ঠিক আছে, লাফাও
অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেম কাচের জানালা খুলে কুড়ি তলা থেকে
বাতাসে ঝাঁপাও তুমি টাঙাইল আঁচল উড়িয়ে
শূন্যে ভাসবে কালো ঢাল এলোকেশ
দু পায়ে আচেনা নাচে পৃথিবীর রঙিন মাটিতে
নেমে এসো তুমি
তখন খামচে দেখো হাওয়ার শরীর কীরকম
খেলবে তোমাকে নিয়ে ওলোট-পালোট
আমার পায়ের কাছে পড়ে তুমি ছত্রখান হও
খণ্ড-বিখণ্ড হাড় থ্যাঁতা মাংস নাড়িভুঁড়ি সব একাকার
ঠোঁট যোনি উরু নাভি পাছা স্তন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে
সৌন্দর্য বিমূর্ত ক্বাথে মাছির খোরাক হবে তুমি
সব জড়ো করে তবু তুমি নও
তুমি সে-সময়ে রৌদ্রে ভাসমান
বুঝেছিলে মিথ্যে এই প্ররম্ভিক অধঃপতন ।
২১ আষাঢ় ১৩৯২
-----------------------------------------------------------------------------
শিল্পোন্নয়ন
এ কী তুমি এইখানে পাগলাগারদে
পায়েতে শেকলবাঁধা নেয়ারের খাটে
উদোম উলঙ্গ শুয়ে আছো চুলে জট
নোংরা নক বেড়ে গেছে দুচোখে ঢুলুনি
সারাঘর বমি মুত পায়খানা ভরা
ভাতমাখা এনামেল থালা এককোণে
শরীর ধোওনি জলে নেমে কতদিন
চেনাই যায় না এককালে পাঁচতারা
হোটেলে নেচেছ নাভি নিতম্ব কাঁপিয়ে
আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচব সকলে তুর্কি গাঁজা-ভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নামে যাক ।
২১ শ্রাবণ ১৩৯২
---------------------------------------------------------------------------
বিজ্ঞানসন্মত কীর্তি
ফ্যান টাঙাবার ওই খালি হুক থেকে
কন্ঠে নাইলন দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ো
কপাট ভেজিয়ে দরোজার চুপিসাড়ে
উঁচুতানে রেডিও চালিয়ে তাড়াতাড়ি
শাড়ি শায়া জামে খুলে টুলের ওপরে
দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস-রশি পরে নিও
সারারাত অন্ধকারে একা ঝুলে থেকো
চোখ ঠিকরিয়ে জিভ বাইরে বেরোনো
দুপাশে বেহঁশ দুই হাত আর স্তন
জমাট ষোড়শি শূন্য পায়ের তলায়
পৃথিবীর ধরাছোঁয়া ছাড়িয়ে যেখানে
বহু পুরুষের ঠোঁটে আদর খেয়েছ
সে-শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ
দোলো লাশ নামাবার জন্য আছি আমি ।
১৯ শ্রাবণ ১৩৯২
---------------------------------------------------------------------------
সুফিয়ানা
এ কেমন ক্রিমতোলা বাংলায় কথা কোস তুই
যে ভেলকিবাজ রোদের ভয়ে ঝরে পড়া শিউলিফুলগুলো
পাখিদের রোমান্টিক গানকে নার্ভাস করে তোলে
যেন হাঁ-মুখে নার্সের থার্মোমিটার
দোলের দিন ডেকে-ডেকে হাঁপানি ধরে গেল কোকিলটার
আসলে তোর কেন মতামতহীন হবার আধিকার নেই
একটা হ্যাঁ-এর সঙ্গে একটা না মিশিয়ে তখনই জানা যায়
যখন প্রেমের ক্লাইম্যাক্সে মাটির সঙ্গে আমি যোগাযোগ হারাই
শাঁতার কাটবার মতন তোর গভীর টলটলে সংলাপে
যে-দিন জিরে-জিরে করে কুচোনো বিদ্যুতের সবুজ জোনাকি
ঘোড়াহিন রেসের মাঠে তোকে ঘিরে বেশরম হ্রেষা হয়ে উড়বে
ইরানি হরফে তোকে প্রেমপত্র লিখে রাখবে বটগাছের শেকড় ।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০১
