বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিল। ভালো মেয়ে পাওয়া এই বাজারে মুশকিলই বলা চলে। আম্মা হন্যে হয়ে মেয়ে খুঁজছিলেন। চেহারা ভালো লাগে তো উচ্চতায় মেলে না। লম্বা ঠিক আছে তো স্বাস্থ্যের অবস্থা নাজেহাল- কোনোভাবেই মেলানো যায় না।
হঠাৎ একদিন। খুব বৃষ্টি ছিল সেদিন। আম্মা রিকশায় করে কোথাও যাচ্ছিলেন। রিকশাটা একটা জায়গায় এসে জ্যামে পড়ল। আম্মা হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, একটা মেয়ে রাস্তার পাশে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ছাতাটা বাতাসের তোড়ে ভেঙে গেছে। ভাঙা ছাতা মাথায় তাকে অসহায় লাগছে।
রিকশা খুঁজছিল সে। রিকশা পাচ্ছে না। এই ঘনঘোর বর্ষায় কোনো রিকশাই খালি যাচ্ছে না।
মেয়েটাকে দেখে আম্মার মনটা মমতায় ভরে গেল। কী মায়াময় চেহারা! মেয়েটার রিকশা থামানোর চেষ্টা করার ভঙ্গি, রিকশা না পেয়ে হতাশাভরা মুখচ্ছবি ইত্যাদি কিছুই আম্মার দৃষ্টি এড়াল না।
রিকশাটা মেয়েটার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে, হুডের আড়াল থেকে মুখ বের করে আম্মা বললেন,
: তুমি কোথায় যাবে মা?
: এই তো, একটু সামনেই আন্টি! দেখেন না, একটা রিকশাও পাচ্ছি না! দেরি করে বাসায় গেলে মায়ের হাতে নিশ্চিত পিটুনি খেতে হবে।
আম্মা হেসে বললেন,
: অচেনা কারো সঙ্গে রিকশা শেয়ার করা ঠিক না। তবে, তুমি যদি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারো, তাহলে চলে এসো। আমি তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি। আমিও সামনেই যাচ্ছি।
মেয়েটা ইতস্তত করল কিছুটা। তারপর রিকশায় উঠে বসল। বাসার সামনে নামার সময় আন্তরিকতা মিশ্রিত গলায় বলল,
: ধন্যবাদ আন্টি! অনেক বড় উপকার হলো আমার। প্লিজ, বাসায় আসুন না! এককাপ চা খেয়ে যাবেন আর মা'র সঙ্গে পরিচিতও হয়ে যাবেন!
আম্মা মেয়েটার ব্যবহারে এম্নিতেই মুগ্ধ ছিলেন। চায়ের অফারের আন্তরিকতায় মুগ্ধতার মাত্রা বেড়ে গেলো কয়েকগুণ!
চা খেতে বসে মেয়ের মায়ের সঙ্গে অনেক কথাই হলো। মেয়েটা পড়াশোনা করে। পরিবারে মা আর ছোট এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগেই। দু'তলা একচিলতে বাড়িটির নিচতলা নিজেদের জন্য রাখা। আয়ের উৎস বলতে- বাড়ির বাকি অংশের ভাড়ার টাকা।
এই পরিবারটির প্রতি আম্মার মনে এক অন্যরকম মমত্ববোধ জন্ম নিলো। সিদ্ধান্তটা তিনি তখনই নিয়ে নিলেন- যে করেই হোক এই মেয়েটাকেই আমি আমার 'মেয়ে' বানিয়ে নিবো।
বাসায় এসে মেয়েটার যে বর্ণনা আম্মা দিচ্ছিলেন, ছোটবোনেরা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। হবু 'ভাবী'র বর্ণনা শুনে তাদেরও পছন্দ হয়ে গেছে। আপনি করে বলবে নাকি তুমি করে- এরই মধ্যে সেটাও ঠিক করে ফেলেছে।
আমার মনের অবস্থা খুশিতে আটখানা না হলেও ছয়-সাতের কাছাকাছি।
মহা সমারোহে মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে আমারও পছন্দ হয়ে গেলো। লাখে একটা না হলেও পঞ্চাশ হাজারে যে একটা; সেটা অনায়াসেই বলা যাচ্ছিল। মজলিসে বসেই প্রশ্ন করলাম,
: আপনার নামটা জানতে পারি?
: জ্বী। ফৌজিয়া।- মিষ্টি কন্ঠে বলল মেয়েটা। কন্ঠটা আবার শোনার জন্যই প্রশ্ন করলাম,
: সূরা ফাতেহা পারেন?
পারল। এবং পুরোটা পড়েও শোনাল। 'ওয়াও' টাইপের না হলেও 'চলে' টাইপের হল।
শুভদিন দেখে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হল। আমাদের পরিবারের অবস্থা বেশ ভাল। নারায়নগঞ্জের মতো জায়গায় পাঁচতলা বাড়ি। আব্বা ব্যবসা করেন। আমিও ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সব মিলিয়ে আয়-ইনকাম মন্দ না।
আম্মা হবু বউয়ের জন্য প্রচুর গহনা বানালেন। আমি বললাম,
: কী দরকার এতো গহনার?
