এই পোস্ট এর আগে একবার দিলেও আমাকে আবারও রিপোস্ট করতে হচ্ছে। কারন এর আগের পোস্টটি অনেকেই ঠিকমত পড়েননি। অর্ধেক পড়েই যা বুঝার বুঝে নিয়ে ইচ্ছা মত কমেন্ট করে গিয়েছিলেন। আমারও ভুল ছিল ওই পোস্টটি আমি কিছুটা পেঁচানো ভাষায় লিখেছিলাম। তাই অনেক আহাম্মক পাঠক পড়েও কিছু বুঝতে পারে নি। এবার তাই তুলনামূলক সহজ ভাষায় লিখে দিলাম। আশা করি এবার না পড়ে রেটিং বা মন্তব্য করার মত ভুল কেউ করবেন না।
বলা হয় ইসলাম শুধু কোন ধর্ম নয়। এটি নাকি একটি আইডলজি। মূলত হিযবুতিরাই এ ধরণের দাবি করে থাকে । তারা আরও দাবি করে যে, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্টানধর্মের মত ইসলামকে নাকি শুধু ধর্ম কখনো বলা যায় না। কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম যেমন আদর্শ, তেমন ইসলামও নাকি একটি আদর্শ। অন্যান্য ধর্মের মত পৌত্তলিকতা নাকি এই ধর্মে একেবারেই নাই। সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রতিষ্ঠিত এই ধর্মে নাকি অন্যান্য ধর্মের মত অবৈজ্ঞানিক কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।
উইকিপিডিয়ায় ধর্মের সংজ্ঞায় দেখা যায়, religion is a set of beliefs concerning the cause, nature & purpose of life & the universe, especially when considered as the creation of a supernatural agency. এই সংজ্ঞার সাথে ইসলামের মিল খোঁজার দায়িত্ব আমি পাঠকদের হাতেই তুলে দিচ্ছি। প্রথমে আমরা দেখাব, ইসলামের সাথে অন্যান্য পৌত্তলিক ধর্মের তেমন কোন পার্থক্যই নাই। পৌত্তলিক ধর্মের মত হাস্যকর নিয়ম-কানুন ও রিচুয়ালগুলো এই ইসলামেও দেখা যায়। বিশ্বাস না করলে নিচের পয়েন্টগুলো দেখতে থাকুন। ইসলাম আর পৌত্তলিকদের ধর্মের ‘আকাশ পাতাল পার্থক্য’ সহজেই ধরা পড়বে।*
১. ঈশ্বর এক-একমেবাদ্বিতীয়ম (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)
২. মরণের পরে পরকাল এবং ইহকালের কর্মফল অনুযায়ী পরকালের প্রাপ্তি
৩. পরকালের ২টি বিভাগ- স্বর্গ ও নরক (বেহেস্ত-দোজখ)
৪. স্বর্গ বাগানময় এবং নরক অগ্নিময়
৫. পুণ্যবানরা (সোয়াবি) যায় স্বর্গে, পাপীরা (গুনাহগার) যায় নরকে।
৬. যমদূত (আজরাইল ফেরেস্তা) কর্তৃক মানুষের জীবন হরণ।
৭. ঈশ্বরের স্থায়ী আবাস সিংহাসন( আরশ)
৮. স্তব-স্তুতিতে ভগবান সন্তুষ্ট হন
৯. মন্ত্র (কেরাত) দ্বারা উপাসনা করা
১০. মানব জাতির আদি পিতা একজন মানুষ- মনু (আদম)
১১. পশুবলির প্রথা প্রচলন (কোরবানি)
১২. বলিদানে পুণ্যলাভ
১৩. ঈশ্বরের নামে উপবাসে পুণ্যলাভ (রোজা)
১৪. তীর্থভ্রমণে পাপের ক্ষয় – কাশীগয়া, বৃন্দাবন, বেথলেহেম (মক্কা-মদিনা)
১৫. ঈশ্বরের দূত আছে ( ফেরেস্তা)
১৬. হাঁটু গেড়ে উপাসনায় বসা
১৭. সাষ্টাঙ্গে প্রণাম ( সেজদা)
১৮. করজোড়ে প্রার্থনা (মোনাজাত)
১৯. নিত্যউপাসনার নির্দিষ্ট স্থান- মন্দির,চার্চ (মসজিদ)
২০. মালা জপ (তসবিহ পাঠ)
২১. ধর্মীয় বাণী কোন নির্দিষ্ট গ্রন্থে লিখিত
২২. ধর্মগ্রন্থপাঠে পুণ্যলাভ
২৩. নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনা করা – ত্রিসন্ধ্যা (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ)
২৪. কার্যারম্ভে ঈশ্বরের নামোচ্চারাণ – নারায়ণং সমস্কৃত্যং নবৈষ্ণব নরোত্তমম ( বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম)
২৫. গুরুর নিকট দীক্ষা (তাওয়াজ)
২৬. স্বর্গে গনিকারা আছেন – অপ্সরা, উর্বশী, কিন্নরা ( হুর, গেলমান)