----------------------------------------------------------------------------
দালাল
এ কী কুলনারী তুমি জাহাজঘাটায় দেহ বেচতে এসেছো
লুঙি-পরা পানখোর দালাল রাখোনি
সাদাপোষাকের কবি শরীর ঝাঁঝরা করে দেবে
শাঁখা-নোয়া খুলে তারা দুহাত হিঁচড়ে টেনে তুলবে লরিতে
লকাপে ল্যাংটো মাঝরাত.....সে-সময়ে গেয়ো তুমি রবীন্দ্রসংগীত
ছিহ কুলখুকি তুমি সবায়ের আদর কুড়োও
যারতার সাথে গিয়ে যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ো
চারিদিকে কটাচোখ ধ্রুপদী জোচ্চোর সব নজর রাখছে মনে রেখো
আমি তো স্ট্রেচারবাহী কিছুই করতে পারব না
হয়তো টিফিনবাক্সে এনে দেব রুটি আর আলুজিরে ভাজা
গান শোনাবার মাঝে ঝুঁকে-ঝুঁকে পয়সা কুড়োবো
ভোর হলে গঙ্গার পাড়ে তুমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বমি কোরো
হাসপাতালেতে পাবে বেডপ্যান গ্লুকোজ বোতলে জল
তালচিটে বিছানায় পাশে শোয়া ঘুমন্ত কুকুর ।
১৭ অঘ্রাণ ১৩৯২
----------------------------------------------------------------------------
বজ্রমূর্খের তর্ক
আজকে শুক্কুরবার । মইনে পেয়েচি । বোধায় শরতকালের পুন্নিমে ।
পাতলা মেঘের মধ্যে জোসনা খেলচে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাত নেড়ি-কুকুরের দল
ঘেউ ঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
কেধ তো বিশ্বাস করবে না । ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতকাল ।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা-বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন ।
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করিচি বুঝি ।
যা কইনি, সেকথা বলিচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
কেন এই মাইনে পাওয়া? কেন গান ? কেন তাড়ি ?
আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
২৭ আষাঢ় ১৩৯২
---------------------------------------------------------------------------
প্রিয়তমার নিলাম
বিশল্যকরণী বলে কিছু নই শেষ ওব্দি লক্ষ্মণের লাশ
রাবণের মর্গে পড়ে ভেটকে উঠেছিল
ভিড়ের দড়ির টানে
খর্ব অপুষ্ট জরাক্লিষ্ট মুখে কাঠের জগড়োনাথো ফিরেছে স্বস্হানে
ওরকম মুখ বুজে থাকব বলে আসিনি এখানে আমি
গন্ধমাদন কাউকে ল্যাজ তুলে আনতে হবে না
কেননা ভূমিষ্ঠ হয়েই মাটি কামড়ে ধরেছি কষদাঁতে
শীতকালে কেন ফিকে ন্যাপথালিনের গন্ধ মানুষীর নিশ্চুপ স্তনে
যে-মুখে রেখেছি হুল লেহনে বোটকা স্মৃতি বৃক্কে নেমে যাবে
ফেরারির অগ্নিচোখ অর্জন করেছি শ্রমে
বল্লম ধরার আগে আঙুলের খাঁজ হেজেছিল
বাতাসে বাবরি উড়বে চ্যাঁচাব দুখাঁধ তুলে
বুকের ওপরে দুই হাতা ঘুষি আছড়ে বলব বারবার
অগ্নি সংযোগ করো শান্তিভঙ্গ হোক ছারখার করো
ক্রন্দনরত কারা গুঁড়ি মেরে এলোচুলে ঘোর অন্ধকারে
শানাচ্ছে কুখরির ডগা উল্কাপাথরে ঘষে একটানা সুরে
টিকটিকিদের ল্যাজ আছড়াবার ক্ষীণ শব্দ
ঝড়ের ধুলোয় নাকে জ্বালা ধরে
মুখেতে রুমাল বেঁধে নিঃশব্দে ঘোড়া থেকে নামি
যে-রকম কথাছিল আবার এসেছি আমি নিলামের দাক দিতে
