০১.
সফদার হাশমি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৫৪ সনের ১২ এপ্রিল ভারতের দিল্লিতে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
২ জানুয়ারি , ১৯৮৯, জননাট্য মঞ্চের কর্মীদের উপর একটি সমাজবিরোধী স্বার্থান্বেষী মহলের মরণঘাতী হামলায় জননাট্যমঞ্চের আহবায়ক সফদার হাশমি দিল্লির একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেণ। ঐদিনে দিল্লির বাইরে একটি বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকশ্রেণির সাথে এক ঐক্যমতের অনুষ্ঠানে জননাট্য মঞ্চে প্রদর্শিত হচ্ছিল হল্লা বোল। আর তখনই কংগ্রেসের কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হমলা করে।
সফদার হাশমি ছিলেন ভারতের পথানাটক থিয়েটারে আন্দোলনের একজন পথপ্রদর্শক, অভিনেতা, পরিচালক এবং নাট্যকার। তবে হাশমির মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতেও, জনম এর কর্মতৎপরতা থেমে যায় নি।
০২.
ভারতের প্রথম রাজনৈতিক থিয়েটার দল জননাট্য মঞ্চ, প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে, সফদার হাশমি সহ দিল্লির একটি বামপন্থী অপেশাদার থিয়েটার দলের মাধ্যমে, যিনি থিয়েটারকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘জনম’ এর অর্থ ‘নবজন্ম’ একই সাথে এর আদ্যাক্ষরের বিশেষণ হলো জননাট্য মঞ্চ; যার অর্থ জনগণের থিয়েটার। ‘জনম’ এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সামাজিক ভাবে সম্পর্কিত বিষয়বস্তু, সমসাময়িক ঘটনাবলি ও উন্নয়নমূলকনাটকসহ দিলি শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক নাটক করে থাকে। এর প্রধান দর্শকরা হল স্থানীয় শ্রমিকশ্রেণি, ছাত্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। এইদলটি যেসব পথনাটক করে থাকে সেগুলো মূলত জনগণের অধিকারভিত্তিক নাটক এবং এগুলো প্রদর্শিত হয় বস্তিতে, কারখানার অভিমূখে, রাস্তায় জানুয়ারি ২০০৬ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষিত দল নিয়ে প্রদর্শিত নাটকের সংখ্যা ৮,৫০০ এর উপরে, যার মধ্যে পথনাটকের সংখ্যা ৭০টি এবং পালানাটক ১৩টি এবং এগুলো ভারতের প্রায় ১৪০টি শহরে প্রদর্শিত হয়। এছাড়াও প্রতিবছর তারা তাদের থিয়েটারকর্মীদের নিয়ে সম্মিলিত সভার আয়োজন করে। তারা কখনো ভারতের বাইরে প্রদর্শনী করে না, যদিও তাদের নাটকগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়েছে।
দলটির উল্লেখযোগ্য কিছু নাটক যথা-- হল্লা বোল, মেশিন, সম্রাট, অউরাত, রাজা কা বাজা, মাত বান্ধো ইনসান কো, আন্ধেরা আফতাব মানে গা, জিনহে ইয়াকিন নেহি থা, আর্তনাদ, রাহুল বক্সার, বো বোল উধি এবং ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর গুরুজি। এরমধ্যে ‘অউরাত’ নাটকটি নিয়ে জননাট্য মঞ্চ প্রায় ৩০০০ প্রদর্শনী করেছে এবং বাংলাদেশে ও বিভিন্ন থিয়েটারদল কর্তৃক প্রদর্শিত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে নারীর উপস্থিতি থাকে। তাদের নাটকের বিষয়বস্তুগুলো হলো নির্বাচনী আনুষঙ্গের অপব্যবহার, শ্রমিক অধিকার, পুলিশী স্বৈরাচারিতা, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, মহিলা শ্রমিকের দুর্দশা, কারাধর্ষণ এবং বিভিন্ন ধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়সমূহ।
০৩.