২৭. উপাসনার পূর্বে অঙ্গ ধৌত করা (অজু)
২৮. নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে উপাসনায় বসা বা দাঁড়ান
২৯. স্বর্গগামীদের নদী পার হওয়া – বৈতরণী ( পুলছিরাত)
৩০. সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিনে বিশেষ প্রার্থনা - ইহুদিদের শনি, খ্রিস্টানদের রবি, মুসলিমদের শুক্র।
দেখলেন তো ইসলাম আর অন্যান্য ধর্মের মধ্যে কত পার্থক্য (!)।
এবারে আসা যাক আইডলজি বা আদর্শ প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি যে দাবি করা হয় পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রের মতই একটি আদর্শ হল ইসলাম। ইসলামি শরিয়া মোতাবেক একটি রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব বলেই এমনটি দাবি করা হয়। কিন্তু এতেই কি ইসলাম একটি সম্পূর্ণ আদর্শ হয়ে গেল। খ্রিস্টান ইহুদিদের কথা জানি না, তবে শুনেছি হিন্দুরাও নাকি ইদানীং দাবি করে যে তাদের সনাতন ধর্মেও নাকি কমপ্লিট কোড অফ লাইফ দেয়া আছে। কয় জন এই হাস্যকর দাবি মেনে নেয়? এর পিছনে তারা কি রকম যুক্তি দেয় তা অবশ্য আমার জানা নাই। জানলে সেগুলোও খণ্ডাতাম। আপনাদের জানা থাকলে বলবেন। যা হোক আমাদের আধুনিক ইস্লামিস্টরা ক্যাপিটালিজম, কমিউনিজম এর মত স্বীকৃত আদর্শের সাথে এক কাতারে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু এটা কতটুকু যৌক্তিক সেটা কি তারা কখনো ভেবে দেখেন? প্রথমে পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে আসি। অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে যেকোন রাষ্ট্রের নীতিগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এবং এটি ইসলামি শরিয়া মতে পুরোপুরি হারাম। দাবি করা হয় এই ব্যবস্থা আছেই শুধু গরিবকে শোষণ করার জন্য। যা হোক এই নিয়ে বেশি আলোচনার প্রয়োজন এখানে আছে বলে মনে হয় না। এই ব্যবস্থাটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম প্রতিকুলতার (মন্দা) মুখোমুখি হয়েছে। সমাজতন্ত্রীরা এবং ইসলামপন্থীরা যত জোড়ে পেরেছে চেঁচিয়েছে, ‘এইবার পুঁজিবাদের পতন অনিবার্য, এইবার সমগ্র বিশ্বের জনগণ বুঝতে পারবে যে আমাদের ব্যবস্হাটাই তাদের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত’। কিন্তু আসলেই কি পুঁজিবাদের পতন হয়ে গেছে। না তা হয় নি। বরং এটি বারবার রূপ বদল করে ফিরে এসেছে। আমার পরিচিত এক ব্যাংক কর্মকর্তা যিনি এই তিন রকম ব্যবস্থা সম্পর্কেই ভালো জ্ঞান ( তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই) রাখেন একবার আমায় বলেছিলেন ‘পুঁজিবাদের পতন বা বিলুপ্তি কখনো ঘটবে না। যখন কোন রাষ্ট্রে দেখা যাবে কোন ব্যবস্থাই ঠিকমত কাজ করছে না তখন এই পুঁজিবাদই আবার রূপান্তরিত ও বিবর্তিত হয়ে টিকে থাকবে’। এখন আপনারাই বলুন ইসলামের আইনকে কি আপনি বিবর্তিত করবেন। আল্লাহ মুহম্মদের মাধ্যমে যে নিয়ম মানব জাতির উপর চাপিয়ে দিয়ে গেছেন কার এত বড় দুঃসাহস আছে যে এই আইনকে তার ব্যক্তিগত বা সমাজের প্রয়োজনে সংস্কার করার।