এইবার সবচে বেশি দাম ধরে দেব
মাত্র দু-পাঁচশো নয় কিংবা মাসখানেকের জন্যে ঘানির মজুরি
তুমি ধ্বংসধ্বনি খুকি
ভবিষ্যৎ থকথকে হারামরক্তে ডুবে আছে ।
১১ বৈশাখ ১৩৯২
---------------------------------------------------------------------------
বাজারিণী
ত্রিশ বছরের পর এলে তুমি । তোমার আদুরে ভাষা পালটে গিয়েছে
বারবার । জানি তুমি শুভ্রা রায় নও । ওরকমভাবে একঠায়ে
সারাদিন মাথানিচু করে বসে থাকো । আমার চুলেতে পাক
ধরে গেছে । শেখাও তোমার ভাষা এইবার । দেখি কীরকম
ঠোঁট নড়ে । নাভি খিল-খিল কেঁপে হেসে কুটি হয় । যুবকেরা
ঘিরে থাকে বহুক্ষণ তোমায় আড়াল করে । কিসের কথা যে এতো হয়
কিছুই বুঝি না । অন্তত কুড়ি বছরের ছোট হবে তুমি ।
জানি না কাদের জন্যে অন্ন আনাজ সংগ্রহে আজ এলোচুলে
নেমেছ বাজারে । লুবাতাসে রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাবে শেষে ।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কী্যাবে বাসায় ফেরো ? ওই যুবকেরা
ছাতা ধরে মাথার ওপরে? বাড়ি ফিরে ভিজে চুল বোধহয় শোকাও একা ।
সকালে কি রান্না করে আসো ? সেগুলোই রাতে খাও?
শরীর খারাপ হলে কারা দ্যাখে? কে কাপড় কাচে?
আমার সন্ত্রাসবাজি রাহাজানি লুটমার থেকে জানি তোমার দুনিয়া
আলাদা একদম । তোমাকে নিজের নাম বলতে পারি না আমি ।
যদি ঘেন্না করো । জেনে যাও কী-কী করি, ভয় পাও ।
কতদিন ইচ্ছে হয় সামান্য ইশারা করে আমার দলের লোকেদের
তোমাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিতে বলি ।
দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি । বলবে, 'আমাকে যেতে দিন' ।
২৮ আষাঢ় ১৩৯২
------------------------------------------------------------------------------
বাকদানো
তোদের তো বলিছিলুম বাবা কিন্তু তোরা গা কল্লিনে
তবলা-বাজিয়ের কানে আওয়াজের আগেই য-ভাবে বোল ফোটে
অ্যাগবারে তেমনিই য-দিকে মাথা করে শুই সে-দিকেই কেন সূয্যি ওঠে জানিনা
আমাদের যুধিষ্ঠির, সেই যে, পাশাখেলার গ্র্যাণ্ডমাস্টার
বেতলা ফরেস্টে দ্রোণাচার্যের সেমিনারে অর্জুনকে ধাতানি দিয়েছিল
'পা নাচিয়ে কক্ষুনো নাচবিনে, সব্বোদা বাতাস নাড়িয়ে নাচবি'
তোদের ওদিকটায় তো সভ্যতা মানেই শহর, কী, ঠিক বলিচি না?
জ্বরের ঘোরে-বলা প্রলাপগুলো খানিক পরেই দেখবি তথ্য হয়ে গেচে---
কাব্যি করে বলতে হয়, 'ওগো এ যে গোঁজবঙ্গের পালতোলা শামুক ভাসিয়েচো'
যখুন দুঃখকষ্ট চেপে যেতে শেখার বয়েসে পৌঁছোলুম, অ্যাঁ
ঘুমন্ত অবস্হায় যে-পাখিটা বিপদে পড়েচে তার মাঝরাতের ডাকে
দেহের বিতর্কিত জায়গায় হাত দিয়ে ফেলার ভয়ে আমি তো থরহরি
বিড়ির শেস-ফুঁকের আয়েস টেনে মেয়েটি যখুন পোনয় নিবেদন কল্লে
একাধটা অঠ্গকে বিশ্বেস করা মুশকিল হয়ে পড়েছিল রে
তা, সবাই তো আর সবায়ের ব্যথার গন্ধ টের পায় না
এ-বাড়ির ঘড়িগুলোকে দ্যাখ, বড্ড অধীর, সবুর করতে পারে না;
কী করি ? আমি তো পাহাড় থেকে ঝাঁপ-দেয়া ঝর্ণার ফূর্তি দুমুঠোয় পুরে
মৌমাছিদের রানিটাকে নিয়ে বরযাত্রীদের সঠ্গে চুপচাপ কেটে পড়লুম...