: কী যে বলিস না তুই! আমার বউমাকে আমি অল্প-সল্প গহনা দিয়ে বরণ করব নাকি? কোনো কথা বলবি না তুই! আমার ইচ্ছাই শেষ কথা।
বোনেরাও আম্মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে হবু ভাবীর জন্য বেশ কিছু গিফট কিনে ফেলল।
এলো সেই শুভদিন। বিয়ের দিন। আমার স্বপ্নগুলো সাজাবার দিন। বেশ এক্সাইটেড ছিলাম। ফোনে কথা বলতে চেয়েছিলাম এই ক'দিন। ফৌজিয়া প্রথম দিনই বলে দিয়েছিল,
: এটা ঠিক না। বিয়ের আগে কথা বলা অন্যায়।
আমি মেনে নিয়েছিলাম। খুশি হয়েছিলাম তার এই কথায়। তার প্রতি আমার বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গাটা আরও প্রশস্ত হল।
সব কিছু প্রস্তুত। বরযাত্রী রওনা হবার দশ মিনিট আগে একটা ফোন এলো। আমার স্বপ্নগুলো এলোমেলো করার জন্য এই ফোনকলটা যথেষ্ট ছিল। ফোন করা হয়েছিল আব্বার মোবাইলে। মেয়ের মামা ফোন করেছিলেন-
: ভাইসাহেব, একটা অঘটন ঘটে গেছে!
: কী হয়েছে বেয়াই সাহেব?- আব্বা উৎকন্ঠিত গলায় জানতে চাইলেন।
: কনে পালিয়েছে। এক কুলাঙ্গারের হাত ধরে।
...শুনছিলাম রাশেদ নামের এক যুবকের 'হবু ভ্যালেন্টাইন' এর কথা।
ঘটনার এই পর্যন্ত বলে ছেলেটা খানিকটা দম নিল। আমি বললাম,
: কী সাংঘাতিক কথা? তারপর? এতদূর এগিয়ে যাবার পর...! ঘটনা শুনে তো মনে হচ্ছে আপনি সে কষ্টটা এখনও ভুলতে পারছেন না!
: কী যে বলেন ভাই! কষ্ট পাব কেন? আমি তো ভাই বেঁচে গিয়েছি এমন মেয়ের হাত থেকে।
: কেমন?
: আসলে, ওই ছেলের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল, এবং তারা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভ্যালেন্টাইনস ডে'তে হুট করে পালাবে।
: তো, ঘটনা যখন এ-ই, আপনাকে বিয়ে করতে সে রাজি হল কেন? এ্যাফেয়ারের কথাটা সে বললেই পারত!
: বলেনি ইচ্ছে করেই।
: কেন?
: আমাদের সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে বলে। মজা করবে বলে।
: হুম! সারপ্রাইজটা সে ভালমতোই দিতে পেরেছিল। ভালোই বোকা বানাল আপনাদেরকে।
রাশেদ হেসে উঠল। থামছিলই না সে হাসি। বললাম,
: সেকী! বোকা বনেও হাসছেন?
: হাসব না! সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে সে-ই বরং সারপ্রাইজড হয়ে গেছে! কিছুদিন পর জানলাম, যে ছেলেটার সঙ্গে পালিয়েছিল, সেই ছেলে বিয়ে করবে বলে একটা হোটেলে উঠিয়েছিল। সপ্তাহখানেক আনন্দ করার পর হোটেলরুম বাইরে থেকে বন্ধ করে, ধোঁকা দিয়ে বদমাশটা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছে।
: ওহো! মেয়েটার সঙ্গে তো তাহলে খুবই বাজে ব্যাপার হলো। বললাম আমি।
: এটা ওর পাওনা ছিল। আম্মা এবং আমাদের পরিবার তাকে কী সম্মানটাই না দিতে চেয়েছিলাম। কতটা আদরই না পেতো আমাদের ফ্যামিলিতে এলে। বিয়ের পর ভালোবাসাবাসিতে তাকে ভরিয়ে রাখব, কিছুদিন পরপরই আমরা দু'জন বেড়াতে যাব, মাঝে মাঝে নিজ হাতে স্ত্রীকে রান্না করে খাওয়াব- কত স্বপ্নই না দেখেছিলাম?
অথচ, দেখুন! মেয়েটা নিজের কপাল নিজেই পোড়ালো। তথাকথিত নোংড়া প্রেম-ভালোবাসার স্রোতে নিজেকে মহাসুখে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বুঝতেই পারল না, যে স্রোতে সে ভেসে যাচ্ছিল সেটা স্বচ্ছ সরোবরের না; সে স্রোত বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির মতোই কালো এবং দুর্গন্ধময়।
---
Mahin Mahmud
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:২৫