এবার বলি সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে। অনেকেই আছেন যারা সমাজতন্ত্র ব্যবস্থাটাকেই একটা ঈশ্বরবিহীন ধর্ম বলে মনে করেন। এর পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারন রয়েছে। দেশি-বিদেশি অনেক কমরেডের আচরণ প্রায় সময়ই ধার্মিক ব্যক্তিদের সাথে মিলে যায়। এজন্য অনেক সময়ই এই সমাজতন্ত্রকে অন্যান্য উপাসনাধর্ম থেকে আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরও একে ধর্মের চেয়ে আদর্শ হিসেবেই ধরা হয় কারণ ধর্মের সাধারণ সংজ্ঞা অনুসারে একে ধর্ম বলা যায় না। এবং আমরাও এটাকে আদর্শ হিসেবেই ধরে নেব। এখন দেখা যাক এই কমিউনিজম এবং ইসলামের মধ্যে মিল বা অমিল আছে কিনা।
১. ইসলামের একজন নবী আছেন। যিনি এই ইসলামের প্রবর্তক। সমাজতন্ত্রেরও একজন প্রবর্তক আছেন কার্ল মার্ক্স। এখন ভেবে দেখুন নবীর সমালোচনা করলে আছিয়া বিবিদের জুটে মৃত্যুদণ্ড। এটা অতি সাম্প্রতিককালের কথা। রুশদি, ভ্যান গগ, অধ্যাপক আজাদ, আলি দস্তি, ইউনুস শেখদের (এখানেই থামলাম। কারণ এই তালিকা একবার লিখতে শুরু করলে মৃত্যুর আগে আর শেষ করতে পারব না) কথা না হয় নাই বললাম। মার্ক্সের বা মার্ক্সবাদের সমালোচকদের কি করা হয়? মার্ক্সকে ব্যঙ্গ করে একটি কার্টুন এঁকে দেখুন। বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে একেবারেই আসবে না তা হয়ত নয়, তবে সাধারণ মানুষের সাথে অনেক মার্ক্সবাদীও কিন্তু আপনার প্রশংসা করবে, আর নবীজির একটি কার্টুন এঁকে দেখুন। আপনার মাথার দাম যত ঘোষিত হবে শুনে আপনার নিজেরই নিজের মাথা কেটে ফেলতে ইচ্ছা হবে।
২. সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হল মার্ক্স তার একটি দর্শন দেখিয়েছিলেন। লেনিন সেটাতে কিছু পরিবর্তন এনে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপযোগী করার পর সফলভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এখন কিউবার সমাজতন্ত্র আর সেই লেনিনের সমাজতন্ত্রের মধ্যেও কিন্তু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কেউ এদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে চাইলে এদেশের নীতিতেও কিঞ্চিত পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এক নীতি সবক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু শরিয়ার ক্ষেত্রে আপনি যদি বলেন আরবে একরকম শরিয়া থাকবে, বাংলাদেশে আরেকরকম শরিয়া থাকবে, ইউরোপে থাকবে আরেকরকম, ব্যাপারটা কেমন দেখায় বলুন তো। আল্লাহর আইন স্থান, কাল পাত্র নির্বিশেষে প্রযোজ্য না থাকলে কি ভাল দেখায়?
৩. কেউ যদি মার্ক্সবাদের সমালোচনা করতে করতে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র একটি কপি নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তবে তার কি রকম শাস্তি হওয়া উচিত আর কেউ যদি কোরান শরিফের একটি কপি পুড়িয়ে ফেলে তবে তার কি শাস্তি হওয়া উচিত তা আপনারাই বিচার করুন। (আমার মতে কোন বই কখনোই পোড়ানো উচিত নয়। তা ধর্মগ্রন্থই হোক আর ফুটপাথের চটিবই হোক)। ধর্ম আর আদর্শের মধ্যকার পার্থক্যটা সহজেই সামনে চলে আসে।
সমাজতন্ত্রকে ইসলামের সাথে তুলনা করা যাবে যদি সমাজতন্ত্রকে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামকে আদর্শ হিসেবে ধরে একে কখনো কমিউনিজমের কাতারে তুলে আনা যায় না, আর ক্যাপিটালিজম তো দূরের কথা।
কেউ ইসলামকে আর দশটি ধর্মের মত একটি ধর্ম মানলে সমস্যা তেমন থাকে না। সমস্যা দানা বাঁধতে থাকে তখন, যখন কেউ বলতে থাকে, ‘it’s not only a religion. It’s a complete code of life’। ভয়াবহ আকার ধারণ করে যখন এই ইসলাম দ্বারা কোন দেশ বা রাজ্য শাসনের পরিকল্পনা করা হয়।
* ‘সত্যের সন্ধান’ আরজ আলী মাতুব্বর থেকে সংগৃহীত ও ঈষৎ সম্পাদিত।