১১ আগস্ট ২০০০
----------------------------------------------------------------------------
পরবর্তী সর্বনাশ
পাহাড়ের বাঁকে ট্রেন দেখা গেছে যাও
এইবালা ঘুমে অচেতন গৃহস্হালি
ফেলে ছোটো মাথা পেতে দিতে রেলপথে
এরপর রাতে আর কোনো ট্রেন নেই
পিষে কেটে ছটুকরো হয়ে যাও তুমি
শাঁখা পলা গুঁড়ো হয়ে মিশুক মাটিতে
তলপেটে রাখা ভ্রুণ নিসর্গে ফিরুক
ত্রেনের পয়ার ছন্দে নিজেকে ভুলিয়ে
তোলপাড় করে দাও সুখের সংসার
ভয় দুঃখ শোক গ্লানি দিয়ে বন্ধ করো
অমল আনন্দ শেষ হোক ভাঙা ঘুমে
দুহাত বাড়িয়ে সারারাত রেলপথ
শিশির উপেক্ষা করে তোমার শরীর
পাবে বলে ঠায় জেগে আছে সন্ধে থেকে
২০ শ্রাবণ ১৩৯২
---------------------------------------------------------------------------------
স্থানিকতা
যে-মানুষীর হনুমানের ঢঙে চার হাতে জড়িয়ে ধরার তল্পিতল্পা ছিল
তার সঙ্গেই তো ধুপকাঠি-গেঁথা পাকা-কলার কুচকুচে পিঁপড়ে পাড়ায়
অন্ধকার দিয়ে নিজের বদূরত্বটুকু বেঁধে রাখতে চাইছিলুম
ওকে পেয়েছিলুম ছোটবেলার চান-করার হল্লায় তৈরি বিয়েবাসরে
মেঘ থেকে বৃঢ়্টিফোঁটা খুঁটেখুঁটে ঘাম জমিয়ে তুলত মুখময়
গৌড়ের সেসব ভুলভাঙা রাজপথ তো এখন অচেনা খেতসবুজ গ্রাম
মিটকি মেরে পড়ে আছে আলোর ঝলকানিতে টোলখাওয়া বিদ্যুতে
কেননা ইতিহাসে ঢুকতে গিয়ে চৌকাঠে ঘা খেয়ে ওর মাথা ফেটে গেছে
হয়তো একদিন তিলোত্তমাদের ফেলে দেয়া তিলগুলো জড়ো করে ফেলবে
আর চিতার ওপর হাসতে-হাসতে উঠে বসবে আগুনের মুখোশপরা গৌড়
কলকাতা ৬ আগস্ট ২০০১
-------------------------------------------------------------------
উৎপাদন পদ্ধতি
বিদ্যুতের তার ঝড়ে ছিঁড়ে ঝুলে আছে
এতো কী ভাবছো বাজে সারাদিন ধরে
যাও ছুঁয়ে দাও গিয়ে মাথা ঠিক রেখে
মুঠোর ভেতরে নাও তীব্র জ্যোতিরেখা
একটা ঝলকে স্নেহ রক্তে ঢুকে যাবে
দেখে নাও মাটিতে পা থাকা কত ভুল
মাটি ও তোমার মাঝে দরকার ছিল
হাকুচ আড়াল কোনো হিজড়ে তৈজস
কীরকম জ্বলে ওঠো দেখতে চেয়েছি
শাদা ত্বক এক লহমায় পুড়ে কালো
চোখ থেকে চাউনি উধাও জানুদেশ
থিরথির কেঁপে ছিটকে ঘাসের মধ্যে
পড়ে তুমি বারকয় নড়েচড়ে স্হির
শেষবার তারপর ঝুঁকে চুমু খাবো ।
২১ শ্রাবণ ১৩৯১