৬০ এর দশকে ইন্ডিয়ান পিপলস্ থিয়েটার মুভমেন্ট থেকে জননাট্য মঞ্চ এর জন্ম। ইন্ডিয়ান পিপলস্ থিয়েটার মুভমেন্ট এর দিল্লিস্থ শাখা ক্রমেই অম ও দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৩ সালে সেখানে থেকে কিছু সদস্য বেরিয়ে এসে জনম গঠন করে। তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নাটকের মূল বিষয়বস্তুর মাধ্যমে যে প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করা হয় তা সবসময়ই সমসাময়িক গণ আন্দোলনের সাথে থাকে। তারা তারা সমসাময়িক সামাজিক বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে ২০ থেকে ২৫টি নাটক করে, যার মধ্যে একটিতে হলেও নারী সমস্যা বিষয়ক নাটক করে থাকে।
জননাট্য মঞ্চ দিল্লি এবং দিল্লির বাইরে নিজস্ব একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তবে তারা শুধুমাত্র সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়েই কাজ করে থাকে জনমের থিয়েটারপ্রক্রিয়া একটি বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোর একটি বিস্তৃত ধারণা দেয়া। জনমের সদস্য হওয়া সামাজিক পরিচিতিরও একটি অংশ দলটির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে রয়েছে। শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি চাকুরিজীবী, বেকারযুবক, দকুশলী, শিল্পী থেকে ছাত্র পর্যন্ত। বর্তমানে তাদের ২০ থেকে ৩০জন দসদস্য রয়েছে যারা একইসাথে অভিনয় থেকে শুরু করে প্রদর্শনীর সব কাজই করে থাকে তাবে তারা তাদের প্রয়োজনের সময় ৫০ থেকে ১০০জন দকর্মীকে একত্র করতে পারে। তাদের নির্দিষ্ট কোন কার্যলয় বা মহড়ার স্থান নেই। প্রয়োজনের সময় তারা মহড়ার জায়গার ব্যবস্থা করে। বর্তমানের প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগেও সাইবার স্পেসে তাদের নিজস্ব কোন ওয়েব ঠিকানা নেই।
এই সংগঠনটি কোনো ধরণের দাতাসংস্থা এমনকি সরকারের কাছ থেকেও সাহায্য নেয় না; বরং তারা তাদের সদস্য এবং বিশাল সংখ্যক দর্শকদের উপরই নির্ভর করে। প্রদর্শনীর শেষে জনম তার দর্শকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এবং মাঝে মাঝে শ্রমিক সংঘ বা অন্যান্য সংঘের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে থাকে। তারা এনজিও বা দাতাসংস্থার কোন সাহায্য নেয় না। জনম তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দৃঢ়তার জন্য তাদের যেকোন নাটক বা যেকোন কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত যে কোন সময় নিতে পারে। যেহেতু তাদের কাজ হলো জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যেহেতু তারা শ্রমিক সংঘের সাথে একটি বোঝাপড়ার সম্পর্ক অর্থাৎ শ্রমিক এবং শিল্পীর সম্পর্ক তৈরি করে।
০৪.
১৯৯৩ সালে জননাট্য মঞ্চ সফদার হাশমি মেমোরিয়াল লেকচার পর্বের একটি প্রতিষ্ঠান করে। আর ১৯৯৭ সালে জনম “সফর” (আদ্যাক্ষরের নাম সফদার রঙ্গমঞ্চ) নামের একটি পরিবর্তনশীল এবং অপ্রতিরোধ্য চলমান থিয়েটার গঠন করে। ২০০৪ এর জানুয়ারিতে যৌথ গণমাধ্যমের বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী উত্তেজনার উদযাপন উপলে জনম প্রযোজনা করে । বুশ কা মতলব জাদি, ৪৫ মিনিটের এই নাটকটি মুম্বাইয়ের ওয়ার্ল্ড সোসাল ফোরাম কর্তৃক সম্পাদিত হয়েছে। তারা শ্রমিকশ্রেণি বা সাধারণ মানুষের জন্য প্রদর্শনীর পাশা পাশি সম্বিলিতভাবে কাজ করে কমিউনিস্টপার্টি অব ইন্ডিয়ার সাথে, কমিউনিটির মধ্যে রয়েছে মার্ক্সিস্ট সি পি আই (এম) এবং বিভিন্ন ধরনের কার্যকর সংগঠনের সাথেও কাজ করে। তাই যখনই কোন আন্দোলন বা কর্মীসম্মেলন হয় সেখানে অবশ্যই জনমের অংশগ্রহণ থাকে তারা নর্মদাবাঁচাও আন্দোলনে প্রদর্শনী করে, ভোপালে নির্যাতিতদের সুবিচার এবং অধিকারের জন্য তাদের পাশে দাড়াঁয়, গুজরাটের হত্যার তৎপরতার উপর সাধারণ মানুষকে জাতিগত দাঙ্গার ব্যাপারে সচেতন করে। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সফরের সময় তাদের সম্মিলিত তেজোদ্দীপ্ত প্রদর্শনী এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী ও বুশ বিরোধী সভা করে।
০৫.
