বসিয়ে ভাত খাওয়া,রাতে ঘুমাবার সময় বদনাকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরা।ধীরে ধীরে আমার পুরো জগৎটাই বদনাময় হতেশুরু করলো....................
আজকে স্টোররুমে পুরানো জিনিষপত্র ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো ছোটবেলার সেই বদনাটা।সারাগায়ে ধুলোময়লা আর মাকড়শার জাল মেখে ঘরের এককোনে নিতান্ত অবহেলা অযত্নে পড়ে আছে।বদনা নিয়ে বাথরুমে ভালো মতো ধুয়ে নিজের ঘরে এসে খেয়াল করলাম এতদিনের অবহেলার দরুন অভিমানে শরীরের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলেছে অনেকখানি।কিন্তু শরীরে খোদাই করা "রবিউল ফুলবাড়িয়া ঢাকা" নামটা এখনও আগের মতোই স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করছে................
বদনাটা হাতে নেওয়ার পর থেকে বারবার মনে হচ্ছে,স্মৃতি তুমি রবিউল কোম্পানীর বদনা..............
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ৩:০৪