---------------------------------------------------------------
ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
শেষরাতে পাশ থেকে কখন উঠেছ
চুপচাপ আলমারি ভেঙে কী অ্যাসিড
ঢকঢক করে গিলে মরছ এখন
আলজিভ খসে গেছে দুগালে কোটর
মাড়িদাঁত দেখা যায় কষেতে বইছে
গাঢ় ফেনা হাঁটুতে ধরেছে খিঁচ ব্যথা
চুল আলুথালু বেনারসি শাড়ি শায়া
রক্তে জবজবে মুঠোতে কাজললতা
শোলার মুকুট রক্ত-মাখা একপাশে
কী করে করেছ সহ্য জানতে পারিনি
শুনতে পাইনি কোনো চাপা চীৎকার
তবে কেন সায় দিয়েছিলে ঘাড় নেড়ে
আমি চাই যেকরেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে
২২ শ্রাবণ ১৩৯১
--------------------------------------------------------------------
আমি ভঙ্গুর হে
আমি যে-নাকি গাইডের কাছে ইতিহাস-শেখা ফোসকা-পড়া পর্যটক
ছায়ায় হেলান দেয়া বাতিস্তম্ভের আদলে গিসলুম পিতৃত্ব ফলাবার ইসকুলে
জানতুম যতই যাই হোক ল্যাজটাই কুকুরকে নাড়ায় রে
আমি যে-নাকি প্ল্যাটফর্মে ভবিষ্যভীতু কনের টাকলামাথা দোজবর
বস্তাপ্রতিম বানিয়ার বংশে এনেছিলুম হাইতোলা চিকেন-চাউনি
কাদাকাঙাল ঠ্যাঙ থেকে ঝরাচ্ছিলুম ঘেসো ঝিঁঝির সাম্ভানাচ
আমি যে-নাকি ফানুসনাভি ব্যাঙ-থপথপে শুশুকমাথা আমলা
মাটিমাখা নতুন আলুর চোখে-দেখা দুটাকা ডজন রামপ্রসাদী জবা
চাষির ঢঙে বলদ অনুসরণ করে পৌঁছেছিলুম বিধানসভার কুয়োতলায়
আমি যে-নাকি পোলকাফোঁটা পুঁইফুলে দুভাঁজ করা হেঁইয়োরত বাতাস
ঢেউ-চাবকানো ঝড়ে যখন বঁড়শি-খেলা পুঁটির পাশে ভাসছি
তখন বুঝলি লম্বালম্বি করে কাটা কথাবাত্রার লাটিমছেঁড়া ঘুড়ি
আমি যে-নাকি ভূতলবাহী আওয়াজ-মিস্ত্রি হলদে-ল্যাঙোট বাবুই
চোখে-চোখে শেকল-আঁকা ভিড়ের মধ্যে এঁদো বিভাগের কেঁদো
চিংড়ি-দাড়া আঙুল দিয়ে খুলছি বসে জটপাকানো মুচকি-দাড়ির হাসি
২ জুন ১৯৯৮
----------------------------------------------------------------------------
আরেকবার উহুরু
কালো কাপড়ের খোল মুখেতে পরানো, দুই হাত
পিছমোড়া করে বাঁধা, দাঁড়িয়ে রয়েছি পাটাতনে ।
জল্লাদের ঘামের তিতকুটে গন্ধে ভোরের বাতাস থম---
সময় গুনছে কারা ? ডাক্তার পুলিশ জজ ওয়ার্ডেন ? নাকি কেউই গোনে না !