মলয়শ্রী হাশমি প্রায় ৩৬ বছর গণথিয়েটারআন্দোলনের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞাতা থেকে মন্তব্য করেন যে “একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জনম শুধুমাত্র অধিকার বা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গুরুত্বরোপ করে না বরং আমরা সমাজের পারিপার্শ্বিক সমস্ত ঘটনাবলীর উপরই নজর দিই, একটি রাজনৈতিক থিয়েটার সংগঠন হিশেবে বিশেষ নির্দেশনার মাধ্যমে সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরি, এর মানে এই নয় যে, আমরা থিয়েটারের সৌন্দর্য বা গুণগত দিকে খেয়াল করছি না। আমরা মনে করি, থিয়েটার মানুষের অনুভূতি প্রকাশের একটি সৃজশীল মাধ্যম, সেজন্য আপনি দেখতে পারেন যে, এটি অনুভূতির একটি শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক থিয়েটারে অনুশীলনের মাধ্যমে গঠন এবং প্রসঙ্গকে সংমিশ্রিত করা হয়েছে সৌন্দর্য এবং রাজনীতির মাধ্যমে।”
জনম থিয়েটারের অংশগ্রহণ মূলক পদ্ধতিটি একটি প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া। তাদের কাছে থিয়েটার শুধুমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম নয়, অনুভূতি এবং অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া ও সৃজনশীলতার অন্তর্ভূক্ত। তাই নাটক প্রযোজনার সময় তারা বিষয়বস্তুর সৃজনশীলতা এবং সৌন্দর্যের মান রাখবার ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে যত্ন নেয়। তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুযায়ী নাটক প্রযোজনার সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, ইয়ে দিল সঙ্গে মার গুরুজি’ নাটকটি গুজরাটের জাতিগত দাঙ্গার ঘটনার সাতদিনের মধ্যেই প্রযোজিত হয়। তাদের কাহিনিকার, লেখক, সঙ্গীত পরিচালক, পরিচালক, পরিকল্পনাকারী, এবং অভিনেতা সবাই প্রত্যেকটি নাটকে সম্মিলিত শ্রম অভিনেতা সবাই প্রত্যেকটি নাটকে সম্মিলিত শ্রম দিয়ে থাকে। তারা রাজনৈতিক থিয়েটার, বিশেষ করে পথনাটক সম্পর্কে প্রত্যেক সদস্যের মন্তব্য ও নির্দেশনার প্রেক্ষিতে নাটকগুলোকে সৃজশীলক সৃজনশীল করে তোলে। কোনো বিশেষ ঘটনার উপর নাটক তৈরি করতে তাদের ৭ দিন থেকে ৪বা ৫ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে প্রত্যেকটি নাটক নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রদর্শনী পর্যন্ত তাদেরকে অনেক গবেষণা ও চিন্ত-ভাবনার আদান প্রদান করতে হয়। তাদের প্রদর্শনীর ধরণ অধিকতর সহজ ও সাধারণ। বেশিরভাগ সময়ের তাদের প্রদর্শনীর স্থান নির্বাচন করে থাকে সি পি আই (এম) কার্যক্রমের কাছাকাছি শ্রমিকশ্রেণির আবাসিক এলাকা বা কারখানা এলাকায়। নাটকের জন্য প্রয়োজনীয় সাজসজ্জার সরঞ্জাম কম হওয়াতে তারা তাদের গাড়িতেই সেসব বহন করতে পারে। প্রদর্শনী চলাকালীন সময়ে কুশলীরা কালো পাঞ্জাবি পরিধান করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। মঞ্চের দুইপাশে দুইসারি আসনে দর্শকদের বসার জায়গা করা হয় যেন তারা প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারে। প্রথমে ছন্দময় পরিবেশের মাধ্যমে দর্শকদেরকে নাটক দেখার জন্য আহবান করা হয়। অতঃপর তারা প্রদশর্নী শুরু করে। এভাবে দিনের আলোতেই তারা প্রদশর্নী করে এবং যদি সন্ধ্যায় নাটক হয় তবে সাধারণ বাতি দিয়েই প্রদশর্নী করে। প্রতীকী তাৎপর্যের দিক দিয়ে তাদের পোষাক উপযোগী, বহনে সুবিধাজন এবং সাধারণ। তাই প্রদর্শনীর সময়ে কুশলীরা সহজেই এগুলো ব্যবহার করতে পারে । প্রদর্শনী শুরুতে একজন এসে দর্শকদের কাছে জনমের পরিচিতি তুলে ধরে এবং নাটক সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে যায়। এর পরেই অন্যএকজন এসে দর্শকদেরকে জানিয়ে যায়, যে নাটকের শেষে তারা যেন তাদের সামর্থ অনুযায়ী অর্থ দিয়ে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করে। অর্থসংগ্রহের এই প্রক্রিয়াটিও তাদের অংশগ্রহণ মূলক কাজের একটি অংশ।
০৬.
মূলত জননাট্য মঞ্চের প্রচেষ্টা হলো সমাজের শোষিতশ্রেণির মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যেহেতু নাগরিক অধিকার সমাজে শোষণের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রত্যেক নাটকেই তারা নাগরিক অধিকার লঙ্গনকে আলোকপাত করে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ১২:১৮