আচমকা নেমে যাব ঝুপ শব্দে যেখানে ঘোলাটে অন্ধকারে
পোষা হয় ঘামলোনা নোংরা ইতিহাস ;
কাঁপতে থাকবে দড়ি, প্রথমে খুবই ঘনঘন,
দুর্বল ঝাঁকুনি, তারপর স্হির, বোবা চিৎকারে
ওভাবে যেখানে কবি খুনি নেমে গেছে বহুবার
আমিতো উঠেছি আজ সেইখান থেকে জ্যান্ত হয়ে
এ-ই একমাত্র ওঠা । এছাড়া উথ্থান নেই শব্দ-দানবের
যাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকে বিধ্বস্ত ভূগোল
মরার জন্যে যারা জন্মায় আমি সেই ধর্মবংশ
বাঁচিয়ে রাখার জন্যে বারবার ঝুলি না ফাঁসিতে ।
১৯ আষাঢ় ১৩৯২
----------------------------------------------------------------------
সব গর্তই ঊর্ধমুখীন, আহা
আজেবাজে স্বপ্ন যাতে না দেখে ফেলি
তাই স্বপ্ন পাহারা দিচ্ছি এমন এক ভোরে
জলের ঢেউয়ে গড়া অহংকারের পাঁচিল তুলে
ছুঁচ-সুতো দিয়ে লেখা গল্পের শহিদটাকে
খুঁজে পেলুম জাহাজডুবির লাশেদের সভায়
সে একখানা বোড়ে ঘেরা দাবার রাজা বটে
অনেক গাছ তো হয়ে ওঠে কিন্তু কিচ্ছুটি করে না
পালানো বোউকে ফেরত নায়া স্বামীর ঢঙে
যে-উপমা কবিতার লাইনে আটকা পড়েছে
যেন সধবার শব সাজাবার বিউটিশিয়ান
যাঁর কারবার অতীতের বর্তমানটুকু নিয়ে
দিব্বি থাকেন বাকোয়াসের খোশমেজাজি গুলগল্পে
কলকাতা ২১ জুন ২০০১
--------------------------------------------------------------------------
অধিবাস্তব
বধির যেভাবে নাড়ির স্পন্দন শোনে
মাছেদের দেখা স্বপ্নে ভারাতুর নদীতে ডোরার নকশা পালটাতে নেমেছিল জেব্রা
টুঁটি ছেঁড়ার রক্তাক্ত মুহূর্তে
নিহতের মায়ের প্রসব-বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল ওর রক্তের ব্যথায়
দুর্গা-প্রতিমার না-আঁকা চোখ দিয়ে
ও দেখল অতল মৃত্যু আর অসুস্হ আলো
অস্তসূর্য তখন মানুষের ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিচ্ছে
স্বপ্ন দেখার জন্যে প্রত্যেকে যে-যার অন্ধকার গড়ে নিচ্ছিল
কিন্তু বাড়িতে সবাই ভালো আছে শুনে মনখারাপ হয়ে গেল রোগিনীর
ওই নদীতেই তিনশো বছর আগে
বিদেশি খুনি ফেলে গেছে তার রক্তে-ভেজা ভুরু
আজ আর ঢেউয়ে বিজয়ের আহ্লাদ নেই জয়ের আছাড়টুকু আছে
নিজের তাপেই নিজে শুভেচ্ছায় জ্বলেপুড়ে গেল
জেব্রা ওর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে
নষ্ট করে দিয়েছিল সবুজ কৌমার্য
ফুসফুস থেকে আকাশ ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল মর্গের মুদ্দোফরাস
ওর দেহে কাদার সিন্দুকে রাখা কেঁচোদের অলংকার
ওর ছিল পাগলের ওড়ানো ঘুড়ি
পড়ে আছে প্রজাপতিদের ফ্রিলদেয়া শালুকের কোঁচকানো জলে
ওখানেই কেউটে যুবতী স্ট্রিপটিজ করে
ফেলে গিয়েছে ধবধবে খোলস
অথচ সে-মেয়ে আজীবন নিজের স্তনদুটিকে রাখতে চেয়েছে দুধহীন
এখন কেউই বলতে পারছে না
কবে থেকে দণ্ডভোগ শুরু হবে
কেঁচো-গেঁথা বঁড়শি
মানুষ ও মাছের সত্যকে আলাদা করে দিয়েছিল
১৬ জানুয়ারি ১৯৯৯
-----------------------------------------------------------------------------
প্রস্তুতি
কে বললে বিদ্ধস্ত হয়েছি ? দাঁত-নখ নেই বলে? ওগুলি কি খুবই
জরুরি ? আবাঁট চাকুর মেধা তলপেট লক্ষ করে বিদ্ধ করে দিয়েছি সেসব
এরই মধ্যে ভুলে গেলেন কেন? পাঁঠার মুখের কাছে
পাতাসুদ্ধ কচি এলাচের গোছা, সেই যে সেই সব কাণ্ড ? ঘৃণাশিল্প ক্রোধশিল্প
যুদ্ধশিল্প ! পিছমোড়া মুখবাঁধা যুবতী সানথাল: গোলাপি ফুসফুস ছিঁড়ে
কুখরির ধারালো আনচান---সেইসব ?
হৃৎমাংসে রক্তমেখে উঠে-আসা চাকুর গরিমা ? আমার তো গান বা
সংগীত নেই ; কেবল চীৎকার; যতটা হাঁ করতে পারি
নির্বাক জঙ্গলের ভেষজ সুগন্ধ; ঘুঁজি পরিসর কিম্বা হারাম সন্ন্যাস
বলিনি 'জিভ দিন জিভ গোঙানি ফেরত নাও
দাঁতে দাঁত দিয়ে সহ্য করার ক্ষমতা' । নির্ভীক বারুদ বলবে:
'মূর্খতাই একমাত্র শিক্ষণীয়' । উদারহস্ত নুলো
দাঁতে ছুরি নিয়ে আমি লাফিয়াছি জুয়ার টেবিলে, তোমরা ঘিরে ফ্যালো
ছেঁকে ধরো রাবার বাগিচা কফি চায়ের বাগান থেকে
গামবুটে স্বচ্ছন্দ চাকুরিসুদ্দু এসো কে কোথায় আছো
জরাসন্ধের পুং যেভাবে বিভক্ত হয় হীরকের দ্যুতি ছলকে ওঠে
হাত-পা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর জ্ঞানগমি্য বলে কিছু নেই
বাঁশির মতন ধরে সিঁধকাঠি বাজিয়ে দেখেছি আমি অসুখে অভাবে
আপেল ত্বকের মোমরেণু মাখা ভঙ্গুর স্নেহ
সঙ্গমের আগে মাদি পিপীলিকা ডানা খুলে রেখে দেবে পাশে
আমিও উরুত চাপড়ে বিকল্প চীৎকার দিচ্ছি: পৃথিবীকে খালি করো
বেরও বের হও সর্বশক্তিমান
বান্দরের চুলকানিপ্রবণ চার হাতে শঙ্খ
চক্র পদ্ম গদা নিয়ে নিজের ঘামের নুনে লবণ-বিদ্রোহ হোক
বারুদ সুতলি ধরে বিস্ফোরণের দিকে তুমাকার স্ফুলিঙ্গ ছুটুক
সারা গায়ে অন্ধকার লেপড়ে এসো বাকফসলের কারবারি
কুকুরযুবার মনোমালিন্যে ভরা মাঝরাতে
কীটনাশকের ঝাঁঝে মজে থাকা ফড়িঙের রুগ্ন দুপুরে
ভূজ্ঞানসম্পন্ন কেঁচো উঠে আয়
চাকুর লাবণ্য আমি আরেকবার এ-তল্লাটে দেখাতে এসেছি ।
১৯ ফাল্গুন ১৩৯১
------------------------------------------------------------------------
মুরগির রোস্ট
পালক ফুলিয়ে ক্রোধে লড়ো মুর্গা, চাকুমালিককে খুশ করো
হুলেতে পরাগ মেখে ঝাপটাও ডানা
বলেওছি: দুহাত মুচড়ে নতজানু করে রাখো
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মাদুর গুটিয়ে নেমে এসো ছাদ থেকে
বুটজূতো---রাইফেল---ঘুরন্ত বুলেট---চিৎকার
'বাড়ি নিয়ে চলো' বলে কেঁদে ওঠে পাশের হাজতে বন্ধ বৃদ্ধ কয়েদি
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও যেতে দাও বাড়ি যেতে দাও
ডিমের ওপরে বসে সিংহাসনে ঝিমোয় ডাহুক
অন্ধকারে গলা টিপে ধরো
লড়ো মুর্গা, মরো লড়ে, গর্জাও গুঙ্গার দলে ঢুকে
জিভেতে কাঁচের ফুলকি---নাচাচ্ছি বুকের পেশী
মাছের কানকো খুলে জলেতে কুয়াশা মিশিয়েছি
কড়ে আঙুলের টুকরো মোড়া ছিল গোলাপি কাগজে
দুহাতে দুচোখ ঢেকে কে কাঁদে হাউ-হাউ করে জেলখানায়
নারী না পুরুষ আমি বুঝতে পারি না
এ-নাও চোখের পাতা---ফুঁ দাও বাঁহাতে রেখে
শিশিরে ফণার পাঞ্জা খোলো
মেয়েলি হিসির শব্দে তলপেট কাঁপে জাত-গোখরোর
রক্ত গড়ালে নাকে তুলো গুঁজে শ্মশানে পাঠাও
রাস্তায় পড়ে থাকবে চটিজুতো ভাঙা-ইঁট ঠ্যাঙ টেনে ছেঁড়া পাতলুন
ঝড়ের সমুদ্র থেকে যে-ঢেউ খাবলে তুলে মেখেছি দু-পায়ে
সে-নব বর্ণমালা থেকে আজ হরফ এনেছি
১২ চৈত্র ১৩৯২
----------------------------------------------------------------------------
দুটি বিশ্ব
আমরা তো জানি রে আমরা সেরে ওঠার অযোগ্য
তাই বলে বৃষ্টির প্রতিধ্বনিতে ভেজা তোদের কুচুটে ফুসফুসে
গোলাপি বর্যাতি গায়ে কুঁজো ভেটকির ঝাঁক সাঁতরাবে কেন
তোদের নাকি ধমনীতে ছিল ছাইমাখা পায়রাদের একভাষী উড়াল
শুনেছি অন্ধের দিব্যদৃষ্টি মেলে গাবদাগতর মেঘ পুষতিস
বগলে গুঁজে রাখতিস গাধার চিল্লানিতে ঠাসা রোজনামচা
আর এখন বলছিস ভোটদান তো দানবীর কর্ণও করেননি
কে না জানে শববাহকরাই চিরকাল অমর হয়েছে
ঔরসের অন্ধকারে কথা বলার লোক পেলি না বলে
ঘড়িঘরহীন শহুরে ওয়ান-শট প্রেমিকা খুঁজলি
কী রে তোদের কি ঠিক-ঠিকানা নেই না রক্তের দোষ
যে বলিপড়া আয়নায় চোপরদিন লোলচর্ম প্রতিবিম্ব পড়ে
ছি ছি ছি নিশ্বাস ফেলে সেটাই আবার প্রশ্বাস হিসেবে ফেরত চাস
আমি তো ভাবছিলুম তোরা সন্দেহ করার অধিকার প্রয়োগ করবি
তা নয় সারা গায়ে প্রাগৈতিহাসিক চুল নিয়ে ঢুং ঢুং তুলো ধুনছিস
শুভেচ্ছা রইল তোরা যেন দুঃশাসনের হাত দুটো পাস
যা দিয়ে ধোঁয়ার দুর্গে বসে ফুলঝুরির ফিনকি গুনবি
২৭ এপ্রিল ২০০০
-----------------------------------------------------------------------------
অন্নবিচার
মহিলাদের পোশাক পালটাবার মাংসল গন্ধে বুঁদ
যে-ঘরটায় এক ডিভোরসি বোলতাবধু ডিম পার্ক করেছেন
শহুরে পাখিদের ছ্যাঁচড়া জঞ্জালের ভজকট ভাষা ডানায় বয়ে
ভেতরে ঢুকে ঝোড়ো ঝড় নিজে হাতে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে দ্যাখে
জোরকদমে চর্চা চলছে দিলদরিয়া ভালোবাসার ঘিজতাঘিজাং
যদিও ফাটলপ্রিয় ছারপোকারা নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল
যে-যার মতন ভালো বা খারাপ হবার স্বাধীনতার দরুন
ছাদ-উঁচু ওই ঘরের অ্যান্টিক পালঙ্কই শেষমেষ পেডিগ্রির খুঁত ধরে
কেননা ডক্টরেট-করিয়ে ছাত্রীদের জন্যে বরাদ্দ ধর্ষণের পারিতোষিক
ওই ঘরেই খেপে-খেপে বিলোনো হয় বুদবুদময় কণ্ঠস্বরে
অথচ অধ্যাপকবাবুর ঘিলু থেকে জোয়ারের বয়স কবেই খাল্লাস
বলো দিকিন ওরা কী-ই বা দু ছত্তর মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে লিখবে
কলকাতা ৪ জুলাই ২০০২
----------------------------------------------------------------------------
ঘুণপোকার সিংহাসন
ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবানপ্রাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহীর রাজ্য এনেছো এদেশে ।
২ ভাদ্র ১৩৯২